আজকাল খবরের কাগজে বা বিভিন্ন নিউজ দেখা যায় বহু মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন, তাও অনেক কম বয়সে। তবে বয়স কম হোক কিংবা ষাট ঊর্ধ্ব কেউ হোক না কেন, বর্তমানে মানুষের জীবনযাপনের ধরন অস্বাস্থ্যকর হওয়ার কারণে রোগের বালাই বেড়ে চলেছে। এমন বহু সাধারণ সমস্যা আছে যেগুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার কারণে সৃষ্টি হচ্ছে বড় কোনো রোগজনিত সমস্যা। এমনই একটি সাধারণ সমস্যা হল উচ্চ রক্তচাপ বা হাই প্রেসার।
এই সমস্যাটি প্রায় সকলের ঘরেই আছে। কিন্তু স্বাভাবিক থাকা অবস্থায় সঠিক যত্ন না নিলে উচ্চ রক্তচাপই মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা উচ্চ রক্তচাপ বা হাই প্রেসার কমানোর উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
উচ্চ রক্তচাপ কি? What is high blood pressure?
উচ্চ রক্তচাপ দেহের এমন একটি অবস্থা যেখানে আমাদের ধমনীর দেয়ালের বিরুদ্ধে রক্ত প্রবাহের শক্তি খুব বেশি থাকে। উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা সাধারণত রক্তের চাপ ১৪০/৯০ এবং ১৮০/১২০ এর উপরে হয়ে গেলে গুরুতর বলে বিবেচিত হয়। উচ্চ রক্তচাপ হল মানব দেহের একটি জটিল শারীরিক সমস্যা যা বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষত যকৃত, হৃদপিণ্ড, চোখ ও কিডনির সমস্যা দেখা দেয় উচ্চ রক্তচাপের প্রভাবে।
কী কারণে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে, Causes of high blood pressure
বেশিরভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই উচ্চ রক্তচাপের কোনো নির্দিষ্ট কারণ পরিলক্ষিত হয় না, একে বলে প্রাইমারি বা অ্যাসেন্সিয়াল রক্তচাপ। তবে দৈনন্দিন জীবনের কিছু কিছু অভ্যাস উচ্চ রক্তচাপের আশঙ্কা বাড়ায়, সেগুলি হল:
বংশানুক্রমিক সমস্যা
উচ্চ রক্তচাপের ক্ষেত্রে বংশগত ধারাবাহিকতা আছে, যদি বাবা বা মায়ের উচ্চ রক্তচাপ থাকে, তবে সন্তানের মধ্যও উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
ধূমপান করার ফলে
যারা ধূমপান করেন তাদের শরীরে তামাকের নানারকম বিষাক্ত পদার্থের বিষক্রিয়ার ফলে উচ্চ রক্তচাপ সহ ধমনি ও শিরার নানা ধরনের রোগ তথা হৃদরাগ দেখা দিতে পারে।
অতিরিক্ত লবণ খাওয়ার কারণে :
আমাদের খাবার তৈরীতে যে লবণ ব্যবহৃত হয় তাতে সোডিয়াম থাকে, যা রক্তের জলীয় অংশ বৃদ্ধি করে দেয়, ফলে দেহে রক্তের আয়তন বেড়ে যায় এবং সেই সঙ্গে রক্তচাপও বেড়ে যায়।
অধিক ওজন এবং অলস জীবনযাপনের কারণে :
যথেষ্ট পরিমাণে শরীরচর্চা ও শারীরিক পরিশ্রম না করার কারণে অনেকেরই শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার সমস্যা দেখা যায়, যার ফলে হৃদযন্ত্রকে স্বাভাবিকের তুলনায় কিছু অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয় এবং এর ফলস্বরূপ অধিক ওজন সম্পন্ন লোকদের ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা হয়ে থাকে।
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস থাকলে :
মাংস, মাখন ও ডুবোতেলে ভাজা খাবারের মত অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার খেলে ওজন বেড়ে যায় এবং শারীরিক অন্য সমস্যাও দেখা যায়। অন্যদিকে ডিমের হলুদ অংশ এবং মাংসের কলিজা, মগজ, গুর্দা এসব খেলে আমাদের রক্তে কলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়। অতিরিক্ত কলেস্টেরলের ফলে রক্তনালির দেয়াল মোটা এবং শক্ত হয়ে যায়, যার ফলে রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
অতিরিক্ত মদ পান করার ফলে:
যারা নিয়মিতভাবে অত্যধিক মাত্রায় মদপান করে থাকেন, তাদের উচ্চ রক্তচাপের সমস্যাও বেশি হয়।
ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হলে :
বয়স বাড়ার সাথে ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যেও উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা দেখা দেয়।
বিভিন্ন কারণে অতিরিক্ত উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হলে :
কোনো বিষয় নিয়ে ভীতি, অতিরিক্ত রাগ, উত্তেজনা এবং মানসিক চাপের কারণবশতও রক্তচাপ সাময়িকভাবে বেড়ে যেতে পারে। তাছাড়া অনেক সময় অন্য কোনো রোগের প্রভাবেও উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। যেমন : অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি ও পিটুইটারি গ্রন্থির টিউমার, কিডনির রোগ, জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ির ব্যবহার, ব্যথানাশক কিছু কিছু ওষুধ খেলে অথবা স্টেরয়েডজাতীয় হরমোন গ্রহণ করলে ।
উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কম করতে কী করা উচিত, What is the way to reduce high pressure
আমরা আমাদের সাধারণ জীবনযাত্রার মধ্যে কিছু পরিবর্তন আনার মাধ্যমেই উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কম করে নিতে পারি। যেমন :
অতিরিক্ত ওজন কম করতে হবে :
নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে এবং খাওয়া-দাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বয়স অনুপাতে সঠিক ওজন নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে হবে, সঠিক ওজন বজায় রাখতে সীমিত আহার গ্রহণ এবং ব্যায়াম অব্যাহত রাখতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনোও ধরনের ওষুধ খেয়ে ওজন কমানো বিপজ্জনক, সেটা না করাই ভালো।
খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্কতা :
কম চর্বি এবং কম কলেস্টেরলযুক্ত স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করতে হবে। যেমন- খাসি বা গরুর মাংস, ডিম ইত্যাদি কম খেতে হবে। বেশি আঁশযুক্ত খাবার যেমন সবজি গ্রহণ করা উচিত।
লবণ খাওয়া নিয়ন্ত্রণ :
রান্নার সময় তরকারিতে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় লবণের বাইরে অতিরিক্ত লবণ পরিহার করতে হবে।
মদ্য পান ও ধূমপান বর্জন :
মদ পান করা পরিহার করতে হবে। মদ ও ধূমপান দুই থেকেই বিরত থাকা উচিত।
নিয়মিত ব্যায়াম করা উচিত :
সকাল ও সন্ধ্যা অল্প কিছুক্ষণ হাঁটাচলার অভ্যাস রাখা উচিত, সম্ভব হলে দৌড়তেও পারেন, তাছাড়া ঘুম থেকে উঠে হালকা ব্যায়াম করা এবং লিফটে না চড়ে সিঁড়ি ব্যবহার ইত্যাদি কিছু শারীরিক পরিশ্রম নিত্যদিন করা উচিত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কিছু কিছু যোগআসন রয়েছে যা তাৎক্ষণিকভাবে উচ্চ রক্তচাপ কম করতে সাহায্য করে। নিয়ম করে কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন যোগ আসন করলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু হাইপারটেনসিভ সংকট এড়াতে হলে অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নিয়ে শরীরচর্চা শুরু করতে হবে।
পশ্চিমোত্তানাসন করার নিয়ম :
এই আসন করার জন্য-
- প্রথমে নিজের পা দুটো সামনের দিকে ছড়িয়ে নিয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে বসুন।
- এরপর মাথার উপর দিকে নিজের হাত দুটো নমস্কারের ভঙ্গিতে সোজা করে প্রসারিত করতে হবে।
- অতঃপর নিজের শরীরটা বেঁকিয়ে নিয়ে হাত দুটোকে পা পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে, তবে পা যেন না বেঁকে যায় সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- এই অবস্থায় হাত দুটোর সাহায্যে পায়ের গোড়ালি স্পর্শ করতে হবে। এবার পায়ের উপর মাথা রেখে দিন। কিছুক্ষণ এভাবে রাখার পর দু’টো হাতকে আবার আগের মত মাথা পর্যন্ত প্রসারিত করে নিতে হবে।
