পাইলস বা অর্শরোগ একটি অতি পরিচিত স্বাস্থ্য সমস্যা। অনেকেই এই সমস্যা নিয়ে কারও কাছে কোনো পরামর্শ চাইতে বা ডাক্তার দেখাতে সংকোচ বোধ করেন। অবহেলার কারণে পাইলস ক্রমশ জটিল আকার ধারণ করে। তাই এই রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে সচেতন হওয়া জরুরি। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা পাইলস রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো এবং এর ব্যথা কমানোর কিছু উপায় বলে দেবো।
পাইলস এর লক্ষণগুলি, symptoms of piles
পাইলস বা অর্শ রোগের মূলত চারটি লক্ষণ দেখা যায়, তবে কিছুক্ষেত্রে ভিন্ন রোগীর ভিন্ন ধরনের সমস্যা হতে পারে। পাইলস এর অন্যতম চারটি লক্ষণ হল :
১. পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়া :
কারও যদি পাইলস এর সমস্যা থাকে তবে তাদের পায়খানার সাথে তাজা রক্তও নির্গত হতে পারে। পাইলস হলে পায়খানার সময় পায়ুপথের মুখে থাকা অ্যানাল কুশনগুলো থেকে রক্তক্ষরণ হয়।
![পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়া](https://okbangla.com/wp-content/uploads/2023/11/pi2.jpeg)
২. পায়ুপথের মুখের অংশগুলো বাইরের দিকে বেরিয়ে আসা :
পাইলস বা অর্শ রোগ হলে সাধারণত মলত্যাগের পরে দেখা যায় যে পায়ুপথের অ্যানাল কুশনগুলো নরম গোটার মতো বাইরে বের হয়ে আসে। কিছু সময় পর এগুলো আবার নিজে নিজেই ভেতরে ঢুকে যায়।
৩. পায়খানার রাস্তায় ব্যথা অনুভব হওয়া :
পাইলস রোগ হলে পায়ুপথের অ্যানাল কুশনগুলো বাইরে বের হওয়ার কারণে সেগুলোতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে অনেক সময় তীক্ষ্ণ বা তীব্র ব্যথা হতে পারে। এই ব্যথা বেশি হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
৪. পায়খানার রাস্তায় চুলকানি অনুভব হওয়া :
পাইলস বা অর্শ রোগ হলে অনেক সময় পায়ুপথে বা এর মুখের আশেপাশে চুলকানি অনুভব হতে পারে। কখনো কখনো পায়ুপথ দিয়ে মিউকাস বা শ্লেষ্মা-জাতীয় পিচ্ছিল ও আঠালো পদার্থ বের হতে পারে।
![পায়খানার রাস্তায় চুলকানি অনুভব হওয়া](https://okbangla.com/wp-content/uploads/2023/11/pi3.jpeg)
পাইলস কি কারণে হয়? What are the causes of piles?
পাইলস হওয়ার মূল কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল : পারিবারিক ইতিহাস, আঁশযুক্ত খাবার কম খাওয়া, ভারি মালপত্র বহন করা, স্থুলতা, কায়িক শ্রম কম করা। তবে কিছু কিছু বিষয় পাইলস এর ঝুঁকি আরো বাড়ায়, পাশাপাশি কারও যদি পাইলস রোগ হয়ে থাকলে তার তীব্রতাও বাড়িয়ে দেয়, যেমন :
• শক্ত বা কষা পায়খানা হওয়া।
• মলত্যাগ করার সময় জোরে চাপ দেওয়া।
• অনেক সময় ধরে মলত্যাগের জন্য দীর্ঘক্ষণ ধীরে কসরত করা।
• পায়খানার বেগ আটকে রাখার অভ্যাস।
• শারীরিক পরিশ্রম না করা।
• অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি হয়ে যাওয়া।
![অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি হয়ে যাওয়া](https://okbangla.com/wp-content/uploads/2023/11/pi4.jpeg)
এছাড়াও গর্ভাবস্থায় অন্যান্য শারীরিক পরিবর্তনের কারণেও অনেকের ক্ষেত্রে পাইলস এর ঝুঁকি বেড়ে যায়।
পাইলস এর ব্যথা সারানোর কিছু সাধারণ উপায়, Some common remedies for piles pain are:
পাইলস এর ব্যথা উপশম করার জন্য অনেকেই প্যারাসিটামল ঔষধ ব্যবহার করেন, তবে এই ব্যথায় কার্যকরী বেশ কিছু ঔষধ ও মলম পাওয়া যায়, যা ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবহার করতে পারেন। অন্যদিকে কিছু ঘরোয়া পদ্ধতিতেও অর্শ রোগের ব্যথা কম করা যায়, সেই উপায়গুলো নিচে তুলে ধরা হলো—
- ১. যে স্থানে ব্যাথা হচ্ছে সেই অংশটি কুসুম গরম জলে ভিজিয়ে রাখতে পারেন। ছোট বাচ্চাদের স্নান করানোর জন্য যে বড় গামলা ব্যবহৃত হয় তেমন কোনো পাত্রে কুসুম গরম জল নিয়ে সেখানে বসে থাকতে পারেন। দিনে ৩ বার পর্যন্ত এটি করতে পারেন।
- ২. কোথাও বসতে গেলে একটি বালিশ ব্যবহার করে সেটার ওপর বসুন।
- ৩. একটা প্যাকেটে কিছু বরফ নিন, তারপর সেটা তোয়ালে দিয়ে পেঁচিয়ে নিয়ে পায়ুপথে গোটাগুলোর ওপরে লাগিয়ে রেখে দিন। এভাবে অনেক আরাম পাওয়া যাবে।
- ৪. বিছানায় শুতে গেলে পা উঁচু করে রাখুন, যাতে পাইলস এর গোটাগুলোতে রক্ত চলাচল সহজে হয়, এতে ব্যথা উপশম হবে। চাইলে শোবার সময় পায়ের নিচে বালিশ দিয়ে ঘুমোতে পারেন।
- ৫. পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা জরুরী। পায়ুপথকে সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং শুকনো রাখার চেষ্টা করতে হবে।
- ৬. মলত্যাগের পর কখনই জোরে ঘষাঘষি না করে বরং আলতোভাবে জায়গাটি পরিষ্কার করা উচিত। কেউ টয়লেট পেপার ব্যবহার করলে তা হালকা ভিজিয়ে নিয়ে তারপর সেটা দিয়ে মুছতে পারেন।
![কোথাও বসতে গেলে একটি বালিশ ব্যবহার করে সেটার ওপর বসুন](https://okbangla.com/wp-content/uploads/2023/11/pi5.jpeg)
পাইলস বা অর্শোরোগ হওয়ার কারণগুলো প্রতিরোধ কিভাবে করবেন ? How to prevent the causes of piles
অর্শ রোগ সারানোর কিছু কার্যকর উপায় হল :
- ১. কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে বাঁচতে হলে আঁশ বা ফাইবারযুক্ত খাবার বেশি বেশি খতে হবে। যেমন শাকসবজি, ফলমূল, ডাল, ভাত বা আটার তৈরি খাবার। সেই সাথে জরুরী প্রচুর পরিমাণে জল পান করা। উক্ত কাজ দুটো করলে কয়েকদিনের মধ্যে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হবে, আর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পাইলস এর সব ধরনের লক্ষণ উপশম হয়।
- ২. পায়খানার চাপ আসলে তা আটকে রাখা উচিত না, এতে পায়খানা আরও শক্ত হয়ে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়। তাই বেগ আসলে দেরি না করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মলত্যাগ করতে হবে।
- ৩. নিয়মিত ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করা খুব জরুরী, যাতে শরীরের বিভিন্ন অংশ ভালোভাবে কাজ করে এবং তাদের কার্যক্ষমতা সচল থাকে। তবে কোনো ভারী ব্যায়াম করতে হবে বা প্রতিদিন দৌড়তে হবে, তা নয়। শরীরকে চলমান রাখার জন্য হাঁটাচলা, হালকা স্ট্রেচিং, যোগব্যায়াম ইত্যাদি করাই যথেষ্ট।
- ৪. ওজন অতিরিক্ত হলে তা কম করার কাজ শুরু করে দিন, কারণ ওজন বেশী হলে পাইলস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
![কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে বাঁচতে হলে আঁশ বা ফাইবারযুক্ত খাবার বেশি বেশি খতে হবে](https://okbangla.com/wp-content/uploads/2023/11/pi6.jpeg)
অর্শ্বরোগ বা পাইলসের ব্যাথা কম করার জন্য কিছু ঘরোয়া প্রতিকার, Home remedies to ease piles pain
কিছু ঘরোয়া প্রতিকার আছে যা অর্শ্বরোগ বা পাইলসের ব্যথা কম করার ক্ষেত্রে কার্যকরী। নিম্নলিখিত উপায়গুলি আপনাকে আজ এই রোগ থেকে প্রাকৃতিকভাবে আরাম দিতে সহায়তা করবে :
