আমাদের দেহ বিভিন্ন কারণে রোগে আক্রান্ত হয়, কখনো কোনো বহিরাগত ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের প্রভাবে, আবার কখনো কোনো খাবারের কারণে আমাদের দেহের অভ্যন্তরীণ উপাদানগুলোর কাজে বা কোনো অঙ্গের কার্যকারিতার ক্ষেত্রে ব্যাঘাত সৃষ্টি হলেও আমরা নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকি।
তাছাড়াও মস্তিস্ক ও সুষুম্নাকাণ্ডের কোষগুলোর মধ্যে কোনো কারণে কোনো রকম সংক্রমণ হলেও আমাদের দেহে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়, যেমন মেনিনজাইটিস। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা উক্ত রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
মেনিনজাইটিস কি? What is Meningitis?
মস্তিস্ক ও সুষুম্নাকাণ্ডের চারপাশে ঘিরে থাকা যে টিস্যু স্তরের আবরণগুলি এদের সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে সেটি হল মেনিনজেস। এই টিস্যু স্তর ও তার চারিপাশের তরলে সংক্রমণ ঘটলে মস্তিষ্কের প্রদাহ ও ফোলাভাব দেখা দেয়।
সময়মত ধরা না পড়লে এবং চিকিৎসা না হলে এই সমস্যার ফলে প্রাণহানি হতে পারে। পূর্বে এই রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে দিশেহারা হয়ে যেতেন চিকিৎসকরা। মেনিনজাইটিস রোগটিকে সঠিক ভাবে চিহ্নিত করে যথাযথ চিকিৎসা শুরু হয় ১৯৪৪ সালে। বর্তমান সময়ে এই রোগের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন ওষুধ পত্রের পাশাপাশি টিকাও আবিষ্কার হয়ে গেছে।
মেনিনজাইটিস কি কি কারণে হতে পারে, Causes of Meningitis
মেনিনজাইটিস রোগ ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক বা অন্য পরজীবীর সংক্রমণের কারণে হয়ে থাকে। এছাড়াও কিছু ক্ষেত্রে ক্যানসার বা স্বয়ং-অনাক্রম্য (অটোইমিউন) রোগের কারণেও এই রোগ হতে পারে। কারণের উপর ভিত্তি করে মেনিনজাইটিসের প্রকারভেদগুলি হল:
- ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিস
- ভাইরাল মেনিনজাইটিস
- ক্রনিক মেনিনজাইটিস
- ফাংগাল বা ছত্রাকজনিত মেনিনজাইটিস
- প্যারাসাইটিক বা পরজীবী মেনিনজাইটিস
- অ্যামেবিক মেনিনজাইটিস
মেনিনজাইটিস রোগের লক্ষণগুলি কি কি, Symptoms of Meningitis
সাধারণত রোগের লক্ষণ দেখেই চিকিৎসকরা রোগ নির্ণয় করতে পারেন, তাই যেকোনো রোগের লক্ষণ কি কি হতে পারে সেটা জেনে রাখা উচিত, ফলে কিরূপ সমস্যা হলে আমাদের চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত সেটা আমরা বুঝতে পারি।
মেনিনজাইটিস রোগের সাধারণ লক্ষণগুলো হল, জ্বর, মাথাব্যথা, ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া, আলো ও শব্দ অসহনশীলতা, খিঁচুনি ও মুখ দিয়ে শ্লেষ্মা বের হওয়া, বমি বা বমিভাব হওয়া ইত্যাদি। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে এর লক্ষণগুলো কিছুটা ভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন খিটখিটে মেজাজ, খেতে অনীহা, অতিরিক্ত ক্লান্তি, ত্বকে লাল দানা ইত্যাদি। তবে সংক্রমণের কারণের উপর নির্ভর করে এই রোগের লক্ষণ ভিন্নভাবে দেহে প্রকাশ পেতে পারে। সেগুলি হল :
ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিস এর লক্ষণ, Symptoms of bacterial Meningitis
ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিস সৃষ্টি করতে পারে এমন সব ব্যাকটেরিয়াগুলো হল : নেইসেরিয়া মেনিনজিটিডিস (মেনিনগোকক্কাস), হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি ব্যাকটেরিয়া, স্ট্রেপ্টোকক্কাস নিউমোনি (নিউমোকোকাস)।
লক্ষণ :
ব্যাকটেরিয়া জনিত মেনিনজাইটিস রোগের ক্ষেত্রে লক্ষণগুলি হঠাৎ করেই প্রকাশ পায়। এক্ষেত্রে রোগীর যেসব সমস্যা হয়, তা নিম্নরূপ –
