উচ্চ রক্তচাপ একটি শারীরিক সমস্যা যা পুরুষ- মহিলা সকলের ক্ষেত্রেই হতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ থেকে হৃদযন্ত্রের পেশি দুর্বল হয়ে যেতে পারে এবং এর ফলে দুর্বল হৃদযন্ত্র রক্ত পাম্প করতে না পেরে ব্যক্তির হৃদপিণ্ড কাজ করা বন্ধ করতে পারে বা হার্ট ফেল করতে পারে। তাই উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব জরুরি।
তবে হাই ব্লাড প্রেসার এর জন্য কি ওষুধ সেবন করতে হবে বা নিয়ন্ত্রণের জন্য কি করতে হবে তা জেনে রাখা উচিত। আজকের এই প্রতিবেদনে উচ্চরক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
উচ্চ রক্তচাপ কী? What is high blood pressure?
হৃদপিণ্ডের সংকোচন ও সম্প্রসারণের সময় একবার সিস্টোলিক প্রেশার এবং একবার ডায়াস্টলিক প্রেশার হয়। হৃৎপিণ্ডের ধমনীতে রক্ত প্রবাহের চাপ অনেক বেশি থাকলে সেটিকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেশার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
একজন মানুষের স্বাভাবিক রক্তচাপ কত? What is a person’s normal blood pressure?
প্রাপ্তবয়স্ক লোকের সাধারণ স্থির রক্তচাপ প্রায় ১২০ মিলিমিটার পারদচাপ সংকোচক এবং ৮০ মিলিমিটার পারদচাপ প্রসারক। সংক্ষেপে ১২০/৮০ মিমিপারদ।
প্রেসার বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ কি? What are the symptoms of high blood pressure?
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উচ্চ রক্তচাপের তেমন কোনো লক্ষণ থাকে না। যদি উচ্চ রক্তচাপের কারণে বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি হয়, যেমন হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনি বৈকল্য ইত্যাদি। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের বুক ধড়ফড় করা, মাথা ঘোরানো, মাথাব্যথা বা বমি ভাব হতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপের কারণ, Causes of high blood pressure :
সাধারণত মানুষের ৪০ বছরের পর থেকে উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে থাকে। তাছাড়াও বিভিন্ন কারণ থাকে রক্তচাপ বৃদ্ধির পেছনে, সেগুলি হল :
- অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা
- পরিবারে কারও উচ্চ রক্তচাপ থাকলে
- নিয়মিত ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম না করলে
- প্রতিদিন ছয় গ্রাম অথবা এক চা চামচের বেশি লবণ খেলে
- ধূমপান বা মদ্যপান বা অতিরিক্ত ক্যাফেইন জাতীয় খাদ্য/পানীয় খেলে
- দীর্ঘদিন ধরে ঘুমের সমস্যা হলে
- শারীরিক ও মানসিক চাপ থাকলে
নারীর স্বাভাবিক রক্তচাপ কত? What is the normal blood pressure of women?
আপনার রক্তচাপ সাধারণত 20 বা তার বেশি বয়সের মহিলা বা পুরুষদের জন্য 120/80 মিলিমিটার পারদ (মিমি Hg) হওয়া উচিত।
পুরুষের রক্তচাপ কত হওয়া উচিত? What is the normal blood pressure in males?
বেশিরভাগ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য স্বাভাবিক রক্তচাপকে 120 এর কম সিস্টোলিক চাপ এবং 80 এর কম ডায়াস্টোলিক চাপ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়।
কলা খেলে কি ব্লাড প্রেসার বাড়ে? Does eating bananas increase blood pressure?
কলায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম, যা রক্তচাপ কমাতে বিশেষ ভূমিকা নেয়। পুষ্টিবিদদের মতে, নিয়মিত একটা করে কলা খেলে রক্তচাপের মাত্রা বশে রাখা যায়। ওজন বেড়ে যাওয়ার ভয়ে অনেকেই কলা খান না। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা কলা খেতেই পারে।
ব্লাড প্রেসার বেশি হলে কি সমস্যা হয়? What problems occur if blood pressure is high?
অতিরিক্ত রক্তচাপ দেহের ধমনীগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এতে ধমনীর নমনীয়তা কম হয়, যার ফলে হৃৎপিণ্ডে রক্ত এবং রক্তে অক্সিজেনের সরবরাহ প্রভাবিত হয়। ফলস্বরূপ বিভিন্ন হৃদরোগের যেমন বুকে ব্যথা, হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেইলিওর-এর ঝুঁকি বেড়ে যায়।
কি কি খেলে ব্লাড প্রেসার বাড়ে? What increases blood pressure?
