লিভার সিরোসিস হল এমন এক রোগ, যা লিভারে ক্ষত সৃষ্টি করে। এই রোগ অতিরিক্ত মদ্যপান বা হেপাটাইটিসের কারণে হতে পারে। যকৃৎ বা লিভার বিভিন্ন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও লিভার নিজে থেকেই সেরে উঠবার চেষ্টা করে। এই প্রক্রিয়ার ফলে বহু ক্ষত কোষ তৈরি হয়। শরীরে সিরোসিসের মাত্রা বেড়ে ওঠার সাথে সাথে ক্ষত কোষের পরিমাণও বৃদ্ধি পেতে থাকে, ফলে যকৃতের কার্যক্ষমতা ব্যাহত হয়।
লিভার সিরোসিসের কারণ সমূহ, Causes of liver cirrhosis
অনেক সময় অন্য কোনো রোগ লিভারের ক্ষতি করার মাধ্যমে সিরোসিস সৃষ্টি করতে পারে। লিভার সিরোসিস হওয়ার বিভিন্ন কারণগুলি হল–
- হিমোক্রোমাটোসিস হলে বা শরীরে লৌহের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে।
- আলফা-১ অ্যান্টিট্রিপসিনের মাত্রা হ্রাস পাওয়ার কারণে।
- গ্লাইকোজেন স্টোরেজ ডিজিজ বা গ্যালাক্টোসিমিয়া
- নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার রোগের কারণে।
- লিভারে চর্বির পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে।
- সিস্টিক ফাইব্রোসিস।
- পিত্তনালীর অসম বা অস্বাভাবিক গঠন
- সিফিলিস জাতীয় সংক্রমণ।
- কোনো কারণে পিত্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া।
- অটোইমিউন হেপাটাইটিস, এক্ষেত্রে শরীরের নিজস্ব প্রতিরক্ষাব্যবস্থাই লিভারের অসুখ সৃষ্টি করে।
- আইসোনিয়াজিড বা মেথোট্রেকসেট জাতীয় ওষুধও সিরোসিস সৃষ্টি করতে পারে।
লিভার সিরোসিসের লক্ষণ, symptoms of liver cirrhosis
উল্লেখযোগ্যভাবে লিভারের ক্ষতি না হওয়া পর্যন্ত এই রোগটির লক্ষণ সাধারণত প্রকাশ পায়না। সিরোসিসের প্রধান কয়েকটি লক্ষণ হল-
- ত্বক ও চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া
- পা, গোড়ালি ও পায়ের পাতা ফুলে যেতে পারে।
- ছোটো ক্ষত হলেও অতিরিক্ত রক্তপাত হওয়া।
- দেহে ক্ষত সৃষ্টি হওয়া
- প্রায়ই বমিভাব হওয়া।
- ক্লান্তি অনুভব হওয়া
- হঠাৎ হঠাৎ চুলকানি
- হাতের পাতা অকারণেই লাল হয়ে যাওয়া।
- ক্ষিদে কমে যাওয়া
- ওজন হ্রাস পাওয়া
- মেয়েদের ক্ষেত্রে ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়ার সমস্যাও হয়।
- ছেলেদের ক্ষেত্রে অন্ডকোষ শুকিয়ে যেতে পারে বা ছোট হয়ে যাওয়া।
- পেটে জল জমে যাওয়া
- বিভ্রান্তি এবং কথা জড়িয়ে যাওয়া
রোগ নির্ণয়, diagnosis of the disease
লিভার সিরোসিসের প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীর মধ্যে কোনো লক্ষণ তেমনভাবে প্রকাশ পায় না। সাধারণতঃ, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে অথবা সার্বিক দেহ পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগ নিরূপণ হয়ে থাকে।
ইমেজিং পরীক্ষা :
MRE বা ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইলাস্টোগ্রাফি পরীক্ষার মাধ্যমে লিভারের অবস্থা জানা যায়, এক্ষেত্রে শরীরে কোনোরকম কাটাছেঁড়া করতে হয়না। এই পদ্ধতির মাধ্যমে লিভার শক্ত হয়েছে কিনা দেখা হয়। এছাড়াও MRI, কমপিউটেড টোপোগ্রাফি (CT) এবং আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষার মাধ্যমেও লিভার পরীক্ষা করা হয়।
রক্ত পরীক্ষা :
লক্ষণ বুঝে চিকিৎসক প্রাথমিকভাবে কিছু রক্ত পরীক্ষা করার পরামর্শ দিতে পারে, যা থেকে লিভারে কোনো জটিলতা আছে কিনা তা জানা যায়, যেমন বিলিরুবিনের মাত্রা ইত্যাদি বোঝা যায়। এইসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রক্তে নির্দিষ্ট কিছু উৎসেচকের উপস্থিতি সম্পর্কে জানা যায়, যেগুলি লিভারের ক্ষত বা অসুস্থতা নির্দেশ করে।
