আজকাল বেশিরভাগ মেয়ে বা মহিলারা পিরিয়ড বা মাসিক অনিয়মিত হওয়ার সমস্যায় ভোগেন। অনিয়মিত পিরিয়ড বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। যেমন- অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা, ক্যাফেইন জাতীয় খাবার অতিরিক্ত গ্রহণ, যেমন অতিরিক্ত কফি পান করা, স্ট্রেস নেওয়া, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করা, অপরিচ্ছন্ন থাকা, মদ্যপান বা ধূমপান করা ইত্যাদি।
অনিয়মিত পিরিয়ড কি, What is meant by irregular Periods in Women?
যদি আপনার মাসিক ঋতুস্রাবের মধ্যে সাধারণ ব্যবধান না থেকে বরং প্রতি মাসে সময়ের পরিবর্তন হতে থাকে তবে আপনার বুঝতে হবে যে আপনি অনিয়মিত মাসিক এর সমস্যায় ভুগছেন। যদিও সাধারণভাবে পিরিয়ড একটু তাড়াতাড়ি বা দেরিতে হওয়া স্বাভাবিক বলেই ধরা হয়, কিন্তু এক্ষেত্রে বেশি দেরি হলে সেটা অনিয়ম বলেই ধরা হয়, আবার সময়ের থেকে আগে হলে সেটাও অনিয়ম হিসেবেই গণ্য। তাই এরূপ কোনো অনিয়ম দেখা দিলে ঘরোয়াভাবে চিকিৎসা করা উচিত অথবা ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত।
অনিয়মিত মাসিক হওয়ার কারণগুলো কি কি, Causes of irregular periods
অনিয়মিত মাসিকের অনেক কারণ রয়েছে, যার মধ্যে প্রধান কারণগুলো হল :
দেহের প্রাকৃতিক হরমোনের পরিবর্তন :
আমাদের দেহে বেশ কিছু হরমোন থাকে যা আমাদের দৈহিক পরিবর্তন তথা আরো বিভিন্ন বিষয়ের জন্য প্রয়োজনীয়। মেয়েদের মাসিক চক্র নিয়ন্ত্রণকারী প্রধান হরমোনগুলি হল ফলিকল-স্টিমুলেটিং হরমোন, প্রোজেস্টেরন এবং ইস্ট্রোজেন।
এই প্রাকৃতিক হরমোনের পরিবর্তনের কারণে অনিয়মিত মাসিক হতে পারে। তাছাড়া এই হরমোনগুলির স্বাভাবিক উত্থান এবং পতনের ক্ষেত্রে যদি কোনও ব্যাঘাত হয় তবে এর ফল স্বরূপ অনিয়মিত পিরিয়ড হতে পারে। হরমোনের স্বাভাবিক মাত্রা পরিবর্তন করতে পারে এমন কিছু কারণ হল : ওজন বৃদ্ধি বা অতিরিক্ত ওজন হ্রাস, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ইত্যাদি। তাছাড়াও আছে, প্রারম্ভিক গর্ভাবস্থা, বয়: সন্ধিকালে, প্রয়োজনের তুলনায় অত্যধিক ব্যায়াম ইত্যাদি।
জন্মনিয়ন্ত্রণ :
অনিয়মিত মাসিকের অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হয় মৌখিক গর্ভনিরোধককে। গর্ভনিরোধক বড়ি ডিম্বস্ফোটন হ্রাস বা বন্ধ করে দিতে গর্ভাবস্থা প্রতিরোধ করে। যারা জন্ম নিয়ন্ত্রণ ব্যবহার করে তাদের মাসিক হয় না। মূলত তাদের
জন্ম নিয়ন্ত্রণ হওয়ার কারণে রক্তপাত অনুভব হয়, তবে অনেকেই একে ঋতুস্রাব বলে ভুল করেন। এক্ষেত্রে জরায়ুর আস্তরণ থেকে কিছু শ্লেষ্মা এবং রক্ত যোনিপথে প্রবাহিত হয়। এই রক্তপাত সাধারণত কয়েক দিন বা অনেকের ক্ষেত্রে এক সপ্তাহ স্থায়ী হয়। তাই যদি কারো আগে থেকেই অনিয়মিত মাসিকের সমস্যা থাকে তবে তাদের গর্ভনিরোধক ব্যবহার না করাই উচিত।
অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্য সমস্যা :