গরু, মুরগির মাংস, সামুদ্রিক মাছ, ডাল, লাল শাক, পালং শাক, কচু শাক, শিমের বিচি, মিষ্টি কুমড়ার বিচি ও শুকনা ফল আয়রনের ভালো উৎস। এ ছাড়া এগুলোতে সোডিয়াম ভালো পরিমাণে থাকে।
এছাড়াও ডাবের জলে থাকে সোডিয়াম, যা রক্তচাপ বাড়ায়। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, অতিরিক্ত সোডিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খেলে উচ্চ রক্তচাপ বাড়ে।
হাই ব্লাড প্রেসার কত? How much is considered as high blood pressure?
বেশিরভাগ প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা থাকে। বিশ্রামে থাকা অবস্থায় তাদের রক্তচাপ ক্রমাগতভাবে ১৩০/৮০ বা ১৪০/৯০ mmHg এর উপরে থাকে।
উচ্চ রক্তচাপ কমানোর ব্যায়াম, Exercise to reduce high blood pressure :
যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম রক্তচাপকে নিরাপদ মাত্রায় নামিয়ে আনতে পারে। অ্যারোবিক ব্যায়ামের কিছু উদাহরণ যা রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করতে পারে তার মধ্যে রয়েছে হাঁটা, জগিং, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা বা নাচ ।
200 এর বেশি রক্তচাপ কতটা গুরুতর? How serious is the blood pressure of more than 200?
হাইপারটেনসিভ ক্রাইসিস হল রক্তচাপের আকস্মিক, মারাত্মক বৃদ্ধি। রক্তচাপের রিডিং 180/120 মিলিমিটার পারদ (মিমি Hg) বা তার বেশি হওয়ার অর্থ হল উচ্চ রক্তচাপ সংকট, যার জন্য চিকিৎসা জরুরী। এটি হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক বা অন্যান্য জীবন-হুমকির স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে ।
প্রেসার বেশি হলে কি খেতে হবে? What to eat if the blood pressure is high?
খাদ্যতালিকায় পটাশিয়াম–জাতীয় খাবারের পরিমাণ বাড়াতে পারলে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ডাবের জল, কলা, টমেটোসহ কিছু সবজিতে পটাশিয়াম রয়েছে।
এ ছাড়া উচ্চ রক্তচাপ কমাতে বাদাম, শালগম, তিসি, ডার্ক চকলেট ও কালিজিরা ভালো কাজ করে।
উচ্চ রক্তচাপ কমানোর উপায় কি? What are the ways to lower high blood pressure?
যখন রক্তচাপ বাড়বে তখন হাফ চামচ গোলমরিচের গুঁড়ো জলে ভালো করে মিশিয়ে ২ ঘন্টা অন্তর পান করুন।
এছাড়াও উচ্চ রক্তচাপ দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে হাফ গ্লাস জলে হাফ পাতিলেবুর রস মিশিয়ে খেতে পারেন এবং এই লেবুজল ২ ঘন্টা অন্তর পান করলে অনেক তাড়াতাড়ি ফল পাওয়া যায়।
প্রেসার বেড়ে গেলে কি খাওয়া উচিত নয়? What should not be eaten when the blood pressure rises?
- প্রথমত খাবারে লবণের পরিমাণ কমাতে হবে। কাঁচা লবণ একেবারেই খাওয়া যাবে না।
- চর্বি বা ফ্যাট জাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে। যেমন গরু, খাসির মাংস, মাখন, পেস্ট্রি, কেক ইত্যাদি।
- প্যাকেটজাত খাবার বাদ দিতে হবে।
- ভাত খাওয়ার পরিমাণ কমাতে হবে।
- ধূমপান, মদ্যপান ত্যাগ করতে হবে।
ব্লাড প্রেসার বেড়ে গেলে কি খাওয়া উচিত? What should you eat when blood pressure rises?
