পৃথিবীতে দিনের পর দিন দূষণ বেড়েই চলেছে, তাই বর্তমান বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ নাজেহাল হচ্ছেন বিভিন্ন রোগে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি রোগ হল হাঁপানি। উক্ত হাঁপানি রোগ সাধারণত এক বার হলে সারা জীবনেও সম্পূর্ণভাবে সারে না। তবে হাঁপানির কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে নানা জায়গায় নানা ধরনের টোটকা ব্যবহার করা হয়। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা হাঁপানি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো এবং হাঁপানি থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়ও বলে দেবো।
হাঁপানি কি? What is Asthma?
ডাক্তারি ব্যাখ্যায় বলতে গেলে হাঁপানি হল শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত একটি রোগ এবং এই রোগ সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি হয়। শ্বাসতন্ত্রে প্রদাহ হওয়ার কারণে শ্বাসনালি ফুলে যায়। এরপর দেখা দেয় শ্বাসকষ্ট, কাশি, বুকের মধ্যে শোঁ শোঁ শব্দ ইত্যাদি সমস্যা, কারও ক্ষেত্রে বুকে চাপ পড়া ইত্যাদি উপসর্গও দেখা দিতে থাকে। এসব সমস্যা সমন্বিত রোগের নামই হাঁপানি।
হাঁপানি কেন হয় ? Why does asthma occur?
হাঁপানির কারণ কখনো সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তবে কিছু নির্দিষ্ট বিষয় রয়েছে, যেগুলো হাঁপানি রোগের উৎপত্তি ও স্থায়িত্বের জন্য দায়ী। সেগুলি হল :
- * জেনেটিক বা বংশগত কারণে এ রোগ হতে পারে; অর্থাৎ বংশে যদি কারও এ রোগ থাকে তবে পরবর্তী প্রজন্মের যেকোনো কেউ এই সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
- * কোনো পশুর লোম, আরশোলা, ফুলের রেণু, ছত্রাক প্রভৃতিও হাঁপানির সমস্যা সৃষ্টির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
- * সিগারেটের ধোঁয়া, বায়ুদূষণ, কারখানার বিভিন্ন উত্তেজক পদার্থ দহন, রঙের ঝাঁঝালো গন্ধ, ঠান্ডা হাওয়া, ঝাঁঝালো মসলার গন্ধ প্রভৃতির প্রভাবে হাঁপানির আশঙ্কা বেড়ে যায়।
- * বিভিন্ন ব্যথানাশক ওষুধের পার্শ্বপ্রতক্রিয়া, অ্যাসপিরিন, হেরোইন প্রভৃতির অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে হাঁপানি হতে পারে।
- * অতিরিক্ত আবেগপ্রবণতা ও মানসিক চাপ অনেক ক্ষেত্রে হাঁপানির তীব্রতা বাড়াতে পারে।
- * শিশু বয়সে সাধারণত ছেলেদের এই রোগ হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর এ রোগ বেশি হয়।
- * কারও কারও ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু খাবার, যেমন গরুর মাংস, চিংড়ি, ইলিশ, বেগুন—ইত্যাদি খেলে হাঁপানির মাত্রা বেড়ে যেতে পারে।
হাঁপানি রোগের লক্ষণসমূহ, Symptoms of Asthma
ব্যক্তিবিশেষে হাঁপানি রোগের লক্ষণ ভিন্ন হতে পারে। তবে সাধারণত যে সব লক্ষণ এই রোগের রোগীদের ক্ষেত্রে দেখা যায় সেগুলি হল:
- * দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা।
- * ঋতু পরিবর্তনের সাথে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়া।
- * হঠাৎ করেই বুকে চাপ অনুভূত হওয়া।
- * কাশি বা শুকনো কাশি।
- * শ্বাসপ্রশ্বাসের সময় বুকে সাঁ সাঁ শব্দ হওয়া।
- * দমবন্ধ অনুভব করা।
- * নাকে-মুখে ধুলোবালি গেলে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়া।
হাঁপানির বিভিন্ন সমস্যা নির্ণয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, Tests to diagnose various asthma problems
