আচমকা রাতের বেলা বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া—এমন পরিস্থিতি আপনার বা আপনার প্রিয়জনের সঙ্গে ঘটলে কী করবেন? অনেকেই আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়েন, কিন্তু ভয় না পেয়ে কিছু প্রাথমিক ধাপ জানা থাকলে রোগীর জীবন বাঁচানো সম্ভব।
হার্ট অ্যাটাক হলে হাসপাতালে পৌঁছনোর আগে রোগীর অবস্থা স্থিতিশীল রাখতে সিপিআর (CPR) বা কার্ডিয়াক পালমোনারি রিসাসিটেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেন্টার্স ফর ডিজ়িজ় কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (CDC) রিপোর্ট অনুযায়ী, হাসপাতালের বাইরে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হওয়া ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই মারা যান। কিন্তু সময়মতো সিপিআর দেওয়া গেলে রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা কয়েক গুণ বেড়ে যায়।
হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলো কীভাবে বুঝবেন?
অনেক সময় হার্ট অ্যাটাকের প্রাথমিক লক্ষণগুলো সাধারণ সমস্যার মতো মনে হতে পারে। তাই এই লক্ষণগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরি:
- শ্বাসকষ্ট: হঠাৎ করে তীব্র শ্বাসকষ্ট বা শ্বাস নিতে অসুবিধা হওয়া।
- অতিরিক্ত ঘাম: বিনা কারণে দরদর করে ঘাম হওয়া।
- বুকের ব্যথা: বুকের মাঝখানে তীব্র চাপ বা ব্যথা, যা ক্রমশ হাত, কাঁধ, পিঠ বা চোয়ালে ছড়িয়ে পড়ছে।
- জ্ঞান হারানো: হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
যদি এমন লক্ষণ দেখা যায়, তাহলে দেরি না করে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। চিকিৎসকদের মতে, প্রথমেই যদি হাতের কাছে অ্যাসপিরিন বা সরবিট্রেট জাতীয় ওষুধ থাকে, তাহলে তা রোগীকে দেওয়া যেতে পারে। এরপর পালস পরীক্ষা করে সিপিআর দেওয়া শুরু করা জরুরি।
সিপিআর দেওয়ার সঠিক পদ্ধতি:

সিপিআর দেওয়ার জন্য পূর্বপ্রশিক্ষণ থাকলে সবচেয়ে ভালো। তবে জরুরি পরিস্থিতিতে সঠিক পদ্ধতি জানা থাকলে প্রশিক্ষণ ছাড়াও জীবন বাঁচানো সম্ভব। নিচে ধাপে ধাপে সিপিআর দেওয়ার পদ্ধতি আলোচনা করা হলো:
- সঠিক স্থানে শোয়ানো: প্রথমে রোগীকে একটি সমতল ও শক্ত জায়গায় চিৎ করে শুইয়ে দিন। এতে বুকের উপর চাপ দিতে সুবিধা হবে।
- পালস পরীক্ষা: রোগীর ক্যারোটিড পালস (Carotid Pulse) পরীক্ষা করুন। গলার মাঝখানে অ্যাডামস অ্যাপেল (Adam’s Apple) বা শক্ত হাড়ের পাশে দুটি আঙুল রেখে নিচের দিকে নামান। যেখানে আঙুল পৌঁছাবে, সেখানেই ক্যারোটিড পালস থাকে। যদি সেখানে কোনো স্পন্দন না পান, তাহলে সিপিআর শুরু করুন।
- চেস্ট কমপ্রেশন শুরু: রোগীকে চিৎ করে শুইয়ে তার বুকের ঠিক মাঝখানে, অর্থাৎ দুটি স্তনের মাঝ বরাবর অংশটিতে চাপ দিতে হবে। এই চাপটি এমনভাবে দিতে হবে যাতে হৃৎপিণ্ড আবার সচল হতে পারে। একে ‘চেস্ট কমপ্রেশন’ (Chest Compression) বলা হয়।
- হাতের সঠিক অবস্থান: ডানহাতি ব্যক্তি হলে ডান হাতের তালুর নিচের অংশটি রোগীর বুকের উপর রাখুন। এর উপর অন্য হাতটি রাখুন এবং আঙুলগুলো একে অপরের সাথে জুড়ে নিন। কনুই না ভেঙে হাত সোজা রেখে রোগীর বুকে চাপ দিন।
- চাপের গভীরতা: বুকে চাপ এমনভাবে দিন যাতে বুকের খাঁচা ৫-৬ সেন্টিমিটার (২-২.৫ ইঞ্চি) নিচে যায়। এরপর হাত আবার ছেড়ে দিন যাতে বুকের খাঁচা আগের অবস্থায় ফিরে আসে। এই প্রক্রিয়াটি নিয়মিতভাবে চালিয়ে যেতে হবে।
- চাপের গতি: বুকের উপর চাপ দেওয়ার গতি এতটাই দ্রুত হতে হবে যাতে প্রতি মিনিটে ১০০-১২০ বার এই পদ্ধতিতে পাম্প করা যায়। একটানা ২-৫ মিনিট ধরে এই কমপ্রেশন চালিয়ে যেতে হবে।
- সময়সীমা: যদি ২-৫ মিনিট চেস্ট কমপ্রেশন করার পরেও রোগীর হৃৎস্পন্দন বা শ্বাসপ্রশ্বাস না ফেরে, তাহলে মোট ২০ মিনিট পর্যন্ত সিপিআর চালিয়ে যেতে পারেন। অ্যাম্বুলেন্স না আসা পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়া উচিত।
- শিশুদের সিপিআর: শিশুদের ক্ষেত্রে সিপিআর দেওয়ার পদ্ধতি কিছুটা ভিন্ন। ৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের বুকে অত চাপ দেওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে এক হাতে শিশুর নাক চেপে অন্য হাতে থুতনি উপরে তুলে ধরে মুখে মুখ লাগিয়ে জোরে জোরে বাতাস দিতে হবে (রেসকিউ ব্রেথ)। একই সাথে ৩০ বার কমপ্রেশন দেওয়া যেতে পারে। এতে শিশুর ফুসফুসে অক্সিজেন পৌঁছাবে এবং সংকটজনক মুহূর্তে শরীরে অক্সিজেনের প্রবাহ বজায় থাকবে।
মনে রাখবেন, যেকোনো জরুরি অবস্থায় আতঙ্কিত না হয়ে সঠিক পদক্ষেপ নিলে হয়তো আপনি কারও জীবন বাঁচাতে পারবেন। এই প্রাথমিক জ্ঞানটুকু আপনাকে বা আপনার প্রিয়জনের জীবন রক্ষায় সাহায্য করতে পারে।