আজকাল প্রায় সব বাড়িতেই কোনো না কোনো রোগ লেগে থাকে। ফল সবজিতে রাসায়নিক সারের প্রভাবেও রোগের মাত্রা বাড়ছে, তাছাড়া দৈনন্দিন খাবারের অভ্যাসের উপরও সুস্থতা নির্ভর করে। যেকোনো রোগের উপসর্গ আমাদের ভাবিয়ে তোলে। তখন অনেকেই নিজের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করেন। এমনই সমস্যা দেখা দেয় যখন আমাদের যকৃৎ বা লিভারের কোনো সমস্যা হয়।
লিভারের রোগ হলে অনেকেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন যে কি খাওয়া উচিত আর কি না খাওয়া ভালো। তাছাড়া কি করলে সহজে যকৃতের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে তা নিয়েও চিন্তা করেন অনেকে। তবে সবাইকে আগে এটা বুঝতে হবে যে সমস্যা টা আসলে কি ! যকৃৎ বা লিভারের রোগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু উপসর্গ দেখা যায়, ভিন্ন রোগের ভিন্ন লক্ষণ থাকে। এই লক্ষণগুলোর উপর ভিত্তি করে চিকিৎসা করা উচিত। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা যকৃতের বিভিন্ন সমস্যা, রোগের লক্ষণ এবং এসবের সমাধান নিয়ে আলোচনা করবো।
লিভারের আকার, Structure of the liver
লিভার একজন ব্যক্তির শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলির মধ্যে একটি। এটি শরীরে পাঁজরের নীচের ডানদিকে অবস্থিত।
লিভারে সমস্যা হওয়ার কারণ কী, Causes of liver problem
লিভারে বিভিন্ন কারণে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। আমাদের যকৃৎ বা লিভারকে প্রভাবিত করে এমন কিছু প্রধান কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো।
• অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান করা।
• লিভারের প্রদাহ।
• লিভারে বেশি পরিমাণে চর্বি জমা হওয়া।
• লিভার সিস্ট বৃদ্ধি।
• প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত প্রোটিন সেবন।
• সঠিক খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ না করা।
• অতিরিক্ত তেল মশলা বা চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া।
ইত্যাদি আরো ভিন্ন কারণে লিভারের সমস্যা দেখা দেয়।
সাধারণত লিভারের যেসব অসুখ হয়, Diseases associated with liver
আমাদের দেশে লিভারের যে রোগগুলো বেশি দেখা যায়, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম কিছু রোগ হলো—
• লিভারের ফোঁড়া
• ভাইরাল হেপাটাইটিস বা জন্ডিস।
• লিভার সিরোসিস।
• লিভার ক্যান্সার।
• ফ্যাটি লিভার।
• পিত্তথলির বা পিত্তনালীর রোগ।
• লিভারের মেটাবলিক রোগ ইত্যাদি।
যকৃতের রোগের উপসর্গ কি কি, Symptoms of liver disease
লিভার বা যকৃতের রোগ হলে বা যেকোনো সমস্যা দেখা দিলে প্রাথমিক পর্যায়ে কদাচিৎ কোন উপসর্গ দেখা যায় ; আবার অনেক সময় কোনও লক্ষণ থাকে না। কিছুক্ষেত্রে অস্পষ্ট এবং অনির্দিষ্ট লক্ষণ থাকে যেগুলোকে আমরা সমস্যার কারণ হিসেবে ধরি না। তবুও, সাধারণ কিছু উপসর্গ আছে যেগুলি এড়িয়ে না গিয়ে বরং ওইসব সমস্যা সমাধানে উপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত। যকৃতে গুরুতর সমস্যা বা কারো তীব্র হেপাটাইটিস থাকলে যে সব লক্ষণগুলি দেখা যায়, সেগুলি হল :