হাঁপানি রোগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে রোগীর চিকিৎসার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সেই অনুযায়ী ঔষধ দেওয়া হয়। হাঁপানির বিভিন্ন সমস্যা নির্ণয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো হল :
- * স্পাইরোমেট্রি বা পিক ফ্লো মেট্রি পরীক্ষা: রোগীর শ্বাসনালিতে শ্বাস গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা সৃষ্টি হচ্ছে কি না, তা নির্ণয়ের জন্য এটি করা হয়।
- * মেথাকলিন চ্যালেঞ্জ পরীক্ষা: শ্বাসনালির অতি সংবেদনশীলতা এর মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয়।
- * রক্ত ও কফ পরীক্ষা: রক্ত ও কফে ইয়োসিনোফিল সিরাম আইজিইয়ের মাত্রা বেশি কি না, তা নির্ণয় করতে এই পরীক্ষা করা হয়।
- * স্কিন প্রিক টেস্ট: অ্যালার্জেন পরীক্ষার জন্য এ টেস্ট করা হয়।
হাঁপানির চিকিৎসা, Treatment of Asthma
হাঁপানি রোগের চিকিৎসা করার জন্য চিকিৎসকরা সাধারণত যেসব ঔষধের ব্যবহার করে থাকেন সেগুলি হল :
- * হাঁপানির সমস্যা উপশমকারী সালবিউটামল-জাতীয় ওষুধ যা তাৎক্ষণিকভাবে শ্বাসনালির ছিদ্রপথ প্রসারিত করে দেয় এবং শ্বাসপ্রশ্বাসের বাধা কমিয়ে দেয়।
- * হাঁপানির সমস্যা উপশমে স্টেরয়েড, অ্যামাইনোফাইলিন, ক্রোমগ্লাইকেট ইত্যাদি প্রতিরোধক ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
- * হাঁপানির চিকিৎসায় নেবুলাইজারের ব্যবহার হয়ে থাকে যা বেশ ফলপ্রসূ। হাঁপানির মাত্রা তীব্র হলে উক্ত পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। তবে ব্যবহারের পূর্বে নেবুলাইজার যথাযথভাবে জীবাণুমুক্ত করে রাখা জরুরি।
- * অনেক সময় হাঁপানির আক্রমণ ঠেকাতে শিরায় স্টেরয়েডের ইনজেকশন দেওয়া হয়।
- তবে উপরিউক্ত কোনো ওষুধ বা পদ্ধতি চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া খাওয়া বা ব্যবহার করা উচিত নয়। কারণ রোগীর অবস্থা বুঝে ডাক্তাররা এইসব চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকেন।
হাঁপানির চিকিৎসায় ইনহেলারের ভূমিকা, Role of inhalers in the treatment of asthma
হাঁপানির চিকিৎসায় ইনহেলার সবচেয়ে উপকারী এবং আধুনিক পদ্ধতি হিসেবে গণ্য হয়। এতে খুব অল্প মাত্রার ওষুধ প্রয়োগ করেই ভালো ফল পাওয়া যায়। খুব একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও হয় না। সবচেয়ে সুলভ ও বহুল ব্যবহৃত ইনহেলারটি হচ্ছে এমডিআই বা মিটার্ড ডোজ ইনহেলার। এখানে ওষুধের তরল ক্ষুদ্র কণা (১-৫ মাইক্রোমিটার) অ্যারোসল আকারে ফুসফুসে প্রয়োগ করা যায়।
হাঁপানি রোগের ঘরোয়া প্রতিকার সম্পর্কে জেনে নিন, Learn about home remedies for asthma
আমাদের পরিচিত ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই হয়তো এমন আছেন যারা প্রায় সারা বছর হাঁপানিতে ভোগেন। আবার অনেকের ক্ষেত্রে ঋতু পরিবর্তনের সময় এই রোগের প্রভাব বেশি থাকে। সেক্ষেত্রে ঘরোয়া কিছু উপায় অবলম্বন করে হাঁপানি থেকে সাময়িক মুক্তি পাওয়ার সহজ হয়ে উঠবে। সেগুলো হল :
হাঁপানির প্রকোপ কম করতে পেঁয়াজের ব্যবহার, Use of onions to reduce the incidence of asthma
পেঁয়াজ যে কোনো প্রদাহজনিত রোগ উপশম করার ক্ষেত্রে খুবই উপকারি উপাদান হিসেবে পরিচিত। তাছাড়া এটি আমাদের নাসাপথকে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। শ্বাসকষ্ট দূর করার জন্য একটি কাটা পেঁয়াজ খেয়ে দেখুন।
হাঁপানির প্রকোপ কম করতে লেবুর ভূমিকা, The role of lemon in reducing the incidence of asthma
