মাইগ্রেন কথাটি শুনলে মানুষ মাথা ব্যথা বলেই বোঝেন। এই মাইগ্রেন হল একটি খুব সাধারণ স্নায়বিক সমস্যা। মাইগ্রেনের মাথাব্যথা স্বাভাবিক মাথাব্যথার চেয়ে বেশি তীব্র হয়। তবে মাইগ্রেনের ব্যথা খুব তীব্র আর যন্ত্রণাদায়ক হলেও এটি মারাত্মক কোনো রোগ নয়। এই রোগ থেকে পরিত্রাণ নয়, এটিকে নিয়ন্ত্রণে রেখেই চলতে হবে। অনেকেই মাইগ্রেইনের সমস্যার বিষয়ে সঠিকভাবে জানেন না। তাই আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা মাইগ্রেন নিয়ে আলোচনা করবো।
মাইগ্রেন কী ? What is Migraine ?
মাইগ্রেন হলো মাথার একপাশে কম্পন দিয়ে মাঝারি বা তীব্র ধরনের ব্যথা। কখনো কখনো এই ব্যথা মাথার একপাশে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে ওই পাশের পুরো স্থান জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আবার মাইগ্রেনের সমস্যায় কখনো কখনো ব্যাথার সঙ্গে দৃষ্টি বিভ্রম বা বমি বমি ভাবও থাকতে পারে।
মাইগ্রেন কি প্রদাহজনিত রোগ? Is migraine an inflammatory disease?
মাইগ্রেন প্যাথোফিজিওলজি হল নিউরন, গ্লিয়াল সেল, ভাস্কুলেচার এবং প্রদাহজনক সিগন্যালিং এর মিথস্ক্রিয়া , যা একটি অত্যন্ত দুর্বল স্নায়বিক ব্যাধিতে পরিণত হয় যা বারবার একতরফা মাথাব্যথা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।
মাইগ্রেনের লক্ষণসমূহ, Migraine Symptoms :
মাইগ্রেনের প্রধান লক্ষণ হচ্ছে মাথার যেকোনো একপাশে মাঝারি থেকে তীব্র ব্যথা অনুভব হওয়া। অনেক সময় ব্যথার তীব্রতা বেশি হয়ে যায়, ফলে বমি বমি ভাবও হতে পারে। এসব ছাড়াও আরও কিছু লক্ষণ থাকে। যথা :-
- ঘাম,
- মনোযোগহীনতা,
- অনেক বেশি গরম বা অনেক বেশি ঠান্ডা অনুভব হওয়া,
- পেট ব্যাথা বা ডায়রিয়া।
এসব লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
মাইগ্রেনের সমস্যা কেন হয় ? Why does migraine occur?
- মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক কার্যক্রমের প্রভাবেও মাইগ্রেন হয়ে থাকে। যখন স্নায়ু ব্যবস্থা, শরীরের রাসায়নিক উপাদান এবং রক্তনালিকে আক্রান্ত করে ফেলে, তখনই এই ধরনের তীব্র ব্যথা মাথার একপাশে অনুভূত হয়।
- হরমোনজনিত পরিবর্তন মাইগ্রেন এর একটি কারণ হতে পারে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে ঋতুচক্রের সময় নারীরা মাইগ্রেনে বেশি ভোগেন। সাধারণত আবেগ বা অন্যান্য কারণ ও মাইগ্রেনের পেছনে ভূমিকা রাখে। যথা: মানসিক চাপ, উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, হঠাৎ পাওয়া আঘাত ইত্যাদি।
- অনেক সময় শারীরিক বিভিন্ন কারণেও হতে পারে মাইগ্রেন। যথা: ঘুম কম হওয়া বা রাতে ঘুম না হওয়া, কোনো কারণে হঠাৎ করে অতিরিক্ত পরিশ্রম করা ইত্যাদি।
- পরিবেশগত কিছু কারণ এর প্রভাবেও মাইগ্রেন হতে পারে। হঠাৎ করে গরম থেকে ঠান্ডা বা ঠান্ডা থেকে গরম পরিবেশে গেলে মাইগ্রেনের সমস্যা শুরু হতে পারে৷
- অনেক সময় খাদ্যাভ্যাসও মাইগ্রেন সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। খাবারে বিভিন্ন কারণে অনিয়ম করা, জলশূন্যতায় ভোগা, মদ্যপান করা, কাজের চাপে মাঝে অতিরিক্ত চা বা কফি পান করা এসব নানা ধরনের অনিয়ম মাইগ্রেন হওয়ার পেছনে ভূমিকা পালন করতে পারে।
- দীর্ঘক্ষণ উপোস করলে বা সময়মতো খাদ্যগ্রহণ না করলে এছাড়া অতিরিক্ত চকোলেট, পনির ও বেশি ফ্যাটযুক্ত দুগ্ধজাত খাবার থেকে মাইগ্রেন হতে পারে।
- মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং বিষণ্নতা মাইগ্রেনের আক্রমণের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে।
- স্লিপ অ্যাপনিয়া, উচ্চ রক্তচাপ এবং দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা ইত্যাদি স্বাস্থ্য সমস্যা মাইগ্রেনের সাথে যুক্ত হতে পারে।
- কথা বলতে অসুবিধা এবং বিশৃঙ্খলা।
- অদ্ভুত গন্ধ অনুভব হওয়া বা কানে রিনরিন শব্দ শোনা।
মাইগ্রেন হলে কি নাক দিয়ে রক্ত পড়ে? Does migraine cause nose bleeding?
