অনেকেরই এমন হয় যে কিছু খাওয়ার সময় হোক কিংবা না খেলেও মুখের ভেতর সব সময় প্রচুর পরিমাণে লালা জমা হয়। আবার অনেকের ক্ষেত্রে ঘুমের মধ্যে মুখে লাল জমা হতে হতে সে লালা বাইরে বের হয়ে আসে। শিশুদের ক্ষেত্রে এটি কোনো অস্বাভাবিক কিছু হয় নয়। তবে বড়দের এমনটা ঘটলে তা অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে।
সাধারণত ঘুমের সমস্যা হলে কিংবা অন্যান্য কোনো স্বাস্থ্যগত সমস্যা থাকার কারণে এমনটা ঘটতে পারে। এটা কোনো অভ্যাস নয় বরং এটা অনেক সময় অসুখের লক্ষণও প্রকাশ করে। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা মুখের অতিরিক্ত লালা নিঃসরণের কারণগুলো এবং এর সমাধানের উপায় নিয়ে আলোচনা করবো।
ঘুমের সময় মুখ দিয়ে লালা পড়ার সমস্যার পেছনে থাকা কারণগুলো হচ্ছে, Reasons behind the problem of drooling during sleep are
- সব সময় এক পাশ হয়ে ঘুমালে,
- নাকের পরিবর্তে মুখ দিয়ে শ্বাস নিলে,
- মুখ হাঁ করে বা খুলে ঘুমালে,
- গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিডিটি,
- অ্যালার্জি,
- মুখের মধ্যে কোনো সংক্রমণ,
- যাঁদের টনসিলের সমস্যা রয়েছে তাঁদের ক্ষেত্রেও এই একই সমস্যা হতে পারে, তাদের ঘুমানোর সময় ছাড়াও যেকোনো সময়েই মুখ দিয়ে লালা ঝরে।
- কোনো ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি।
স্বাভাবিকের তুলনায় সবসময় মুখে বেশি লালা নিঃসৃত হওয়ার কারণ, Cause of more saliva secretion in the mouth than usual
লালাগ্রন্থির প্রদাহের কারণে লালা নিঃসৃত হয় :
মুখে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি লালা নিঃসৃত হওয়ার আরেকটি কারণ হতে পারে লালা গ্রন্থির প্রদাহ। অনেকেই হয়তো জানেন যে মানুষের শরীরে ৩ টি প্রধান লালা গ্রন্থি থাকে – প্যারোটিড, সাবম্যান্ডিবুলার এবং সাবলিঙ্গুয়াল গ্রন্থি। এই ৩ টির মধ্যে যেকোনটির প্রদাহের কারণেই অতিরিক্ত লালার উৎপাদন হয়।
মুখের স্বাস্থ্যবিধি না মানার ফলে :
কেউ যদি অতিরিক্ত লালা নিঃসৃত হওয়ার সমস্যায় ভুগে থাকে তবে তাদের ক্ষেত্রে মৌখিক স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে খেয়াল করা প্রয়োজন। এমন সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে আপনার টুথ ব্রাশ, ফ্লস এবং কুলকুচি করার বিষয়ে যত্নবান হওয়া উচিত।
মিষ্টি অথবা গরম খাবারের প্রভাব :
আপনার কী মিষ্টি খাবার বা মসলাজাতীয় খাবার অনেক প্রিয়? আপনার মুখে অত্যধিক লালা নিঃসৃত হওয়ার পেছনে এই বিষয়টিও দায়ী হতে পারে, এমনটা হওয়ার কারণ হল, মিষ্টি, গরম অথবা মসলাযুক্ত খাবার লালার উৎপাদন বৃদ্ধি করে।
প্যারোটিড নালীতে বাধার সৃষ্টি হলে
কানের সামনে অবস্থিত চোয়ালের দুই পাশের প্যারোটিড গ্রন্থি, এই গ্রন্থির সাথে লালা গ্রন্থিকে যুক্ত করে প্যারোটিড নালী, এই নালীতে বাধা সৃষ্টি হওয়ার কারণে অতিরিক্ত লালার সৃষ্টি হয়, কারণ লালাগ্রন্থি থেকে মুখে লালা পরিবহণ করার কাজ করে এই প্যারোটিড নালী। কোনো কারণে এই নালীতে পাথর হলে লালার প্রবাহে বাধার সৃষ্টি হয়। এছাড়াও কখনো কোনো আঘাত কিংবা অন্য কোন প্রতিবন্ধকতার কারণেও অতিরিক্ত লালা বের হতে পারে।
মুখে অতিরিক্ত লালা পড়ার সমস্যার সমাধানে করণীয়, What to do to solve the problem of excess saliva in the mouth
- মুখে অতিরিক্ত লালা পড়ার সমস্যার সমাধানে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি, তবে প্রয়োজনে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ যাতে এই সমস্যা আর অন্য কোনো সমস্যা সৃষ্টি করতে না পারে। মুখে অতিরিক্ত লালা পড়ার সমস্যার সমাধানে করণীয়ঃ
- যাদের ঘুমের মধ্যে লালা ঝরার সমস্যা হয় তাদের প্রাথমিকভাবে এ সমস্যা দূর করতে গিয়ে ঘুমের ভঙ্গিমা বদলাতে হবে। যদি ঘুমের মধ্যে মুখ থেকে অতিরিক্ত লালা বেরিয়ে আসাটাই মূল সমস্যা হয়, তবে এর জন্য লেবুর ছিলকা খেলে বেশ উপকার পাওয়া যায়। ঘুমের মধ্যে হওয়া লালা ঝরার সমস্যা সমাধানে অনেকে ম্যানডিবুলার ডিভাইস ব্যবহার করে থাকেন। এটা হল এমন একটা যন্ত্র যা মুখে লাগিয়ে ঘুমাতে হয়। এটা ঘুমের মধ্যে মুখ বন্ধ রাখে এবং ঘুমকে আরামদায়ক করে তোলে।
