শীতকালে বেশিরভাগ মানুষের মুখে শরীরে ব্যথা হওয়ার কথা শোনা যায়। বিশেষত বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা দেখা দেয়। অনেকে এমনও আছে যারা ঘাড়ে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করে। কোনো কোনো সময় ঘাড় ও কাঁধের অংশে তীব্র ব্যথার সঙ্গে যুক্ত হয় হাতের আঙুলে ঝিনঝিন অনুভূতি। এসব সমস্যা থেকে বাঁচার উপায় কি? অনেকের মনেই হয়তো এই প্রশ্ন আসে। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা ঘাড় ব্যথা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
ঘাড় ও কাঁধে ব্যথা হওয়ার ঝুঁকি কাদের ক্ষেত্রে বেশি, Who is more at risk of neck and shoulder pain?
ঘাড় ও কাঁধে ব্যথা খুবই সাধারণ ঘটনা। সামনে ঘাড় ঝুঁকিয়ে কাজ করতে হয়, এমন সব পেশার মানুষদের এ রোগ বেশি দেখা যায়। শুধু চেয়ার–টেবিলে বসে কাজ করেন, যেমন ব্যাংকার, নির্বাহী; কম্পিউটারে একনাগাড়ে কাজ, ঘাড়ে ঝাঁকুনি লাগে, এমন পেশা, যেমন মোটরসাইকেল বা সাইকেলচালকদেরও এ রোগ হতে পারে। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই রোগের ঝুঁকি বাড়ে। মূলত স্পাইনাল কর্ড এর হাড়ের ক্ষয় শুরু হয় বলেই এই সমস্যা দেখা যায়।
ঘাড় ও কাঁধে ব্যথার ক্ষেত্রে সাধারণত যেসব সমস্যা দেখা যায়, Common problems with neck and shoulder pain
- ঘাড়ের ব্যথা অনেক সময় কাঁধ থেকে ওপরের পিঠ, বুক, মাথার পেছনে বা বাহু হয়ে হাত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
- ব্যথা ঘাড় থেকে হাতে ছড়িয়ে পড়ে যদি স্নায়ু বা নার্ভের ওপর চাপ পড়ে।
- সার্ভিক্যাল স্পন্ডোলাইসিসের সমস্যা হলে তা সবচেয়ে গুরুতর হয়ে দেখা দেয় যখন স্পাইনাল কর্ডের ওপর কোনো কারণে চাপ পড়ে। তখন অনেকের হাত–পায়ে দুর্বলতা, হাঁটতে অসুবিধা হতে পারে। ঘাড় নাড়াতে সমস্যা এবং ডানে–বাঁয়ে ঘাড় ঘোরাতে সমস্যা হয়।
- ব্যথার সঙ্গে হাতে, বাহুতে হতে পারে ঝিনঝিন, শিরশির, অবশ ভাব, সুচ ফোটানোর অনুভূতি। হাত দিয়ে কোনো কাজ করতে অসুবিধা হয়।
কেন ঘাড়ব্যথা হয়, What causes shoulder pain?
সাধারণত যেসব কারণে ঘাড় ব্যথা হতে পারে সেগুলি হল :
- বয়সের সাথে ঘাড়ের টিস্যু ক্ষয় হয়। তাছাড়া দীর্ঘসময় ধরে চেয়ার টেবিলে বসে, ল্যাপটপের সামনে বসে যারা কাজ করেন, তাদের এই সমস্যা বেশি হয়। এতে ঘাড়ের মধ্যকার হাড়ে ফাঁক থেকে যায়। সারভাইকাল স্পন্ডেলাইটিস (ঘাড়ে মেরুদণ্ডের অংশে হাড়ক্ষয়) এর সমস্যা থাকলেও ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে।