- তারপর প্রথমে যে ভঙ্গিতে বসেছিলেন সেই ভাবে বসতে হবে।
- এই ব্যায়ামটি ওজন কম করার পাশাপাশি পেটের নিচের অংশের মেদ ঝরাতেও সহায়তা করে।
বজ্রাসন করার নিয়ম:
অতি সহজ এই আসনটি করার জন্য-
- প্রথমে নিজের শিড়দাঁড়া সোজা করে বসতে হবে। তারপর পা দুটো সামনের দিকে ছড়িয়ে দিন।
- মনে রাখতে হবে, গোড়ালি ও শিরদাঁড়া সোজা থাকা বাঞ্ছনীয়।
- এরপর হাত দু’টি নিজের উরুর উপরে সোজা করে রেখে দিতে হবে।
- এইবার একটা একটা করে দুই পায়ের হাঁটু মুড়ে তার উপরে বসে থাকুন।
- গোড়ালি ফাঁক করে রেখে বসতে হবে এবং হাঁটু দু’টি পাশাপাশি জোড় করে রাখতে হবে।
- দু’ হাত এবার দু’ হাঁটুর ওপর রেখে দিতে হবে। এরপর শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক রেখে ৩০ সেকেন্ড থেকে দু’ মিনিট মত সময় থাকুন।
- শরীরে থাকা অতিরিক্ত মেদ হতে মুক্তি পেতে এবং দেহে রক্তসঞ্চালন স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে এই আসন।
শিশু আসন করার নিয়ম:
এই আসন করার জন্য-
- প্রথমে মেঝেতে বসতে হবে।
- এবার দুই পায়ের হাঁটু মুড়ে পায়ের গোড়ালির উপর বসতে হবে। গোড়ালি ফাঁক করে রাখতে হবে এবং হাঁটু দুটো একসাথে লাগিয়ে রাখতে হবে।
- এবার আস্তে আস্তে সামনের দিকে ঝুঁকে কপাল মাটিতে ঠেকান।
- তারপর নিজের হাত দু’টোকে পিছনদিকে নিয়ে গিয়ে তালু দুটো উল্টো করে পায়ের পাশে রাখুন। এই ভঙ্গিতে থেকে ১-১০ পর্যন্ত গুণতে থাকুন।
- বিশেষজ্ঞদের মত অনুযায়ী, এই আসনটি মানসিক চাপ এবং ক্লান্তি কম করতে সহায়তা করে । তাছাড়া দেহে রক্তসঞ্চালনের প্রক্রিয়াও স্বাভাবিক রাখে।
সুখাসন করার নিয়ম:
এই আসন করতে হলে –
- প্রথমে ধ্যানের ভঙ্গিতে বসতে হবে।
- শিরদাঁড়া সোজা রাখা বাঞ্ছনীয়। এরপর স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস চালিয়ে যান।
- এভাবে ৫ মিনিট বসে থাকুন।
- এই আসনটি উচ্চ রক্তচাপ কম করতে সহায়তা করে।
- এই যোগব্যায়ামের প্রভাবে শরীর এবং মনের সার্বিক ভারসাম্য নিয়ন্ত্রিত থাকে, ফলে মন ও মেজাজ ভালো থাকে।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে কী খাবেন / কী খাবেন না ? What to eat / what not to eat to control high blood pressure?
- কোলেস্টেরল বৃদ্ধিকারী এবং চর্বি যুক্ত খাবার যেমন – নারিকেল, ডিমের কুসুম, মাছের ডিম, হাঁস-মুরগীর চামড়া, খাসি বা গরুর চর্বিযুক্ত মাংস, কলিজা, হাড়ের মজ্জা, ঘি, ডালডা, মাখন, মার্জারিন, গলদা চিংড়ি এসব খাবার এড়িয়ে যাওয়া উচিত।
- পরিমিত পরিমানে খাবেন যেসব খাবার
- শর্করা জাতীয় খাবার যেমন ভাত, রুটি, আলু ইত্যাদি কম খেতে হবে।
- মিষ্টি জাতীয় বিভিন্ন ফলসমুহ, যেমন- পাকা পেঁপে, পাকা আম, পাকা কলা ইত্যাদি।
- দুধ ও দুধের তৈরী খাবার।
- যেসব খাবার একেবারেই খাওয়া অনুচিত
- পাতে অতিরিক্ত লবন খাওয়া উচিত নয়, তাছাড়া নোনতা খাবার পরিহার করতে হবে।
- বিভিন্ন রকম ফাস্ট ফুড, পুডিং, কেক, আইসক্রিম ছাড়াও বোতল জাত কোমল পানীয়গুলো না খাওয়াই উত্তম।
উপসংহার, Conclusion
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট যে আমাদের খাদ্যাভাস এবং জীবনযাপনের ধরন পরিবর্তনই উচ্চ রক্তচাপ নিরাময় করার মূল চাবিকাঠি। খাবারের ক্ষেত্রে সচেতনতা অবলম্বন করে এবং শরীরচর্চার মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন বেছে নিতে হবে, তাছাড়া যতটুকু সম্ভব দুশ্চিন্তা থেকে দূরে থাকতে হবে, এতে অনেকটাই সমস্যা কম হয়ে যেতে পারে।