* পরিবর্তিত মানসিক অবস্থা
* বমি বমি ভাব
* বমি হওয়া
* আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা
* বিরক্তি, মাথাব্যথা এবং জ্বর
* ঠান্ডাভাব অনুভূত হওয়া
* শক্ত ঘাড়
* ত্বকে বেগুনি অংশের প্রকাশ যা দেখতে ক্ষতের মতো
* তন্দ্রা
* অলসতা ইত্যাদি।
ভাইরাল মেনিনজাইটিসের প্রভাব সাধারণত হালকা হয় এবং প্রায়শই কিছু দিনের মধ্যে নিজেই ঠিক হয়ে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এন্টারোভাইরাস নামে পরিচিত ভাইরাস দ্বারা এই রোগের সৃষ্টি হয়। তবে ভাইরাল মেনিনজাইটিস এর কার্যকারক এজেন্ট হল : এন্টারোভাইরাস, অ্যাডেনোভাইরাস, আরবোভাইরাস, হামের ভাইরাস, ভ্যারিসেলা, হারপিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস, এইচআইভি, ওয়েস্ট নীল ভাইরাস, মাম্পস ভাইরাস ইত্যাদি।
লক্ষণ :
ভাইরাল মেনিনজাইটিসের ক্ষেত্রে যেসব লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা যায় সেগুলি হল :
শিশুদের ক্ষেত্রে :
* ক্ষুধা কমে যাওয়া
* বিরক্তি
* তন্দ্রা
* অলসতা
* জ্বর ইত্যাদি।
প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে :
* মাথাব্যথা
* জ্বর
* শক্ত ঘাড়
* খিঁচুনি
* উজ্জ্বল আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা
* তন্দ্রা
* অলসতা
* বমি বমি ভাব এবং বমি
* ক্ষুধা কমে যাওয়া ইত্যাদি।
ছত্রাকজনিত মেনিনজাইটিসের লক্ষণ, Symptoms of Fungal Meningitis
ছত্রাকজনিত মেনিনজাইটিসের সাথে সম্পর্কিত ছত্রাকগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- ক্রিপ্টোকক্কাস প্রজাতির ছত্রাক, যা ময়লা বা মাটির সাথে মিশে থাকে এবং শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করতে পারে।
- ব্লাস্টোমাইসিস প্রজাতির ছত্রাক।
- হিস্টোপ্লাজমা প্রজাতির ফাংগাস।
- কক্সিডিওইডিস প্রজাতির ছত্রাক।
- ক্যান্ডিডা (ইস্ট)।
- অ্যাসপারগিলাস ইত্যাদি।
লক্ষণ :
ছত্রাকজনিত মেনিনজাইটিসের লক্ষণ ও উপসর্গগুলিও অন্যান্য ধরনের সংক্রমণের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। যথা :
*বমি বমি ভাব, বমি করা।
*আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা
*জ্বর
*মাথাব্যথা
*বিভ্রান্তি ইত্যাদি।
ক্রনিক মেনিনজাইটিস লক্ষণ বা উপসর্গ, Chronic meningitis symptoms
ধীরে ধীরে বর্ধনশীল জীব যথা ছত্রাক এবং মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস জাতীয় সংক্রামকগুলো মস্তিষ্কের চারপাশের ঝিল্লি এবং তরলে সংক্রমণ ঘটানোর ফলে ক্রনিক মেনিনজাইটিস সৃষ্টি হয়। মেনিনজাইটিসের এই ধরন দুই সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় ধরে আমাদের দেহে বিকাশ লাভ করে।
ক্রনিক মেনিনজাইটিসের ক্ষেত্রে যেসব লক্ষণগুলোর প্রকাশ ঘটে, সেগুলো হল – মাথাব্যথা, জ্বর, বমি ইত্যাদি।
প্যারাসাইটিক মেনিনজাইটিসসের লক্ষণ, Symptoms of Parasitic Meningitis
প্যারাসাইটিক বা পরজীবী জনিত মেনিনজাইটিসের বিকাশ আমাদের দেহে ভাইরাল বা ব্যাকটেরিয়াজনিত মেনিনজাইটিসের চেয়ে কম সময় ধরে হয়ে থাকে। এটি মূলত পরজীবী দ্বারা সৃষ্ট হয়, উক্ত পরজীবিগুলো ময়লা, মল এবং শামুক, কাঁচা মাছ, হাঁস-মুরগি ইত্যাদির মধ্যে পাওয়া যায়।
অ্যামেবিক মেনিনজাইটিস, Amoebic meningitis
অ্যামেবিক মেনিনজাইটিস হল প্রাইমারি অ্যামেবিক মেনিনগোএনসেফালাইটিস (পিএএম) নেগ্লেরিয়া ফাউলেরি দ্বারা সৃষ্ট মস্তিষ্কের একটি বিরল এবং বিধ্বংসী সংক্রমণ। উক্ত নেগ্লেরিয়া ফাউলেরি হল একটি মাইক্রোস্কোপিক অ্যামিবা যা উষ্ণ জল এবং মাটিতে বাস করে।
মেনিনজাইটিস রোগনির্ণয় কিভাবে করা হয়, How is meningitis diagnosed?
