মানসিক ব্যাধি নিয়ে আমাদের অনেকেরই ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। তাই অনেকেই মানসিক কোনো সমস্যা দেখা দিলেও সহজে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে চান না। কিন্তু মানসিক রোগের চিকিৎসা একজন রোগীর জন্য খুবই প্রয়োজন। কাউন্সেলিং, ওষুধ, থেরাপি ইত্যাদি বিভিন্ন উপায়ে মানসিক রোগের চিকিৎসা করা হয়। মানসিক রোগের ধরণ অনুযায়ী একেক রোগীর জন্য একেক রকম চিকিৎসা হয়ে থাকে। তবে অনেকেই মানসিক রোগের লক্ষণগুলো সম্পর্কে অবগত নন। তাই আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা মানসিক রোগের লক্ষণগুলো নিয়ে আলোচনা করবো।
মানসিক স্বাস্থ্য বলতে কি বোঝো ? What does mental health mean?
মানসিক ব্যাধি একজন ব্যক্তির জ্ঞান, মানসিক নিয়ন্ত্রণ বা আচরণে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। যেকোনো ব্যক্তির সুস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে মনের সুস্থতা বা মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকা অন্যতম জরুরী বিষয়। চিন্তাভাবনা ,আবেগ ও আচরণ; এইসব মিলিতভাবে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ব্যাখ্যা করে। আমরা কখন কি চিন্তা বা দুশ্চিন্তা করছি? কোন পরিস্থিতিতে কি অনুভব করছি? কোন ভাবনায় সারাদিন ধরে ডুবে আছি! এসব বিষয়ই আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে উপস্থাপন করে।
মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা বা রোগ কি ধরনের হয়? What are the types of mental problems or diseases?
অনেকেই এ বিষয় মানতে চান না, কিন্তু মানসিক অসুস্থতা আমাদের জীবনে বহু সমস্যার সৃষ্টি করে। মানসিক অসুস্থতা হল এমন এক ব্যাধি যা মানসিক স্বাস্থ্যের দুরাবস্থাকে ইঙ্গিত করে। একজন ব্যক্তির মেজাজ, আচরণ এবং চিন্তাভাবনাকে এই ব্যাধি প্রভাবিত করতে পারে। মানসিক অসুস্থতা বলতে বিষণ্নতা, উদ্বেগ, আসক্তিমূলক আচরণ বা সাইকোসিসের মতো ব্যাধিকে বোঝায়। কিন্তু আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ এই ব্যাধিকে পাগল হওয়ার লক্ষণ বলেই ধরে নেন। এর কারণ বেশিরভাগ মানুষের কাছে মানসিক অসুস্থতা সংক্রান্ত সমস্যাটি একটি ভুল ধারণার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। অনেকেই এই মানসিক অসুস্থতার ব্যাপারটিকে মানসিক রোগ ও মানসিক ডিসঅর্ডারে জর্জরিত থাকাকেই বোঝেন। তবে মানসিক সমস্যা বা অসুস্থতা বলতে শুধু মানসিক দুর্বলতা বা অস্বাভাবিকতাকেই বোঝায় না, বরং এটি মানসিক ভারসাম্য তথা মনের স্থায়ী অবস্থার অবনতিকেও বোঝায়।
মানসিক রোগীর লক্ষণ, Symptoms of mental illness :
মানসিক রোগীদের মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়, যা সেই ব্যক্তির স্বাভাবিক জীবন থেকে সম্পূর্ণই উল্টো। লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে –
- হীনমন্যতা ভোগ করা।
- সবসময় নিজেকে অন্য ব্যক্তিদের থেকে আলাদা করে রাখা
- হঠাৎ করেই উত্তেজিত হয়ে পড়া।
- একটানা কয়েক সপ্তাহ ধরে বিষন্নতায় ভোগা।
- নিজেকে কোনো বন্ধ ঘরের মধ্যে আটকে রেখে দেওয়া।
- নিজে নিজের সাথে কথা বলা।
- ছোটো ছোটো কারণেই নিজের ক্ষতি করার প্রবণতা এমনকি সুইসাইড করার প্রবণতা।
- নিজেই অযাচিত চিন্তা করে একা একা হাসা ও কাঁদা।