• অত্যধিক জ্বর।
• বমি করার ইচ্ছা, বমি হওয়া।
• দীর্ঘসময় ধরে জন্ডিস।
• ত্বকে মারাত্বক চুলকানি।
• গাঢ় হলুদ রঙের প্রস্রাব।
• চোখের সাদা অংশ হলুদ হয়ে যাওয়া।
• পেট ব্যথা এবং ফুলে যাওয়া।
• পায়ের গোড়ালি এবং পা ফোলা।
• ক্ষুধামান্দ্য।
• ওজন কমে যাওয়া।
• খুব কম কাজ করেও দুর্বলতা অনুভব হওয়া।
উপরোক্ত উপসর্গ জানান দেয় যে আমাদের যকৃৎ সুস্থ নয়, রোগে আক্রান্ত হয়ছে। অন্যদিকে যকৃতের রোগ যদি সিরোটিক পর্যায়ে চলে যায়, তবে যে সব উপসর্গ দেখা দেয়, সেইগুলি হল :
• মলদ্বার থেকে রক্তপাত হওয়া।
• বমিতে রক্ত থাকা (হেমাটেমেসিস)।
• পেটের মধ্যে তরল জমা হওয়া (এসাইটিস)।
তাছাড়াও ভাইরাস অথবা প্যারাসাইট বা পরজীবী অথবা কোনো জীবাণু দ্বারা যকৃৎ সংক্রমিত হলে প্রদাহ হয় এবং এর ফলস্বরূপ লিভারের কার্যক্ষমতা কমে যায়। এরূপ ইনফেকশন বা সংক্রমণের সবচেয়ে প্রচলিত ধরন হল, হেপাটাইটিস ভাইরাস।
যকৃতের সুস্থতার জন্য চিকিৎসা, Treatment for healthy liver
আমাদের দেহে যকৃৎ নানা রকমের কাজ করে থেকে, সেজন্যই যকৃতের রোগের উপসর্গগুলিও নানা প্রকারের হয়। কিন্তু সবচেয়ে লক্ষণীয় যে উপসর্গ তা হল জন্ডিস। কারও জন্ডিস হলে ত্বক তথা চোখ হলুদ রঙের হয়ে যায়, এছাড়াও প্রস্রাবের রঙ গাঢ় হলুদ হয়ে যায়। যকৃতের রোগ নির্ণায়ক পরীক্ষাগুলি হল আলট্রা-সো্নোগ্রাফি, সিটি স্ক্যান, যকৃতের বাইয়প্সি ইত্যাদি। যকৃতের সমস্যা সংক্রান্ত চিকিৎসা নির্ভর করে অন্তর্নিহিত রোগের উপরে।
লিভার বা যকৃতের রোগ এর চিকিৎসা, treatment for liver disease
যেকোনো রোগের চিকিৎসা করতে হলে প্রথমে সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করা জরুরি। যে চিকিৎসা পদ্ধতিগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, সেগুলির হল :
**ভাইরাস সংক্রমণ রোধে চিকিৎসা
**হেপাটাইটিস ভাইরাস সংক্রমণ জনিত চিকিৎসা:
দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস বি এবং সি রোগের চিকিৎসার জন্য সাধারণত ভাইরাস প্রতিরোধক ওষুধ প্রয়োগ করা হয়।
**এন্টিবায়োটিক এর প্রয়োগ:
যকৃত প্রদাহের কারণে ফুলে গেলে এন্টিবায়োটিক ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা হয়। কিন্তু গুরুতর অবস্থায় যকৃতে জমে থাকা পুঁজ বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। এরপর এন্টিবায়োটিক দেহে প্রয়োগ করলে রোগী তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠে।
**প্রোটিন প্রয়োগ থেরাপি :
যকৃতের সুস্থতার জন্য কিছু এনজাইম বা প্রোটিন দেহে প্রয়োগ করা হয়। এই প্রোটিনগুলি সহায়ক ওষুধ হিসাবে কাজ করে এবং আমাদের যকৃতের কোষগুলির উপর সৃষ্ট চাপ কম করে।
যকৃৎ বা লিভারের সমস্যা সমাধানের ঘরোয়া কিছু উপায়, Home remedies for liver problem.