আমাদের দেহের অভ্যন্তরীণ সংক্রমণ সাধারণত বাইরে থেকে দেখে বুঝতে পারা যায় না, তাই এরূপ সংক্রমণ নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার সাহায্য নিতে হয়। এর কারণ শারীরিক যেকোনো সমস্যার ক্ষেত্রে সঠিক রোগ নির্ণয় করতে পারলেই সঠিকভাবে চিকিৎসা করা সম্ভব।
রোগের লক্ষণগুলো দেখে চিকিৎসকরা বিভিন্ন শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষার ভিত্তিতে রোগ নির্ণয় করে থাকেন। মেনিনজাইটিস রোগ নির্ণয় করার ক্ষেত্রে চিকিৎসক মেরুদণ্ডের পাশাপাশি মাথা, কান, গলা এবং ত্বকের চারপাশের সংক্রমণও পরীক্ষা করেন। উক্ত রোগনির্ণয়ের ক্ষেত্রে যেসব পরীক্ষা করা হয় সেগুলি হল : কম্পিউটারাইজড টোমোগ্রাফি (CT) এম আর আই(MRI), রক্ত পরীক্ষা, চেস্ট এক্স-রে ইত্যাদি।
মেনিনজাইটিস রোগের চিকিৎসা, Treatment of meningitis
সঠিক চিকিৎসার জন্য মেনিনজাইটিস রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী পরজীবি শনাক্ত করা সবচেয়ে জরুরি। সেই কারণের উপর ভিত্তি করেই ব্যাকটেরিয়া নিরোধক (অ্যান্টিবায়োটিক), ভাইরাস নিরোধক ( অ্যান্টিভাইরাল) অথবা ছত্রাক নিরোধক (অ্যান্টিফাঙ্গাল) ঔষধ রোগীকে সুস্থ করে তোলার জন্য ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন লক্ষ্মণের উপর ভিত্তি করে রোগীকে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র খাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।
মেনিনজাইটিস রোগ-প্রতিরোধ করার উপায়গুলি কি কি, What are the ways to prevent meningitis?
পূর্বে উল্লেখিত বিভিন্ন বিষয় থেকে বোঝা যায় যে মেনিনজাইটিস রোগ সৃষ্টিকারী বিভিন্ন পরজীবী যেকোনোভাবেই আমাদের দেহে প্রবেশ করতে পারে, খাবারের মাধ্যমে, শ্বাস প্রশ্বাস নেওয়ার সময় ইত্যাদি যেকোনো উপায়ে আমরা মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারি, তবে এর থেকে বাঁচতে হলে আমাদের সাবধান থাকা উচিত এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে চলাফেরা করা উচিত।
মেনিনজাইটিস রোগ ছড়িয়ে পড়া রোধ করার কিছু উপায় নিম্নে উল্লেখ করা হল :
ক) ভালো করে হাত ধোয়ার অভ্যাস করা উচিত।
খ) স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখতে হবে।
গ) কাশি বা হাঁচি দেওয়ার সময় হাত বা রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকে রাখুন, এবং পরবর্তীতে খুব ভালোভাবে হাত ও রুমাল অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে ধুয়ে নিন।
ঘ) প্রয়োজনে মেনিনজাইটিস প্রতিরোধ করার জন্য টিকা গ্রহণ করুন।
উপসংহার, Conclusion
মেনিনজাইটিস দুরারোগ্য নয়, কিন্তু বাড়তে দিলেই বিপদ। এই রোগের ক্ষেত্রে অল্পবিস্তর সমস্যা দেখা দিলেও হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা করানো দরকার। সর্দি-জ্বর, শ্বাসনালীর সংক্রমণ, কানের ইনফেকশন, টিবি, ইত্যাদি যে কোনও সংক্রমণ থেকেই মেনিনজাইটিসের ঝুঁকি থাকে। তাই সর্বদা সাবধান থাকা উচিত এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে, যাতে সহজে এইধরনের রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু আমাদের দেহে প্রবেশ করে আমাদের কোনো ক্ষতি না করতে পারে।