- কোনো কারণে যদি স্পাইনাল কর্ডের টিস্যু ফুলে যায়, তবে স্লিপ ডিস্ক হতে পারে। এর থেকেও ঘাড়ে ব্যথা হয়।
- কোনো দুর্ঘটনায় ঘাড়ে আঘাত পেলে সেই ব্যথা বহুদিন স্থায়ী হতে পারে। সেক্ষেত্রে পেশিতে টান লাগলে মাঝেমধ্যেই ব্যথা বাড়ে।
- বসার ভঙ্গিতে বা ঘুমানোর ভঙ্গিতে ত্রুটি থাকলে ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে।
- মানসিক অবসাদ ও দুশ্চিন্তা থেকেও অনেক সময় স্নায়ুর সমস্যা থেকে ঘাড়ের ব্যথা হতে পারে।
- বিছানায় শুয়ে বই পড়া, টিভি দেখা বা উপুড় হয়ে ল্যাপটপে কাজ করার সময় ঘাড়ের পেশিতে টান লেগে ব্যথা হয়।
- কারও পেশি দুর্বল হলে তারা যদি দীর্ঘক্ষণ একভাবে একজায়গায় বসে থাকে তবে পেশিতে খিল ধরে এবং ঘাড়ে ও কাঁধে ব্যথা হয়। এই একভাবে বসে থাকতে গিয়ে আচমকা টান লেগেও ব্যথা হতে পারে।
ঘাড় ব্যথার প্রতিকার, Remedies for shoulder pain
প্রতিদিনকার রুটিনে বিশেষ কিছু অভ্যাসের পরিবর্তন আনলেই সাধারণ ঘাড়ব্যথার প্রতিকার করা যায়। ঘাড় ব্যথার সমস্যা থেকে দূরে থাকতে যা যা করবেন :
- ঘুমানোর সময় না পারলেও অন্তত বসার সময় শারীরিক ভঙ্গি স্বাস্থ্যকর রাখুন। বসে থাকার সময় আপনার মেরুদণ্ড যেন সরলরেখায় থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখুন।
- দীর্ঘ সময় একটানা বসে কাজ না করে বরং এক ঘণ্টা পর পর ১০ মিনিট বিরতি নিন। বসা অবস্থায় না থেকে উঠে পড়ুন, একটু হেঁটে আসুন এবং ঘাড় ও কাঁধ সামনে–পেছনে প্রসারিত করুন।
- কাজের টেবিল–চেয়ার ও কম্পিউটারের সামঞ্জস্য এভাবে রাখুন যেন মনিটর চোখের স্তরের সমান থাকে। টেবিলে কুঁজো হয়ে বসবেন না।
- মুঠোফোনে কথা বলার সময় কান ও কাঁধের মধ্যে ফোনটি ঠেকিয়ে রেখে কথা বলবেন না। প্রয়োজনে হেডফোন বা ফোনের স্পিকার ব্যবহার করুন।
- কাঁধের ওপর ভারী জিনিস তথা ভারী ব্যাগ বহন এড়িয়ে চলুন। অতিরিক্ত ওজন ঘাড়ে চাপ সৃষ্টি করে যার ফলে ব্যথা হয়।
- ঘুমানোর সময় ঘাড়ের নিচে বালিশ দিন। মাঝারি-শক্ত সমান বিছানায় এক বালিশে চিত হয়ে ঘুমানো উচিত। কম উচ্চতার বালিশ ব্যবহার করুন, যাতে আপনার মেরুদণ্ডের পেশি সমতল থাকে।
- নিয়মিত ঘাড়ের ব্যায়াম করুন। ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘাড় ঘোরাবার চেষ্টা করুন। সব বয়সের মানুষেরই প্রতিদিন ঘাড়ের ব্যায়াম করা উচিত।
- নিজেকে চিন্তামুক্ত রাখুন, কারণ মানসিক অবসাদ, দুশ্চিন্তা থেকেও ঘাড়ের ব্যথা আসে।
ঘাড়ব্যথা কমাতে করণীয়, What to do to reduce neck pain?