- প্রতিদিনের দৈনন্দিন কাজকর্ম করার ক্ষেত্রে অনীহা প্রকাশ করা।
- খাবারের অরুচি অনুভব হওয়া অথবা স্বাভাবিকের তুলনায় খুব বেশি পরিমাণে খাবারে আগ্রহ।
- কাজ না করার অনীহা।
- মন ভালো হওয়ার মতো জায়গাতে যাওয়া সত্ত্বেও মন ভালো না হওয়া।
- সিদ্ধান্তহীনতা অনুভব করা।
- খিটখিটে মেজাজ হয়ে যাওয়া।
- যেকোনো স্বাভাবিক কথাতেই অকারণে রেগে যাওয়া।
- নিজের প্রতি যত্ন কম হয়ে যাওয়া।
- পরিবার বা আত্মীয়স্বজনকে নিজের শত্রু ভাবা ইত্যাদি।
মানসিক রোগের লক্ষ্মণ দেখা দিলেই ব্যক্তি সবসময় মানসিক রোগী নাও হতে পারে। মানুষের মন ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায়। সময় বিশেষে ভালো লাগা-মন্দ লাগা অনুভব হয়ে থাকে। তাছাড়া হঠাৎ মন খারাপ হওয়া বা নিজের থেকেই মন ভালো হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা অনেকের ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট হরমোনও দায়ী থাকে। তবে উপরের লক্ষণগুলো যদি কোনো ব্যক্তির মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী হয় তবে সাবধান হাওয়া জরুরী।
মানসিক রোগের শারীরিক লক্ষণ কি? What are the physical signs of mental illness?
মানসিক রোগের প্রভাবে আপনি গ্যাস্ট্রিক উপসর্গ, হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি, মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা ইত্যাদি অনুভব করতে পারেন। তাছাড়া যদি সারাদিন ক্লান্তি এবং দুর্বলতা অনুভব করেন এবং ঘুম থেকে উঠে কাজে যাওয়ার ইচ্ছা না থাকে, তাহলে বুঝবেন আপনি হয়তো কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।
মানসিক রোগের প্রকারভেদ, Types of Mental illness :
মানসিক রোগ দুই প্রকার, সেগুলি হল : নিউরোটিক এবং সাইকোটিক।
মানসিক অবসাদে ভুগছেন এমন একজন রোগী যদি মনে করেন যে তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ, অর্থাৎ তিনি নিজের মানসিক অবস্থা নিয়ে অবগত থাকেন তবে তিনি একজন নিউরোটিক রোগী।
অন্যদিকে, একজন রোগী যিনি নানা ধরনের অবাঞ্ছিত দুশ্চিন্তা নিয়ে ভাবতে থাকেন কিন্তু মনে করেন যে তিনি সুস্থ স্বাভাবিক এবং সঠিক চিন্তা করছেন, তাহলে তিনি সাইকোটিক রোগে আক্রান্ত।
এছাড়াও বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু মানসিক সমস্যা দেখা যায়; যেমন অতিরিক্ত চঞ্চলতা, পড়াশোনায় অনীহা, অতিরিক্ত রাগ ইত্যাদি।
নিউরোটিকদের লক্ষণ, Symptoms of Neurotic Patients :
নিউরোটিক রোগীদের ক্ষেত্রে লক্ষণগুলোর মধ্যে আসে ডিপ্রেশন বা হতাশা, অ্যাংজাইটি বা উদ্বেগজনিত রোগ, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার বা শুচিবাই ইত্যাদি।
মানসিক অবসাদের বৈশিষ্ট্য গুলো হল :
- মন খারাপ বোধ হওয়া বা কিছুই না লাগা।
- আত্মবিশ্বাস বা মনের জোরের ঘাটতি অনুভব হওয়া।
- হঠাৎ কান্না পাওয়া বা একা একা বসে থাকলে বিভিন্ন চিন্তা ভাবনা করতে গিয়ে চোখে জল আসা।
- দৈহিক শক্তি কমে যাওয়া।
- ঘুম হঠাৎ করে কমে বা বেড়ে যাওয়া।
- বিরক্তি ভাব বেড়ে যাওয়া।
তাছাড়াও, মানসিক রোগের উদ্বেগজনিত বৈশিষ্ট্য গুলো হল :
- সবসময় অতিরিক্ত অযৌক্তিক চিন্তা।
- শারীরিক ও মানসিক অস্থিরতা অনুভব করা।
- অতিরিক্ত ক্লান্তি বোধ হওয়া।
- ঘুম কম হয়ে যাওয়া।
- হঠাৎ বুক ধড়ফড় করা, গলা শুকিয়ে যায় বা হাত পা হঠাৎ করে কাঁপতে শুরু করে।
