কথায় আছে- “পেট ভালো যার, সব ভালো তার।” কিন্তু যাদের পেটের সমস্যা থাকে, তাদের ক্ষেত্রে পেটের সমস্যা থেকে দেহের আরো বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়। পেটের কত-শত রোগ! তালিকায় রয়েছে গ্যাস, অ্যাসিডিটি, অরুচি, ডায়ারিয়া। কিন্তু পেট পরিষ্কার না হওয়া এবং পেট ফেঁপে যাওয়ার মত অস্বস্তিকর সমস্যা হয়তো আর কিছু নেই। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা এই সমস্যাগুলোর সমাধান নিয়ে আলোচনা করবো।
পেট ফাঁপা থেকে মুক্তির উপায়, Ways to get rid of flatulence
খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়ম তথা তৈলাক্ত ও ভাজাপোড়া খাবার খাওয়ার কারণে বেশিরভাগ মানুষেরই পেতে অত্যাধিক গ্যাস জমে পেট ফেঁপে বা ফুলে ওঠে। সাধারণত কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার বেশি খাওয়া হলে এবং হজমে সমস্যা ও পেটে গ্যাসের সৃষ্টি হয়, যার কারণে পেট ফেঁপে থাকে। এর থেকে হয় বদহজম এবং কখনো কখনো পেটে ব্যথাও হতে পারে।
অনেকের ক্ষেত্রে এই পেট ভোলা ভাব ও বদহজম থেকে শুরু হয় কোষ্ঠকাঠিন্য বা পাতলা পায়খানা। তবে এই সমস্যাগুলোর নিরাময় করতে ওষুধ না খেয়ে শুরুতেই ঘরোয়া কিছু উপায় গ্রহণ করলেই সমাধান মিলবে। উপায়গুলো হল :
- ১) রোজ পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করতে হবে, কারণ জল দ্রুত খাবারকে হজম করতে সহায়তা করে। বিশেষ করে যারা হজম জনিত সমস্যায় ভুগছেন; তাদের যথেষ্ট পরিমাণে জল পান করা উচিত।
- ২) পেটে ফোলাভাব ও অস্বস্তি বোধ হলে কখনো শুয়ে থাকবেন না, বরং কিছুক্ষণ বসে, দাঁড়িয়ে বা হাঁটাহাঁটি করতে থাকুন। শুয়ে থাকলে পেটের অস্বস্তি আরও বেড়ে যাবে।
- ৩) হালকা গরম জল দিয়ে স্নান করুন। দেখবেন বেশ আরাম পাবেন। এ ছাড়াও পেটে তাপ প্রয়োগ করতে পারেন, অর্থাৎ গরম সেঁক দিতে পারেন।
- ৪) কিছু কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, এক চিমটি বেকিং সোডা ও লেবুর রস এ গ্লাস জলে মিশিয়ে খেলে বদহজমের সমস্যা দ্রুত দূর হয়। এই মিশ্রণটি কার্বনিক অ্যাসিড উৎপাদন করে, যা পেটের মধ্যে সৃষ্ট গ্যাস এবং বদহজম হ্রাস করতে সাহায্য করে। পাশাপাশি এটি লিভারের ক্ষরণ এবং অন্ত্রের গতিশীলতাও উন্নত করে।
- ৫) আদা হজমের সমস্যার দ্রুত দূর করার ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। বদহজম দূর হলে আপনা আপনিই পেটে ফাঁপার সমস্যা কম হতে যায়। এরজন্য প্রতিদিন খাবার পর এক টুকরা আদা চিবিয়ে খাওয়ার অভ্যাস করুন, এতে পেটে আর গ্যাসের সম্যসা করবে না। এছাড়া পেট ফাঁপলে আদা কুচি করে নিয়ে সামান্য লবণ দিয়ে মেখে নিয়ে সেটা চিবিয়ে খেয়ে নিতে পারেন অথবা আদা ছেঁচে লবণ দিয়ে আদার রস তৈরি করে পান করতে পারেন। তাছাড়া আদা চা তৈরি করেও পান করতে পারেন, এতে পেট ফাঁপা উপশম হয়ে যাবে।
- ৬) শসা খেলে পেট ঠাণ্ডা থাকে, এটা আমাদের মধ্যে প্রায় সকলেই হয়তো জানেন। শসায় থাকে ফ্লেভোনয়েড ও অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান, যা পেটে গ্যাসের সমস্যা কমায়। তাই খাবার গ্রহণের পর শশা খেতে পারেন, যা আপনার হজমে সহায়তা করবে।
- ৭) আমরা সবাই জানি যে টকদই অন্ত্রে উপকারী ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি করে, ফলে ডাইজেস্টিভ ট্র্যাকও উন্নত হয় এবং স্বাভাবিভাবেই হজমশক্তি বৃদ্ধি পায়, ফলে পেট ফাঁপা ও বদহজমের সমস্যা কম হয়। তাই মাঝে মধ্যে টক দই খেতে পারেন।