- দীর্ঘদিন ধরে যদি কারো এই লালা অতিরিক্ত পরিমাণে জমা হওয়ার সমস্যা থাকে তাহলে এটা অন্য কোনো কারণেও হতে পারে। মুখে লালা জমা হওয়ার অন্যতম কারণ হলো আপনার পেটে যদি কৃমির প্রভাব পড়ে। পেটে কৃমি বেড়ে গেলে সাধারণত মুখে লালা বেশি হওয়ার মত সমস্যা দেখা দেয়। এরকম হলে বুঝে শুনে কৃমির ওষুধ খাওয়া উচিৎ।
- ঘুমানোর আগে অন্তত এক গ্লাস জল পান করতে কখনো যেন ভুল না হয়। আর, ঘুমানোর আগে কখনোই মিষ্টি জাতীয় কোনো খাবার কিংবা পানীয় পান করবেন না, বরং ঘুমানোর ১০/১৫ মিনিট আগে একটু টক কিংবা লবন মিশ্রিত কিছু খেতে পারেন।
- দীর্ঘ বেশ কিছু বছর ধরে যদি করো অতিরিক্ত লালা নিঃসরণ হওয়ার সমস্যা থাকে তবে সেটা স্বাভাবিকও নয়। সম্ভবত সেই ব্যক্তির বিভিন্ন কারণে অধিক দুশ্চিন্তা থেকে অথবা কোনো ধরনের মানসিক অশান্তির জন্য এমনটা হতে পারে। তাই দুশ্চিন্তা মানসিক সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করুন।
- আমাদের সাইনুসাইটিস বা সেলাইভারি গ্ল্যান্ডে (যা থেকে মুখে লালা বা থুথু বের হয়) কোনো রোগ আছে কি না তা জানতে হবে, কারণ এই সব গ্রন্থিতে কোনো সমস্যা থাকলেও লালা পড়ার সমস্যা হতে পারে।
- মুখে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে আপনি দিনে দুবার অর্থাৎ সকালে ও রাতে খাওয়ার পর দাঁত ব্রাশ করবেন। ভালো একটি মাউথওয়াশ দিয়ে তিনবার গার্গল করবেন খাওয়ার আগে ও পরে।
- ডায়াবেটিস আছে এমন রোগীদের এবং আপনার পরিপাকতন্ত্রে অন্য কোনোও রোগ আছে কি না তা পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া উচিত, কারণ লালা পড়ার সমস্যার মধ্য দিয়ে অনেক সময় রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়।
- ধূমপান থেকে বিরত থাকা জরুরী, কারণ ধূমপান শুধু লালা জমা হওয়ার সমস্যাই নয় বরং আরো বহু সমস্যার জন্য দায়ী।
- আগেই বলা হয়েছে যে অতিরিক্ত মসলাযুক্ত, ঝাল এবং তৈলাক্ত ও চর্বিযুক্ত খাদ্য লালা উৎপাদন বৃদ্ধি করে, তাই যথা সম্ভব এইসব খাবার থেকে বিরত থাকা উচিত।
মুখে লালা পড়ার সমস্যার সমাধানে কিছু অভ্যাসের পরিবর্তন জরুরী, Some habit changes are necessary to solve the problem of salivation in the mouth
মুখে লালা জমা হওয়ার সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে হলে কিছু অভ্যাস নিয়মিত নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যথা:
- চিত হয়ে মাথা একটু উঁচু করে ঘুমানোর অভ্যাস করুন,
- নাকের কোনো সমস্যা থাকলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এর চিকিৎসা করুন,
- মুখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করতে হবে,
- স্লিপ অ্যাপনিয়া থাকলে চিকিৎসা করতে হবে,
- পর্যাপ্ত জল পান করার অভ্যাস রাখতে হবে,
- গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিডিটি বা অ্যালার্জির চিকিৎসা করা জরুরি।
- খাবার সময় ছাড়া অন্য সময় মুখে চুইনগাম রাখার চেষ্টা করুন। এতে আপনার মুখে লালা আসার পরিমাণটা কমে যাবে।
উপরিউক্ত অভ্যাসগুলো মেনে চললে লালা জমা হওয়ার সমস্যা কম হতে পারে, তবে প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে অতিরিক্ত লালা পড়ার সমস্যা নিয়ন্ত্রণের চিকিৎসা করাতে হবে।
শেষ কথা, Conclusion
মুখে লালা জমা হওয়ার সমস্যা অনেকেরই থাকে, অনেকের ক্ষেত্রে তো কথা বলতে গিয়েও মুখ থেকে থুতু ছিটকে বেরিয়ে এসে, ফলে সবার সামনে লজ্জিত বোধ হয়। কারও ক্ষেত্রে এটা কোনো রোগের লক্ষণ হতে পারে, আবার কারো ক্ষেত্রে বিভিন্ন অভ্যাসের কারণে সৃষ্ট সমস্যাও হতে পারে। তবে কারণ যাই হোক না কেনো, সমস্যার সমাধান করা সবচেয়ে জরুরি।
তাই আজকের এই প্রতিবেদনে মুখে অতিরিক্ত লালা জমা হওয়ার বা ঘুমের সময় মুখ থেকে লালা পড়ার সমস্যার সমাধানে কিছু উপায় বলে দেওয়া হল, আশা করি এই অভ্যাসগুলো নিয়মিত নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে আপনার সমস্যা সমাধান হবে।