লিভার পরীক্ষার পাশাপাশি রক্তে ক্রিয়াটিনিনের পরিমাণও পরীক্ষা করে নিতে পারেন, যা থেকে কিডনির কার্যক্ষমতা সম্পর্কে জানা যায়। সাথে শরীরে হেপাটাইটিস ভাইরাসের উপস্থিতিও পরীক্ষা করতে হতে পারে। লিভারের কর্মক্ষমতা ও অবস্থা বোঝার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ইন্টারন্যাশনাল নরমালাইজড রেশিও (INR) পরীক্ষা করাতে পারেন, এর থেকে রক্ততঞ্চনের মাত্রা নির্ণয় করা যায়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসক সিরোসিসের কারণ নির্ধারণ করতে পারেন এবং সিরোসিসের বর্তমান অবস্থাও এর মাধ্যমে জানা যায়।
বায়োপসি :
লিভার সিরোসিস হয়ে থাকলে, চিকিৎসক আপনাকে বায়োপসি করার পরামর্শও দিতে পারেন। তবে রোগ নির্ণয় করার জন্য এই পরীক্ষা অপরিহার্য নয়, তবে রোগের কারণ, বর্তমান অবস্থা ও লিভারের ক্ষতির পরিমাণ বোঝার এই পরীক্ষা করতে হতে পারে।
রোগের অবস্থা অনুযায়ী চিকিৎসকরা চিকিৎসার পদ্ধতি নির্ধারণ করবেন। এর সাথে রোগের লক্ষণ ও গতিপ্রকৃতি বোঝার জন্য কিছু নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজন হতে পারে। এইসব পরীক্ষার মাধ্যমে লিভারের অন্যান্য জটিলতা, যেমন লিভার ক্যানসার বা ইসোফেগাল ভ্যারিসেস (খাদ্যনালীর অসুখ) ইত্যাদিও পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব।
লিভার সিরোসিসের চিকিৎসা পদ্ধতি, treatment procedure of liver cirrhosis
লিভারের ক্ষতির পরিমাণ এবং কারণ জানা সিরোসিসের চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এই রোগের চিকিৎসা পদ্ধতির প্রাথমিক দিক হলো লিভারে ক্ষত কোষ বৃদ্ধির মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা, অথবা রোগের লক্ষণগুলোকে প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণ করা। রোগ নির্ণয় হওয়ার পর যদি দেখা যায় যে লিভারের ক্ষতির পরিমাণ বেশী, সেক্ষেত্রে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হতে পারে। তবে যদি প্রাথমিক পর্যায়েই রোগের অন্তর্নিহিত কারণগুলির সঠিক চিকিৎসা করা যায়, তাহলে এই ক্ষতির মাত্রা সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। লিভার সিরোসিসের চিকিৎসা পদ্ধতিতে যেসব বিষয়ে নজর দেওয়া হয় সেগুলি হল :
মদ্যপান-জনিত সমস্যার চিকিৎসা করতে হবে :
লিভার সিরোসিস যদি অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে হয়, তবে অবিলম্বে এই অভ্যাস ত্যাগ করা প্রয়োজন। নেশাজাতীয় দ্রব্য থেকে দূরে থাকতে হবে, সিরোসিসের সমস্যা থাকলে মদ্যপান থেকে বিরত থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সামান্য পরিমাণ অ্যালকোহলও আপনার শরীরের তথা লিভারের সুস্থতার পক্ষে চরম ক্ষতিকারক।
ওজন কমানো প্রয়োজন :
নন-অ্যালকোহলিক হলেও ফ্যাটি অ্যাসিডের সমস্যা থাকার কারণে সিরোসিস হতে পারে, তবে রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ ও ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা লিভারের সুস্থতার পক্ষে লাভজনক হতে পারে। পাশাপাশি তেল মশলা যুক্ত খাবার থেকে বিরত থাকুন।
সঠিক পরিমাণ ওষুধপত্র :
ক্ষতির কারণ ও ক্ষতের অবস্থা অনুযায়ী এই রোগের ক্ষেত্রে ওষুধ ব্যবহার করা হয়, মূলতঃ হেপাটাইটিস কমানোর জন্যই প্রাথমিকভাবে ওষুধ ব্যবহৃত হয়। ওষুধগুলি প্রধানতঃ লিভারে বাড়তি ক্ষতির পরিমাণ কম করে।
লিভারের অন্যান্য সমস্যার জন্য ওষুধ :
রোগীর অবস্থার উপর ভিত্তি করে চিকিৎসকরা ওষুধের মাধ্যমে সিরোসিসের বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ করে। সিরোসিস সম্পর্কিত অন্যান্য জটিলতা চিকিৎসার মাধ্যমে ঠিক করা লিভারের রোগ দ্রুত সারানোর ক্ষেত্রে জরুরী। যেমন সিরোসিসের প্রভাবে শরীরে তরলের মাত্রা বৃদ্ধি হয়, তাই চিকিৎসকরা প্রয়োজনীয় ওষুধ ও কম সোডিয়ামযুক্ত খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন যাতে শরীরে জলের পরিমাণ বৃদ্ধি রোধ হয়, যা আপনাকে অ্যাসাইটিস ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফুলে যাবার হাত থেকে রক্ষা করে।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি :
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ওষুধ খেতে হয়ে পারে, কারণ সিরোসিস রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকা জরুরি।
শরীরে কোনোরকম সংক্রমণ রোধ :
রোগীর শরীরে কোনোরকম সংক্রমণ যদি থাকে, তাহলে চিকিৎসকরা অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন। এছাড়াও ইনফ্লুয়েঞ্জা, হেপাটাইটিস, নিউমোনিয়া ইত্যাদির জন্য ভ্যাক্সিন নেবার প্রয়োজনও হতে পারে।
হেপাটিক এনসেফালোপ্যাথি :
লিভারের কর্মক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার কারণে সৃষ্ট ক্ষতিকর টক্সিনের পরিমাণ কম করতে ওষুধের প্রয়োজন হতে পারে।
রোগের মাত্রা বৃদ্ধি হয়ে গেলে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারি করার প্রয়োজনও হতে পারে। সার্জারিতে ক্ষতিগ্রস্ত লিভারটি বাদ দিয়ে সুস্থ একটি লিভার শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। তবে লিভার সিরোসিসের উন্নত চিকিৎসার জন্য বর্তমানে নানারকম গবেষণা চলছে। তবে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনই হলো লিভার সিরোসিসের কষ্ট থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়।
যকৃতকে সুস্থ রাখতে জীবনধারা পরিবর্তন করতে হবে, Lifestyle changes are required to keep the liver healthy
যকৃতের রোগ একজন ব্যক্তির স্বাভাবিক স্বাস্থের উপর বিশেষ প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে, এর দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলির মোকাবেলা করার জন্য জীবনধারার বেশ কিছু পরিবর্তন করতে হয় যাতে রোগ এবং তার আনুষঙ্গিক উপসর্গগুলি আর না বাড়তে পারে। তবে কিছু রোগের চিকিৎসা সম্ভব হয় জীবনধারার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে, যেমন আপনি যকৃতের সুস্থতা রক্ষার্থে মদ্যপান বন্ধ করে রাখতে পারেন, শরীরে চর্বি জমতে দেবেন না অবগ ওজন হ্রাস করে এবং আদর্শ বি-এম-আই প্রাপ্ত করতে হবে। যকৃতের রোগ থেকে রক্ষা পেতে জীবনধারার যে পরিবর্তন করা হয় সেগুলি হল:
- খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে। যকৃত দেহের অভ্যন্তরের প্রোটিনের বিপাকের সঙ্গে যুক্ত থাকে। তাই যকৃতের যেকোনো রোগ প্রোটিনের বিপাককে ব্যাহত করতে পারে। তাই, খাদ্যতালিকায় মধ্যে কার্বোহাইড্রেট রাখা গুরুত্বপূর্ণ, যা দীর্ঘ সময় ধরে শক্তির যোগান দেয়। অন্যদিকে প্রোটিন জাতীয় খাবার না খাওয়া উচিত, কারণ রোগে আক্রান্ত থাকা যকৃত প্রোটিনকে পর্যাপ্ত-ভাবে বিপাক করতে পারে না। যাদের হিমোক্রোমাটোসিস এর সমস্যা আছে তাদের ক্ষেত্রে ভিটামিন সি কম নেওয়া উচিৎ, কারণ এটা খাদ্য থেকে লোহার শোষণ বৃদ্ধি করে।
- এনালজেসিক বা ব্যথা কমানোর ওষুধের ব্যবহার কম করা বা পারলে না করাই ভালো।
- হেপাটাইটিস এর জন্য টিকা-করণ জরুরী। একটি ক্ষতিগ্রস্ত যকৃত হেপাটাইটিস ভাইরাস এর দ্বারা খুব সহজেই প্রভাবিত হতে পারে। আর এই ভাইরাসের সংক্রমণ এর ফলে যকৃত ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে। তাই হেপাটাইটিস ভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকা-করণ করে নেওয়া উচিত।
শেষ কথা, Conclusion
লিভারের কোনো রোগ যেন না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা জরুরি, কারণ এর থেকে দেহের অন্যান্য ক্ষতি হতে পারে। তাই লিভারের যত্ন নিতে স্বাস্থ্যকর জীবনধারা মেনে চলতে হবে। অন্যদিকে যেহেতু লিভারের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি না হওয়া পর্যন্ত লক্ষণ প্রকাশ পায় না, তাই মাঝে মধ্যে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী লিভারের সুস্থতা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।