- ৮) পেঁপে বদহজম সমস্যা দূরে রাখতে সহায়তা করে। এতে থাকে পাপায়া নামক এনজাইম, যা হজমশক্তি বৃদ্ধি করে। তাই নিয়মিত পেঁপে খাওয়ার অভ্যাস করুন, তাহলে গ্যাসের সমস্যা কম হয়ে যাবে।
- ৯) যাদের কাঁচা হলুদ চিবিয়ে খাওয়ার অভ্যাস আছে তাদের ক্ষেত্রে পেট ফাঁপার সমস্যা খুব কম হয়, কারণ হলুদ দ্রুত পেট ফাঁপার সমস্যার সমাধান করে। যদি চিবিয়ে খেতে অসুবিধা হয় বা কাঁচা খেতে না পারেন; তাহলে আদার মতো হলুদ ছেঁচে নিয়ে জলে কয়েক মিনিট ফুটিয়ে চা তৈরি করে পান করে নিন।
- ১০) দারুচিনি হজমের জন্য খুবই ভালো। এক গ্লাস জলে আধা চামচ দারুচিনির গুঁড়ো মিশিয়ে পান করুন, অথবা আস্ত দারুচিনি ফুটিয়ে নিয়ে দিনে ২-৩ বার খেতে পারেন, এতে গ্যাস দূরে থাকবে।
- ১১) পেটের গ্যাস নিয়ন্ত্রণে জিরা বিশেষভাবে কাজ করে। জিরায় থাকা পুষ্টিগুণ পাকস্থলীর এসিড নিয়ন্ত্রণ করে পেটের ব্যথা দূর করতে এবং হজমক্রিয়া উন্নত করে। পেট ফাঁপার সমস্যা থেকে দূরে থাকতে এক গ্লাস জলে সামান্য জিরার গুঁড়ো মিশিয়ে নিয়ে পান করুন, অথবা জলে জিরা ফুটিয়ে ছেঁকে নিয়ে প্রতিবেলা খাবার পর খেতে পারেন।
- ১২) তুলসিতে এমন কিছু উপকারী পদার্থ আছে, যা গ্যাসের সমস্যা কম করতে পারে। এ ছাড়াও তুলসী ক্ষুধা বাড়ায় এবং পেটে ব্যথা, অস্বস্তি, ফোলাভাব ইত্যাদি সমস্যা কম করে দেয় এবং সামগ্রিক হজমে উন্নতি করে। তাছাড়া তুলসিতে থাকে ইউজেনল, যা পেটে অ্যাসিডের পরিমাণ হ্রাস করতে পারে।
- ১৩) পেট ফাঁপা থেকে দূরে থাকতে ডাবের জল পান করতে পারেন, এতে থাকে উচ্চ মাত্রায় পটাসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম। ডাবের জল রিহাইড্রেটিংয়ের জন্যও বেশ কার্যকর, তাছাড়া এই জলে ক্যালোরি ও চিনির পরিমাণ কম। ৪-৬ ঘণ্টা সময়ের ব্যবধানে প্রতিদিন ২ গ্লাস করে ডাবের হল খেলে পেট ফাঁপার সমস্যার সমাধান হবে।
- ১৪) পেট ফাঁপা সমস্যা থেকে দূরে রাখতে কলা বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। কলায় থাকে ভিটামিন B6, পটাসিয়াম, এবং ফোলেট। এই পুষ্টি উপাদানগুলো পেটের ব্যথা কম করতে সহায়তা করে। এ ছাড়াও বদহজমের ফলে হওয়া কোষ্ঠকাঠিন্য এবং ডায়রিয়ার সমস্যাও উপশম করে কলা।
![রোজ পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করতে হবে, কারণ জল দ্রুত খাবারকে হজম করতে সহায়তা করে।](https://okbangla.com/wp-content/uploads/2024/01/pet2.jpeg)
পেট পরিষ্কার রাখতে যা করবেন, What to do to keep the stomach clean
পেট পরিষ্কার না হলে কত যে সমস্যার সৃষ্টি হয়, তা হয়তো কারো অজানা নয়। পেট পরিষ্কার না হলেই পেট ফাঁপে, গ্যাস হয়, খাবারে অরুচি আসে। আমরা যখন খাবার খাই, সেই খাবার পাকস্থলী ও অন্ত্রে শোষিত হয়। তারপর মলদ্বারের মাধ্যমে তা বাইরে বেরিয়ে যায়। এই প্রক্রিয়াটি সঠিকভাবে হলে শরীরে তেমন কোনও সমস্যা দেখা দেয় না।
কিন্তু অনেক সময় কিছু ব্যক্তির ক্ষেত্রে দেখা যায় যে পায়খানা দিনের পর দিন আটকে রয়েছে, আর পায়খানা হলেও অনেক সময় মনে হয় যেন পেট পরিষ্কার হয় নি। এই সমস্যার নামই কোষ্ঠকাঠিন্য বা কনস্টিপেশন। খাওয়া দাওয়া সঠিকভাবে না হওয়ার কারণে এই অসুখে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক্ষেত্রে কোষ্ঠকাঠিন্য রোগীদের পেট ফেঁপে যাওয়ার ফলে আর কিছু খাওয়ার ইচ্ছে থাকে না, ফলে সমস্যা আরো বেড়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কয়েকটি খাবার কোষ্ঠকাঠিন্য রোগীর পেট সহজেই পরিষ্কার করতে পারে। সেগুলি হল :