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে মাইগ্রেনে আক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্কদের উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি নাক দিয়ে রক্ত পড়ে । অনুসন্ধানগুলি আরও পরামর্শ দেয় যে নাক দিয়ে রক্ত পড়া মাইগ্রেনের পূর্বসূরি হতে পারে, তবে এই ক্ষেত্রে আরও গবেষণা প্রয়োজন।
যেসব খাবারে বাড়তে পারে মাইগ্রেন, Food that can trigger migraines :
পনির, চকোলেট, রেড ওয়াইন, সয়াসস, মেটে, ডিম, কমলালেবু, ডুমুর, কলা, টম্যাটো, কিশমিশ ইত্যাদি মাইগ্রেন রোগীরা এড়িয়ে চলতে পারেন বা পরিমাণে কম খাবেন। এর কারণ হল এইসব খাবারে থাকে টাইরামিন নামে রাসায়নিক পদার্থ; যা মস্তিষ্কের রক্তনালির সংকোচন ঘটিয়ে মাইগ্রেনের ব্যথা বাড়ায়।
এছাড়াও কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাবার কম খেতে হবে। পাশাপাশি ফাস্ট ফুড, চাইনিজ ফুড, দুধ, চা, কফি, সাইট্রাস ফল, লেবু জাতীয় ফল, আনারস, নারিকেল ইত্যাদিও পরিমাণে কম খাওয়া উচিত। সফট ড্রিঙ্ক (যেমন পেপসি, ফ্যানটা), ক্যানড ফ্রুট, জুস, স্যুপ, প্যাকেজড স্যুপ খাওয়া যাবে না।
মাইগ্রেনের ঘরোয়া চিকিৎসা, Home Remedies for Migraine :
মাইগ্রেনের সঠিক কোনো চিকিৎসা নেই। তবে কিছু বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ রাখার মাধ্যমেই এই সমস্যা দমন করা যায়। মাথাব্যথার তীব্রতা, ধরন একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম হতে পারে।
বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে, মাইগ্রেন রোগীদের মস্তিষ্কে ম্যাগনেশিয়াম কম থাকে। সেক্ষেত্রে, নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাপন মাইগ্রেনকে এড়িয়ে চলতে অনেকাংশে সাহায্য করে।
মাইগ্রেনের ঘরোয়া চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে :
- চেষ্টা করুন প্রতিদিন একই সময় ঘুমানোর। প্রতিদিন অন্তত ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত।
- বেশি আলো বা কম আলোতে কাজ করা যাবে না।
- তীব্র ঠান্ডা যুক্ত স্থানে অথবা অতিরিক্ত রোদে বাইরে বের হাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
- স্বাভাবিক শব্দের চেয়ে বেশি শব্দ হচ্ছে অথবা অতিরিক্ত কোলাহল পূর্ণ এলাকায় না যাওয়া ভালো।
- মোবাইল বেশিক্ষণ ব্যবহার করা যাবে না।
- মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রচুর জল পান করতে হবে।
- মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হলে মাথায় ঠান্ডা কাপড় জড়িয়ে রাখতে পারেন।
- রোজ ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট হাঁটা খুবই জরুরি।
- অল্প করে, দু’ঘণ্টা অন্তর খাবার খেতে হবে।
- মাইগ্রেনের ব্যথা বাড়ে সেই খাবারগুলি খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে।
- আদা চা খাওয়া মাইগ্রেনের তীব্রতা কমাতে সাহায্য করতে পারে।
- মাইগ্রেনের আক্রমণ হলে কপালে বা ঘাড়ে কোল্ড কম্প্রেস লাগালে জায়গাটিকে অসাড় করতে এবং ব্যথা কমাতে সাহায্য করতে পারে।
- ম্যাগনেসিয়ামের পরিপূরক খাদ্য গ্রহণ করলে মাইগ্রেন থেকে ত্রাণ পাবেন।
- মাইগ্রেনের ব্যথা উঠলে বেশির ভাগ মানুষ ঘর অন্ধকার করে বিশ্রাম নিলে বা ঘুমালে কিছুটা আরাম বোধ করতে পারেন।
- মাথায় ভেষজ তেল বা স্থানীয় ব্যথানাশক মালিশ করেও খানিকটা পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।
গর্ভাবস্থায় কীভাবে মাইগ্রেন নিরাময় করা যায় ? How to cure migraine during pregnancy?