যকৃৎ বা লিভারের সমস্যাগুলো সমাধান করা খুবই জরুরি, নয় তো এই সমস্যায় আমাদের সারা শরীর প্রভাবিত হতে পারে। মারাত্বক সমস্যা নিরাময়ের ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি, কিন্তু সাধারণভাবে যকৃতকে সুস্থ রাখতে ঘরোয়া কিছু উপায় অবলম্বন করতে পারেন। নিম্নে লিভার বা যকৃতের সুস্থতা বজায় রাখার ঘরোয়া কিছু উপায় বর্ণনা করা হল :
লেবুজল : প্রতিদিন সকালে লেবু জল পানের অভ্যাস করুন, কারণ লেবুতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন- সি থাকে, যা আমাদের লিভারকে দূষণমুক্ত রাখতে সাহায্য করে।
অ্যাপেল সিডার ভিনিগার : কয়েক ফোঁটা অ্যাপেল সিডার ভিনিগার এক কাপ গরম জলের সাথে মিশিয়ে প্রতিদিন খাবার আগে পান করতে পারেন। কয়েক মাস এভাবে খেলে লিভারে জমে থাকা চর্বি আর থাকবে না।
আদাজল : গরম জলে ছোটো এক টুকরো আদা কুচি করে ভিজিয়ে কিছুক্ষণ রেখে সেই জল দিনে দুবার পান করুন। এই পানীয় ১৫ দিন ধরে লাগাতার খেলে দেখবেন অনেকটা সুস্থ বোধ করছেন। আদা আমাদের যকৃৎ বা লিভারে চর্বি জমার প্রক্রিয়া প্রায় বন্ধ করে দেয়, যার ফলে লিভার সুস্থ থাকে।
গ্রিন-টি : লিভার কার্যকারিতা ঠিক রাখতে সহায়তা করে গ্রিন টি। তাই প্রতিদিন সকালে ও বিকালে এক কাপ করে গ্রিন-টি পান করতে পারেন।
এসব ছাড়াও বিশেষ কিছু অভ্যাস নিয়মিতভাবে মেনে চললে লিভারকে সুস্থ রাখা যায়, যেমন রোজ পর্যাপ্ত পরিমাণ জল পান করা, অ্যালকোহল সেবন এড়িয়ে চলা, চর্বিযুক্ত খাবারগুলো পরিহার করা, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করা, রোজ ব্যায়াম করা।
যকৃতকে সুস্থ রাখতে জীবনধারা পরিবর্তন করতে হবে, Maintenance of Healthy lifestyle for healthy liver
যকৃতের রোগ একজন ব্যক্তির স্বাভাবিক স্বাস্থের উপর বিশেষ প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে, এর দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলির মোকাবেলা করার জন্য জীবনধারার বেশ কিছু পরিবর্তন করতে হয় যাতে রোগ এবং তার আনুষঙ্গিক উপসর্গগুলি আর না বাড়তে পারে। তবে কিছু রোগের চিকিৎসা সম্ভব হয় জীবনধারার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে, যেমন আপনি যকৃতের সুস্থতা রক্ষার্থে মদ্যপান বন্ধ করে রাখতে পারেন, শরীরে চর্বি জমতে দেবেন না। অতিরিক্ত ওজন হ্রাস করে এবং আদর্শ বি-এম-আই প্রাপ্ত করতে হবে। যকৃতের রোগ থেকে রক্ষা পেতে জীবনধারার যে পরিবর্তন করা হয় সেগুলি হল:
খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে। যকৃত দেহের অভ্যন্তরের প্রোটিনের বিপাকের সঙ্গে যুক্ত থাকে। তাই যকৃতের যেকোনো রোগ প্রোটিনের বিপাককে ব্যাহত করতে পারে। তাই, খাদ্যতালিকায় মধ্যে কার্বোহাইড্রেট রাখা গুরুত্বপূর্ণ, যা দীর্ঘ সময় ধরে শক্তির যোগান দেয়। অন্যদিকে প্রোটিন জাতীয় খাবার না খাওয়া উচিত, কারণ রোগে আক্রান্ত থাকা যকৃত প্রোটিনকে পর্যাপ্ত-ভাবে বিপাক করতে পারে না। যাদের হিমোক্রোমাটোসিস এর সমস্যা আছে তাদের ক্ষেত্রে ভিটামিন সি কম নেওয়া উচিৎ, কারণ এটা খাদ্য থেকে লোহার শোষণ বৃদ্ধি করে।
এনালজেসিক বা ব্যথা কমানোর ওষুধের ব্যবহার কম করা বা পারলে না করাই ভালো।
হেপাটাইটিস এর জন্য টিকা-করণ জরুরী। একটি ক্ষতিগ্রস্ত যকৃত হেপাটাইটিস ভাইরাস এর দ্বারা খুব সহজেই প্রভাবিত হতে পারে আর এই ভাইরাসের সংক্রমণ এর ফলে মানব দেহ যকৃত ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে। তাই হেপাটাইটিস ভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকা-করণ করে নেওয়া উচিত।
উপসংহার, Conclusion
যকৃতের সুস্থতার জন্য কিভাবে কি করা উচিৎ আশা করি আজকের এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আপনারা তা বুঝতে পেরেছেন, এছাড়াও যকৃৎ বা লিভারের সমস্যা হয়ে কোন লক্ষণগুলো দেখা দেয় সে সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে। তাহলে এবার নিজের যকৃতকে সুস্থ রাখার দায়িত্ব আপনার নিজেরই। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ অবশ্যই নেবেন।