১. অলিভ তেল, ফ্ল্যাক্সিড তেল দিয়ে রান্না করুন :
তেল খাওয়া খারাপ বলেই জানেন সবাই, কিন্তু কিছু কিছু তেল আছে যা শরীরের জন্য উপকারী। তাই পেট পরিষ্কার রাখতে অলিভ ও ফ্ল্যাক্সিড তেল ডায়েটে রাখতে পারেন। এই তেলে এমন কিছু উপকারী উপাদান রয়েছে যা হজমে সাহায্য করে। এমনকী এই তেল পেটের প্রদাহ দূর করে দেয়, যার ফলে অন্ত্র থেকে মল বের হওয়ার পথ সুগম হয়। তাই অনেকেই স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য এই তেলে রান্না করে খান।
![অলিভ তেল, ফ্ল্যাক্সিড তেল দিয়ে রান্না করুন](https://okbangla.com/wp-content/uploads/2024/01/pet3.jpeg)
২. অ্যাপেল খাওয়া উচিত :
আপেল প্রায় সকলেরই পছন্দের ফল। এই ফলের স্বাদও অনন্য। এছাড়া এতে রয়েছে নানা ভিটামিন ও খনিজ। খোসা শুদ্ধ আপেল খেলে অনেকটা পরিমাণে ফাইবার পাওয়া যায়। এতে সহজেই পায়খানা পরিষ্কার হবে। অন্যদিকে আপেলে আছে পেকটিন, যা মূলত একটি ডায়েটরি ফাইবার, এটি মল নরম করতে সাহায্য করে। তাই দিনে অন্তত একটা আপেল খেতে পারেন।
৩. ন্যাশপাতি খাওয়া উচিত :
এই ফলটিকে অনেকেই অবহেলা করেন। তাই বাজারেও এর তেমন বিক্রিবাট্টা নেই। অন্য ফলের ভিড়ে ন্যাশপাতি যেন সবসময়ই হারিয়ে যায়। তবে বিজ্ঞান বলছে, এই ফলের রয়েছে একাধিক গুণ। বিভিন্ন অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর এই ফল। তাই নিয়মিত খাওয়া শুরু করুন ন্যাশপাতি। আর কোষ্ঠকাঠিন্য রোগীরা জেনে রাখুন, ন্যাশপাতিতে রয়েছে অনেকটা পরিমাণে ফাইবার। এই ফাইবার পেট পরিষ্কারে সাহায্য করে।
![ন্যাশপাতি খাওয়া উচিত](https://okbangla.com/wp-content/uploads/2024/01/pet4.jpeg)
৪. বিদেশি ফল কিউই খাওয়া উপকারী :
কিউই ফলকে আমরা বিদেশি ফল হিসেবেই চিনি, কিন্তু এখন আর বিদেশ বলে সত্যিই কিছু নেই। কারণ দেশের বাজারেও প্রায় সারা বছর পাওয়া যায় এই ফল। এই ফলটির রয়েছে হরেক গুণ। এতে আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, পলিফেনলস থেকে শুরু করে অন্যান্য উপকারী উপাদান। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে কিউই ফলটিতে আছে এমন কিছু উপাদান যা পায়খানা নরম করে, ফলে মলত্যাগ করার সময় চাপ প্রয়োগ করতে হয় না, পেটও পরিষ্কার হয়।
![বিদেশি ফল কিউই খাওয়া উপকারী](https://okbangla.com/wp-content/uploads/2024/01/pet5.jpeg)
৫. পালংশাক খাওয়া উচিত :
পালংশাক আমাদের হাতের কাছে পাওয়া যায়, এটি পেট ভালো রাখার ক্ষেত্রে অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি খাবার হিসেবে বিবেচিত। এই শাকে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এছাড়াও এই শাকে আছে ফাইবার, যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সহায়ক। তাই পালং খেলে পেট পরিষ্কার হয়। এছাড়া ব্রকোলি, স্প্রাউটস ইত্যাদিও খেতে পারেন। উক্ত খাবারগুলি নিয়মিত ডায়েটে রাখলে অবশ্যই পেট পরিষ্কার থাকবে।
![পালংশাক খাওয়া উচিত](https://okbangla.com/wp-content/uploads/2024/01/pet6.jpeg)
শেষ কথা, To conclude
উপরিউক্ত আলোচনার মাধ্যমে আশা করি আপনারা পেট পরিষ্কার না হওয়া এবং পেট ফেঁপে যাওয়ার মত অস্বস্তিকর সমস্যাগুলোর সমাধান সম্পর্কে অবগত হতে পেরেছেন। তবে সমস্যা বেশি হলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ এবং সঠিক ওষুধ খেতে হবে।