গর্ভাবস্থায় মাইগ্রেন এড়াতে এবং এই সমস্যা থেকে উপশম পাওয়ার কিছু সহজ উপায় হল :
- হাইড্রেটেড থাকা,
- প্রসবপূর্ব যোগব্যায়ামের মাধ্যমে মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা করা,
- ক্যাফেইন গ্রহণ কম করা,
- পর্যাপ্ত ঘুম।
মাইগ্রেন নিয়ে সতর্কতা, Migraine Precautions :
মাইগ্রেন থাকলে উচ্চ মাত্রার ব্যথা নাশক ওষুধ সেবন থেকে বিরত থাকুন। কোনো ধরনের ব্যথানাশক ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া গ্রহণ করা উচিত নয়। সাময়িক সময়ের জন্য এই ঔষধগুলো আরাম দিলেও এগুলো সময়ের সঙ্গে মাইগ্রেনের চিকিৎসাকে অনেক বেশি কঠিন করে তোলে। তাই মাইগ্রেন হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করাই শ্রেয়।
দীর্ঘদিন ধরে মাইগ্রেনের সমস্যায় ভুগলে হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের মতো অনেক গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাই এই সমস্যাটির সময়মতো নির্ণয় এবং চিকিৎসা করা উচিত।
শেষ কথা, Conclusion :
মাইগ্রেনের স্থায়ী কোনো চিকিৎসা নেই। কিছু খাবারদাবার বেছে চললে, জীবনযাপনের কিছু নিয়ম মানলে এই ব্যথার প্রকোপের হার কমানো সম্ভব। তীব্র ব্যথা শুরু হলে অন্ধকার জায়গায় বিশ্রাম নিলে, পর্যাপ্ত তরল খাবার খেলে খানিকটা আরাম বোধ করতে পারেন।
অনেকেই এমন আছেন যারা মাইগ্রেনের সমস্যায় ভুগছেন। কিন্তু তাদের ব্যস্ত জীবনে এই সমস্যা সমাধান করা নিয়ে চিন্তার সময় হয় না। এর ফলে এই সমস্যা সময়ের সাথে বেড়ে যায় এবং অন্যান্য বিভিন্ন শারীরিক ব্যাধির সৃষ্টি করতে পারে। তাই নিজের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারা নিয়ন্ত্রণ করুন।
Frequently Asked Questions
মাইগ্রেন হলো মাথার একপাশে কম্পন দিয়ে মাঝারি বা তীব্র ধরনের ব্যথা। কখনো কখনো এই ব্যথা মাথার একপাশে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে ওই পাশের পুরো স্থান জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
মাথা ব্যাথা,
ঘাম,
মনোযোগহীনতা,
অনেক বেশি গরম বা অনেক বেশি ঠান্ডা অনুভব হওয়া,
পেট ব্যাথা বা ডায়রিয়া
বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে, মাইগ্রেন রোগীদের মস্তিষ্কে ম্যাগনেশিয়াম কম থাকে। সেক্ষেত্রে, নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাপন মাইগ্রেনকে এড়িয়ে চলতে অনেকাংশে সাহায্য করে।