সাইকোটিক রোগীদের লক্ষণ, Symptoms of Psychotic patients:
সিজোফ্রেনিয়া এবং ডলিউশনাল ডিজঅর্ডার হল সাইকোটিক রোগীদের ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা।
সিজোফ্রেনিয়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো :
- সন্দেহপ্রবণতা,
- অতিরিক্ত রাগ ,
- একা একা কথা বলা বা বিড়বিড় করা,
- অস্বাভাবিক ব্যবহার,
- বিভিন্ন রকমের অঙ্গভঙ্গি করা,
- রাতে ঘুম না হওয়া ইত্যাদি।
ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশতার সমস্যার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হল :
- ভুলে যাওয়া,
- লোকজনকে চিনতে না পারা,
- মনে রাখতে না পারা,
- হঠাৎ রেগে যাওয়া,
- ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি।
মানসিক সমস্যা হলে কি করা উচিত? What should be done if there is a mental problem?
মানসিক রোগের জন্য একটি প্রধান চিকিৎসা হল সাইকোথেরাপি। এটি বিভিন্ন ধরনের হয়। মানসিক সমস্যা হলে সাধারণত জ্ঞানীয় আচরণগত থেরাপি (CBT) ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এটি মূলত একটি নির্দিষ্ট ব্যাধির সঙ্গে যুক্ত ধারণা এবং আচরণের নিদর্শন পরিবর্তন করার উপর ভিত্তি করে এই থেরাপি দেওয়া হয়।
মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার জন্য কিছু মৌলিক সক্রিয় কৌশল, Here are some basic proactive strategies for mental health care :
আমাদের মন এবং আবেগ সুস্থ আছে তা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমাদের শরীরের যত্ন না নিয়ে এটি করা অসম্ভব। তাই চেষ্টা করুন নিত্যদিন যথেষ্ট সক্রিয় থাকার। পর্যাপ্ত ঘুম, ব্যায়াম এবং পুষ্টি নিশ্চিত করার মাধ্যমেই মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য সঠিক রাখা সম্ভব।
বন্ধু বা পরিবারের সাথে মানসম্পন্ন সময় কাটানো, আমরা কেমন অনুভব করছি সে সম্পর্কে কারো সাথে কথা বলা বা অন্য লোকেদের সাহায্য করার উপায় খুঁজে বের করা সবই আপনাকে একাকী বোধ করা থেকে বিরত রাখতে এবং আপনার মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার উন্নতি করতে সাহায্য করতে পারে।
শেষ কথা, Conclusion :
মানসিক স্বাস্থ্য হল একটি জটিল সমস্যা যা পরিবেশ, অভিজ্ঞতা, পরিবার এবং লালন-পালনের মতো বিষয়গুলি দ্বারা প্রভাবিত হয় যা একজন ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের ফলাফলে অবদান রাখতে পারে। এই বিষয়গুলি বুঝা এবং মোকাবেলা করে আরও ভাল মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা অর্জনে সহায়তা করতে পারে । বর্তমানের উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং ওষুধের দ্বারা উপরোক্ত সকল রোগ গুলোর ক্ষেত্রে চিকিৎসা করলে সহজেই মুক্তি পাওয়া যায়।
Frequently Asked Questions :
আমরা কখন কি চিন্তা বা দুশ্চিন্তা করছি? কোন পরিস্থিতিতে কি অনুভব করছি? কোন ভাবনায় সারাদিন ধরে ডুবে আছি! এসব বিষয়ই আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে উপস্থাপন করে।
গ্যাস্ট্রিক উপসর্গ, হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি, মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা ইত্যাদি
পর্যাপ্ত ঘুম, ব্যায়াম এবং পুষ্টি নিশ্চিত করা উচিত