১। কুমড়ার বীজ: অনেকেই কুমড়া খেলেও এর বীজ ফেলে দেন। কিন্তু বীজেও ভালো পুষ্টি রয়েছে। পাশাপাশি এটি উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
২। টমেটো: টমেটোতে রয়েছে পটাশিয়াম ও ক্যারোটিনাইলয়েড পিগমেন্ট লাইকোপিন। টমেটো উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে।
৩। বিট রস: বিটের মতো উপকারী সবজি খুব কমই আছে। এটি উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।
৪। টক দই ও তেঁতুলের রস: হঠাৎ প্রেশার বেড়ে গেলে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে টক দই কিংবা তেঁতুলের রসও খেতে পারেন। এটা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে।
এছাড়াও উচ্চ রক্তচাপ হলে অতিরিক্ত কোলেস্টরেল জাতীয় খাবার পরিহার করে ফলমূল শাকসবজি খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে।
হাই প্রেসার হলে কি লেবু খাওয়া উচিত? Should you eat lemon if you have high blood pressure?
লেবু পানীয়তে বেশ কিছু খনিজ পদার্থ রয়েছে যা রক্তচাপ কমাতে উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে। ক্যালসিয়াম এবং পটাসিয়াম উভয়ই উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তদের রক্তচাপ কমাতে পারে। কিছু সমীক্ষায় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে লেবু জল অবিলম্বে উচ্চ রক্তে চাপের পরিমাণকে স্বাভাবিক পরিসরে আনতে সাহায্য করতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসার জন্য ওষুধ :
- Acebutolol :
Acebutolol নামক ওষুধটি উচ্চ রক্তচাপ এবং অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের চিকিৎসা করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
- অ্যাসিটাজোলামাইড :
অ্যাসিটাজোলামাইড নামক ওষুধ কনজেস্টিভ হার্ট ফেইলিউরের কারণে অতিরিক্ত তরল জমে যাওয়ার চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়।
- আলিস্কিরেন :
অ্যালিসকিরেন নামক ওষুধটি এককভাবে বা অন্যান্য ওষুধের সাথে প্রাথমিক উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়।
- অ্যালিস্কিরেন এবং অ্যামলোডিপাইন :
অ্যালিস্কিরেন এবং অ্যামলোডিপাইন এর সংমিশ্রণ উচ্চ রক্তচাপ কমানোর কাজ করে যার ফলে রক্তনালীগুলি শিথিল হয়; তাই রক্ত খুব মসৃণভাবে প্রবাহিত হতে পারে।
- অ্যালিস্কিরেন এবং হাইড্রোক্লোরোথিয়াজাইড :
অ্যালিস্কিরেন এবং হাইড্রোক্লোরোথিয়াজাইড সংমিশ্রণ উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে যা হৃৎপিণ্ড এবং রক্তনালীতে কাজের চাপ কমায়।
কোন সময়ে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খেলে সবচেয়ে ভাল কাজ করে ? When does high blood pressure medication work best?
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ সকালের বদলে যদি রাতে ঘুমাতে যাবার আগে খাওয়া হয় তবে তা হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক থেকে বেশি সুরক্ষা দিতে পারে। বিষয়টি পড়ে অবাক লাগলেও, ইউরোপের একটি গবেষণায় এমনটাই পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞদের ধারনা যে, আমাদের দেহঘড়ি এবং প্রাকৃতিক যে ২৪ ঘণ্টার ছন্দ, তা আমাদের ওষুধ গ্রহণের প্রতিক্রিয়ায় প্রভাব ফেলে।
গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, যেসব রোগী ঘুমাবার আগে হাইপার-টেনশনের ওষুধ খাচ্ছেন তাদের রক্তচাপ দিনে ও রাতে উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাচ্ছে।
শেষ কথা, Conclusion :
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভুগে থাকেন বিশ্বের প্রায় ১৫০ কোটি মানুষ। আর এই সমস্যায় সারা বিশ্বে প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষ প্রতি বছর মারা যায়। তবে আমরা চাইলে সচেতনতা অবলম্বন করে এই সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি। আশা করি উপরিউক্ত আলোচনার মাধ্যমে আপনারা জানতে পেরেছেন যে উচ্চ রক্তচাপ কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
Frequently Asked Questions
১২০/৮০ মিমিপারদ।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ সকালের বদলে যদি রাতে ঘুমাতে যাবার আগে খাওয়া হয় তবে তা হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক থেকে বেশি সুরক্ষা দিতে পারে।
লেবু জল অবিলম্বে উচ্চ রক্তে চাপের পরিমাণকে স্বাভাবিক পরিসরে আনতে সাহায্য করতে পারে। তাই ব্লাড প্রেসার বেড়ে গেলে লেবু পানীয় পান করতে পারেন।
হঠাৎ প্রেশার বেড়ে গেলে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে টক দই কিংবা তেঁতুলের রসও খেতে পারেন।