কখনও কখনও মহিলাদের অনিয়মিত পিরিয়ড অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্যের অবস্থারও ইঙ্গিত দেয়, যেমন: পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS); খাবারের কারণে সৃষ্ট ব্যাধি, থাইরয়েড রোগ, অকাল ডিম্বাশয় ব্যর্থতা বা পিওএফ, হাইপারপ্রোল্যাক্টিনেমিয়া অর্থাৎ প্রোল্যাক্টিন প্রোটিনের মাত্রা অত্যধিক হয়ে যাওয়া, ইত্যাদি অনিয়মিত পিরিয়ডের অন্যতম কারণ।
অনিয়মিত মাসিকের চিকিৎসা, Treatment for irregular periods
আপনার অনিয়মিত মাসিকের সমস্যা যদি ক্রমাগত লেগে থাকে এবং আপনার বয়স ৪০ বছরেরও কম হয়, তবে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের সাথে দেখা করা উচিত, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী এই সমস্যার চিকিৎসা করা উচিত। অনিয়মিত মাসিকের ক্ষেত্রে সাধারণত যেসব চিকিৎসা করা হয় সেগুলো হল :
হরমোন থেরাপি:
এই থেরাপিটি সাধারণত পিসিওএস লক্ষণগুলোর হিসেবে পরিচালনা করা হয়। তবে এর জন্য ডাক্তারদের দ্বারা সুপারিশ থাকা অত্যন্ত আবশ্যক।
পুষ্টির থেরাপি:
একজন ডায়েটিশিয়ান বা ডাক্তারের থেকে উপযুক্ত পুষ্টির থেরাপির পরামর্শ নিয়ে সঠিকভাবে সেই ডায়েট অনুসরণ করতে হবে। যদি কারো অনিয়মিত মাসিকের সমস্যা খাওয়ার ব্যাধির কারণে হতে থাকে তবে এই থেরাপির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হতে পারে।
মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে হবে:
কোনো কারণে স্ট্রেস বা বিষণ্নতা থাকলে এবং উদ্বেগের ফলস্বরূপ পিরিয়ড অনিয়মিত হতে পারে, তাই মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখা খুবই জরুরি। এসব ছাড়াও জীবনধারণের কিছু পরিবর্তন এবং ঘরোয়া প্রতিকারের মাধ্যমে আপনি অনিয়মিত পিরিয়ড থেকে রক্ষা পারেন, সেগুলি হল :
স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা।
ডায়েটে দারুচিনি এবং আদা যোগ করুন।
পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি গ্রহণ ইত্যাদি সাধারণ কিছু বিষয় মেনে চললে মাসিকের সমস্যা ছাড়া আরো বহু রোগ থেকে দূরে থাকা যায়। তাছাড়া আরো একটা বিষয় মনে রাখা উচিত যে শরীরে আয়রনের ঘাটতি থাকলেও অনিয়মিত মাসিকের সমস্যা হতে পারে। তাই আয়রন বা লৌহসমৃদ্ধ খাবার, যেমন- মুরগীর মাংস, চিংড়ি, ডিম, কচুর শাক, লাল শাক, পালং শাক, মিষ্টি আলু, তরমুজ, খেজুর, টমেটো, ডাল, ভুট্টা, শস্যদানা ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে খেতে হবে।
অনিয়মিত মাসিকের ঘরোয়া সমাধানের উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা, Home remedies for irregular periods
যে কোনো বয়সের নারীদেরই অনিয়মিত মাসিকের সমস্যা হতে পারে। সেক্ষেত্রে যেসব ঘরোয়া প্রতিকার সম্ভব সেগুলি হল :
কাঁচা পেপে:
পর পর কয়েক মাস নিয়মিত কাঁচা পেপের রস খেলে পিরিয়ড নিয়মিত হয়, তবে পিরিয়ড চলাকালীন এটি না খাওয়াই ভালো।
কাঁচা হলুদ:
হলুদ মসলা জাতীয় দ্রব্য হলেও এটি পিরিয়ড নিয়মিত করতে এবং শরীরে হরমোন ব্যাল্যান্স ঠিক রাখতে সহায়তা করে। তাছাড়াও কাঁচা হলুদ জরায়ুর মাংসপেশীর সঙ্কোচন-প্রসারণ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। অন্যদিকে এর অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি গুণ পিরিয়ড-চলাকালীন বা এর আগে হওয়া ব্যথা কম করতে সাহায্য করে। তাই এক কাপ দুধে কাঁচা হলুদের চা চামচের চার ভাগের এক ভাগ এর মত টুকরো থেঁতো করে নিয়ে মধু বা গুড় দিয়ে কিছুদিন নিয়মিত খেয়ে দেখুন, মাসিকের সমস্যার পরিবর্তন নিজেই টের পাবেন।
অ্যালোভেরার সেবন :
অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারীর শাঁস মাসিক নিয়মিত করতে ও হরমোন রেগুলেশন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে অ্যালোভেরা পাতার শাঁস সামান্য মধুর সাথে মিশিয়ে খান, ভালো ফলাফল পাবেন।
জিরা:
মাসিক নিয়মিত করতে জিরা অনেক উপযোগী, কারণ এর কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে না। এক গ্লাস জল নিয়ে তাতে ২ চা চামচ জিরা দিয়ে সারারাত ভিজিয়ে রাখুন। সকালে এই জল নিয়মিত সেবন করে দেখুন, সুফল পাবেন।
দারুচিনি:
অনিয়মিত পিরিয়ড দূর করতে চা বা লেবুর রসের সাথে দারুচিনি গুড়া করে মিশিয়ে খেতে পারেন। এটি পিরিয়ড নিয়মিত করার পাশাপাশি পিরিয়ড চলাকালীন ব্যথাও কম করতে সাহায্য করে।
ফল ও সবজির জুস:
খাদ্য তালিকায় অবশ্যই ফল ও সবজির জুস রাখুন। ফলের রস শরীর ঠাণ্ডা রাখে এবং হরমোন নিয়ন্ত্রণ-এ সাহায্য করে। তবে পিরিয়ড নিয়মিত করতে গাজর এবং আঙুরের রসই সব থেকে বেশি কার্যকরী।
যোগ ব্যায়াম এবং মেডিটেশন:
মাসিক নিয়মিত না হওয়ার প্রাথমিক কারণগুলোর মধ্যে মানসিক চাপ হল অন্যতম কারণ। পিরিয়ড নিয়ন্ত্রণকারী সমস্ত হরমোন স্ট্রেস-এর কারণে সঠিকভাবে কাজ করে না, ফলে ঠিকমত পিরিয়ড হয় না। সেক্ষেত্রে যোগ ব্যায়াম এবং মেডিটেশন স্ট্রেস দূর করতে পারে, তাছাড়া যোগ ব্যায়াম আমাদের দেহের আরো অনেক সমস্যার সমাধান করে।
অনিয়মিত মাসিকের সমস্যা সমাধান করতে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী যেসব থেরাপি করতে হয় সেগুলোর ক্ষেত্রে অনেক সময় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়, যায় ফলে পেটের সমস্যা, মাথা ব্যাথা, পেট ফাঁপা ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে। কিন্তু ঘরোয়া প্রতিকারের উপায় অবলম্বন করলে হয়তো তেমন কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না। তাই উপরিউক্ত উপায়গুলি অবলম্বন করে দেখতে পারেন। তবে বেশি সমস্যা দেখা দিলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা করা উচিত।
পরিশেষে, Conclusion
অনিয়মিত মাসিক হওয়ার কারণ নির্ধারণ করতে হবে তবে সঠিক চিকিৎসা সম্ভব, আর এরজন্য আপনাকে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করতে হবে তবেই এইসব সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান সম্ভব হবে।