আমরা সকলেই জানি যে লেবুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন C এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। উক্ত উপাদানগুলো আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় তথা উপকারী। এক গ্লাস জলের মধ্যে লেবুর রস এবং সামান্য চিনি দিয়ে রোজ খেয়ে দেখতে পারেন। হাঁপানির কষ্ট স্বাভাবিকভাবে অনেক কম অনুভব হবে।
হাঁপানির প্রতিকারে ল্যাভেন্ডার তেলের ব্যবহার, Use of lavender oil to treat asthma
হাঁপানি নিরাময়ে ল্যাভেন্ডার তেল খুব উপকারী। গরম জলের মধ্যে ৫-৬ ফোঁটা ল্যাভেন্ডার তেল মিশিয়ে নিন। এবার ধীরে ধীরে এই জল দিয়ে ভাপ নিন। হাঁপানির প্রকোপ কম করতে এটি ম্যাজিকের মতো কাজ করবে।
হাঁপানির প্রকোপ কম করতে মধুর ব্যবহার, Use of honey to reduce the incidence of asthma
প্রাচীনকাল থেকেই কাশি সহ হাঁপানি নিরাময়ের অন্যতম টোটকা হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে মধু। বিশেষজ্ঞদের মতে, রোজ রাতে ঘুমানোর আগে এক চামচ মধুর সঙ্গে দারুচিনি গুঁড়ো মিশিয়ে খেতে পারেন। এতে শ্বাসকষ্ট কমে যায়। সর্দি-কাশিতেও এটি অনেক আরাম দেয়।
হাঁপানির প্রতিকারে আদার ব্যবহার, Use of ginger to treat asthma
জ্বর, সর্দি-কাশি সহ আরো বিভিন্ন রোগেই সমান উপকারি আদার রস। তবে অনেকেই হয়তো জানতেন না যে এটি হাঁপানির প্রকোপ কম করার ক্ষেত্রেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে। জলের মধ্যে এক টুকরো আদা দিয়ে ফুটিয়ে নিন। এবার একটি গ্লাস বা কাপে নামিয়ে পাঁচ মিনিট রেখে সেই মিশ্রণ খেয়ে নিন।
হাঁপানির প্রকোপ কম করতে রসুনের ব্যবহার, Use of garlic to reduce the incidence of asthma
হাঁপানির প্রকোপ কম করতে এক কাপ দুধের মধ্যে ৩-৪ কোয়া রসুন ফেলে ফুটিয়ে নিন। এবার সেই মিশ্রণ পান করুন। শুধু হাঁপানির সমস্যা নয় ফুসফুসের যে কোনো রোগ নিরাময়ে রসুনের রস খুবই উপকারি।
হাঁপানির প্রতিকারে কফির ভূমিকা, The role of coffee in the treatment of asthma
কফিকে হাঁপানির কষ্ট নিরাময়ে খুবই নির্ভরযোগ্য পানীয় হিসেবে ধরা হয়। এক কাপ গরম কফি শ্বাসনালীর প্রদাহ কম করতে সহায়তা করে। পাশাপাশি শরীরে এনার্জি যোগায়।
এছাড়াও ত্রিফলা দেওয়া চা বা কফি খেতে পারেন; রোজ এক টুকরো কাঁচা হলুদ খেতে পারেন, কারণ হলুদে প্রদাহ কম করার ক্ষমতা আছে; তেলে কর্পূর গরম করে, তা বুকে মালিশ করা যেতে পারে। ঘরোয়া এসব উপাদান আপনাকে এই সমস্যা থেকে সাময়িকভাবে মুক্তি দিতে পারে। তবে সমস্যা জটিল হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
হাঁপানি সম্পর্কে জেনে রাখুন, Know in details about asthma
- * শ্বাসকষ্ট মানেই যে হাঁপানি, তা নয়; বরং হৃদ্রোগ, রক্তশূন্যতা প্রভৃতি সহ আরো বিভিন্ন কারণেও শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
- * হাঁপানি কোনোও ছোঁয়াচে রোগ নয়। তবে বংশগতভাবে হতে পারে।
- * পৃথিবীতে প্রায় ২৪ কোটি লোক হাঁপানি রোগে আক্রান্ত। প্রতিবছর প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ হাঁপানির কারণে মারা যায়।
শেষ কথা, Conclusion
হাঁপানি সমস্যা হঠাৎ করেই বেড়ে উঠতে পারে। তবে নিয়মিত নিজের প্রতি যত্ন নিলে হয়তো এই সমস্যার প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়া সহজ হবে। সমস্যা বেশি হলে উপরোক্ত ঘরোয়া প্রতিকার ব্যবহার করে হাঁপানির প্রকোপ কম করার চেষ্টা করতে পারেন, তবে প্রয়োজনে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।