- ঘাড়ের ব্যথা বেশি থাকলে গাড়ি চালানো, সাইকেল চালানো, অন্য কোনো ভারী কাজ করবেন না। এতে ব্যথা বেড়ে যেতে পারে।
- কেন ঘাড়ে ব্যথা সেই কারণ জানার চেষ্টা করুন। স্পন্ডেলাইটিস ছাড়া অন্য কারণ হতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিজে ঘাড়ে কলার পরতে যাবেন না। নিজের ইচ্ছেমতো কোনো পেনকিলার খাবেন না। ব্যথা একসপ্তাহের বেশি হলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
- ব্যথার স্থানে আইসব্যাগ ব্যবহার করতে পারেন। একটি আইস প্যাক বা বরফে তোয়ালে জড়িয়ে দিনে কয়েকবার লাগাতে পারেন।
- গরম জল দিয়ে স্নান করুন। হট ওয়াটার ব্যাগ, ইলেকট্রিক্যাল হিটিং প্যাড কিংবা ইনফ্রারেড ল্যাম্প ব্যবহার করে গরম সেঁক দিতে পারেন।
- সাধারণ ঘাড়ব্যথা ম্যাসাজেও নিরাময় হয়। তবে প্রশিক্ষিত ব্যক্তিকে দিয়ে করাতে হবে। সেলুনে কখনোই ঘাড় ম্যাসাজ করে নেবেন না। কোনো ভালো ফিজিওথেরাপিস্ট এর কাছে গিয়ে থেরাপি নিতে পারেন অথবা ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ঘাড়ের মালিশ দিয়ে ম্যাসাজ করতে পারেন। ঘাড়ের টানটান পেশিগুলোকে শিথিল করতে মালিশ অত্যন্ত কার্যকর ব্যবস্থা। তবে মালিশ করতে হবে ধীরে ধীরে। মাংসপেশিকে জোর দেওয়া যাবে না, নয়তো ক্ষতি হতে পারে।
- আপেল ভিনেগার ব্যথার স্থানে লাগাতে পারেন। এর অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি বৈশিষ্ট্য ঘাড়ের পেশির স্ট্রেস হ্রাস করতে সহায়তা করবে এবং ব্যথা উপশম করবে। একটি টিস্যু পেপার আপেল সিডার ভিনেগারে ভিজিয়ে নিয়ে সেটা আধা ঘণ্টা ঘাড়ের ওপর রেখে দিন। দিনে দুবার এভাবে করতে থাকুন।
ঘাড়ব্যথা কমাতে নিম্নে উল্লেখ করা আসনগুলো অভ্যাস করতে পারেন, practise these asanas mentioned below to reduce neck pain
ভরদ্বাজাসন: ঘাড় ও কাঁধব্যথা উপশমে খুব কার্যকর যোগাসন।
বালাসন: আসনটি আপনার ঘাড় এবং পেছন প্রসারিত করবে।
শবাসন: নিয়মিত এ আসন করলে ঘাড়ব্যথা থেকে চিরতরে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
এসব ছাড়াও কিছু ব্যায়ামের মাধ্যমে ঘাড়ের মাংসপেশিকে শক্তিশালী করা যায়। তবে এসব ব্যায়াম করতে হবে প্রাথমিক ব্যথা মিলিয়ে যাওয়ার পর। এক্ষেত্রে যা করতে হবে :
- হাত দুটি একসঙ্গে করে মাথার সামনের দিকে ঠেকিয়ে চাপ দিতে হয়। মাথা দিয়ে হাতের উপরও চাপ দিন, এভাবে হাতের ওপর মাথার চাপ বাড়বে, তবে হাত দুটিও মাথার ওপর সমান চাপ দেবে।
- একইভাবে হাত দুটি মাথার পেছনে নিয়ে মাথাটাকে পেছন দিকে চাপ দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে হাত দুটিও যেন মাথায় চাপ দেয়।
- হাত যত জোরে মাথার দিকে চাপ দেবে, মাথাটাকে তত জোরে বিপরীত দিকে ঠেলতে হবে। অন্যদিকে শক্ত পেশি শিথিল করতে যেভাবে ব্যায়াম করতে হবে :
প্রাথমিক ব্যথা সেরে যাওয়ার পর পিঠের উপরি অংশ ও কাঁধের পেশি শিথিল করতে কিছু ব্যায়াম করতে পারেন-
- * এক্ষেত্রে মাথাটাকে বামে ও ডানে ঘোরান।
- * মাথাটাকে একবার সামনের দিকে আনবেন। তারপর পেছনের দিকে নেবেন।
- * মাথা ঘড়ির কাঁটার দিকে কয়েকবার এবং ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে কয়েকবার ঘোরাবেন।
- * কাঁধ দুটি একবার ওপরের দিকে তুলবেন এবার নামাবেন। তারপর কাঁধ দুটিকে ঘোরাবেন। এভাবে কয়েকবার করুন।
- * হাত দুটিকে নিজের দুই কাঁধের ওপর স্থাপন করে কনুই দুটি বৃত্তাকারে ঘুরানোর চেষ্টা করুন।
ঘাড় ব্যথা উপশমে এই ব্যায়ামগুলো কার্যকরী।
শেষ কথা, Conclusion
ঘাড় খুব বেশি ব্যথা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধ খান। বাড়িতে মলম, স্প্রে রাখুন। ব্যথা বাড়লে ম্যাসাজ করে গরম সেঁক দিতে পারেন। প্রয়োজনে ফিজিওথেরাপি করুন। মেরুদন্ড সোজা ও ক্ষতি থেকে দূরে রাখতে আগে থেকেই সাবধানতা অবলম্বন করুন।