১. অর্শ্বরোগের চিকিৎসার জন্য অ্যালোভেরা :
অ্যালোভেরার রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা সম্পর্কে আমরা সকলেই জানি। এর থেরাপিউটিক বৈশিষ্ট্য অর্শ্বরোগের জ্বালা কম করতে সাহায্য করে। সবচেয়ে মজার বিষয় এই যে অ্যালোভেরা অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত উভয় অর্শ্বরোগের জন্যই ব্যবহার করা যায়।
বহিরাগত পাইলসের চিকিৎসার জন্য, মলদ্বারের উপর অ্যালোভেরা জেল একটু একটু করে লাগিয়ে ম্যাসাজ করুন। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ অর্শ্বরোগের জন্য অ্যালোভেরার পাতা কেটে একটি পাত্রে নিয়ে ফ্রিজে রেখে দিন। ব্যথা ও চুলকানি বা জ্বালা কমাতে, প্রভাবিত জায়গার এই শীতল অ্যালোভেরা প্রয়োগ করুন।
২. আপেল সিডার ভিনিগার :
আপেল সিডার ভিনিগার সেমোলিনা রক্তনালী সঙ্কুচিত করে এবং অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত উভয় ধরনের অর্শ্বরোগের জ্বালা এবং ব্যাথা থেকে আরাম প্রদান করে। বহিরাগত অর্শ্বরোগের ক্ষেত্রে প্রভাবিত অংশটিকে আপেল সিডার ভিনিগারে ভিজিয়ে নিয়ে একটি তুলোর বল দিয়ে চাপ দিয়ে রাখুন। আর অভ্যন্তরীণ পাইলসের ক্ষেত্রে এক গ্লাস জলে এক চা চামচ আপেল সিডার ভিনিগার মিশিয়ে দিনে দু’বার পান করতে পারেন।
৩. জলপাইয়ের তেল :
জলপাইয়ের তেলে রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা থাকে, এছাড়াও আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য যা প্রধানত বহিরাগত অর্শ্বরোগ চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হয়। এই তেল রক্তনালীর স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে, ফলে ব্যথা কমে যায়।
![জলপাইয়ের তেলে রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা থাকে, এছাড়াও আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য যা প্রধানত বহিরাগত অর্শ্বরোগ চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হয়](https://okbangla.com/wp-content/uploads/2023/11/pi7.jpeg)
পাইলস হলে কোন পরিস্থিতিতে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি, under what circumstances it is necessary to visit a doctor immediately if you have piles?
পাইলস হলে কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি। যথা—
• টানা ৭ দিন ধরে ঘরোয়া চিকিৎসা নেওয়ার পরেও অবস্থার উন্নতি না হলে।
• বারবার পাইলস এর সমস্যা দেখা দিলে।
• ৫৫ বছরের বেশি বয়সী কারও যদি প্রথমবার পাইলস এর লক্ষণ দেখা দেয়।
• পাইলস থেকে যদি পুঁজ বের হতে শুরু করে।
• জ্বর বা কাঁপুনি অনুভূত হলে, অথবা হঠাৎ যদি খুব অসুস্থ বোধ হয়।
• পায়ুপথে অনবরত রক্তক্ষরণ হলে বা পায়খানার সাথে অত্যধিক রক্তপাত হলে।
• তীব্র, অসহনীয় ব্যথা অনুভব হলে।
• পায়খানার রঙ কালচে মনে হলে।
![তীব্র, অসহনীয় ব্যথা অনুভব হলে](https://okbangla.com/wp-content/uploads/2023/11/pi8.jpeg)
পরিশেষে, Conclusion
পাইলসের সমস্যা আজকালের দিনে অতি সাধারণ সমস্যা। তবে এই সমস্যা সময় থাকতে সমাধান না করলে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করতে পারে, এমনকি ক্যান্সার হতে পারে। তাই উপরিউক্ত লক্ষণগুলো দেখলে ঘরোয়া পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে দেখতে পারেন। উক্ত ঘরোয়া উপায়ে কোনো কাজ না হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।