আজকাল বেশিরভাগ মানুষই কোনো না কোনো রোগে ভোগেন। সবার বাড়িতেই কিছু না কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা লেগেই থাকে। তবে যে কোন রোগের লক্ষণগুলো আগে থেকে জানা থাকলে সঠিক সময়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হয়।
নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রেও সেটাই প্রযোজ্য। দেহে এই রোগটির সংক্রমণ ঘটার পরে ধীরে ধীরে এর লক্ষণগুলি শরীরে প্রকাশ পেতে পারে। এই রোগ শিশু, তরুণ, স্বাস্থ্যবান, রোগা যে কোনো মানুষেরই হতে পারে। তাই নিজের দেহ নিয়ে সদা সতর্ক থাকতে হবে এবং সম্ভাব্য যে সব কারণে নিউমোনিয়া হয়ে থাকে সেগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে, কারণ প্রাথমিক অবস্থায় নিউমোনিয়াকে যদি গুরুত্ব না দেওয়া হলে পরিবর্তীকালে বড়সড় বিপদ হতে পারে।
নিউমোনিয়ার লক্ষণগুলো কি কি, Symptoms of Pneumonia
নিউমোনিয়া হল মূলত ফুসফুসের প্রদাহজনিত একটি রোগ। এটি সাধারণত ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক সংক্রমণের কারণে হয়ে থাকে। তাহলে জেনে নিন নিউমোনিয়া রোগের লক্ষণগুলো কি কি !
*প্রচণ্ড কাশি এবং এর সাথে হলুদ বা সবুজ *রঙের শ্লেষ্মা নির্গমন।
*শ্বাস প্রশ্বাসের ক্ষেত্রে কষ্ট অনুভব করা।
*শ্বাস নিতে গেলে বা কাশি দেওয়ার সময় বুকে ব্যাথা।
*শরীরে উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর থাকা (103 F বা 39.4 C এর বেশি)।
![নিউমোনিয়ার লক্ষণগুলো কি কি](https://okbangla.com/wp-content/uploads/2023/08/az1.jpg)
*বুকে তথা সারা শরীরে ব্যথা অনুভূত হওয়া।
*ক্লান্তি এবং খাবারের অরুচি।
*টানা ৩ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কাশি হওয়া এবং কাশির সঙ্গে রক্ত আসা।
উক্ত লক্ষণগুলো দেখা দিলেই সতর্ক হতে হবে এবং চিকিৎসকের সঙ্গে শীঘ্রই যোগাযোগ করা উচিত।
কি কি কারণে নিউমোনিয়া হতে পারে, Causes of pneumonia
সাধারণত বায়ু-বাহিত ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস নিউমোনিয়ার কারণ হিসেবে অগ্রগণ্য। আমাদের শরীরর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জীবাণুদের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করে। কিন্তু কোন কারণে আমাদের রোগ প্রতিরোধকারী ক্ষমতা যদি দুর্বল হয়ে পড়ে তাহলেই জীবাণুর সংক্রমণ হয়। তবে নিউমোনিয়া সৃষ্টিকারক প্রধান জীবাণু হল – স্ত্রেপটোক্ককাস নিউমোনিয়া ব্যাকটেরিয়া।
এই ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ সরাসরি হতে পারে। আবার সর্দি বা ফ্লু-র পর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হওয়ার পরও এই ধরনের ব্যাকটেরিয়া শরীরে বাসা বাঁধতে পারে। নিউমোনিয়া সংক্রামক অন্যান্য কিছু ব্যাকটেরিয়া হল – ক্লামিদোফিলিয়া নিউমোনিই, হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা, লেজিওল্লা নিমফিলিয়া এবং মরাক্সেল্লা কাতারহালিস।
![কি কি কারণে নিউমোনিয়া হতে পারে](https://okbangla.com/wp-content/uploads/2023/08/az4.jpg)
আবার কিছুক্ষেত্রে ভাইরাসের কারণেও নিউমোনিয়ার সংক্রমণ হয়। নিউমোনিয়ার জন্য দায়ী ভাইরাস হল – রেস্পিরেটোরি সিঙ্কসাইটাল ভাইরাস, রাইনোভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, করোনা ভাইরাস, আডেনো ভাইরাস ইত্যাদি। তাছাড়া ছত্রাক দ্বারাও নিউমোনিয়ার সৃষ্টি হতে পারে। এই ধরনের ছত্রাক হল – ব্লাসটোমাইসেস, হিসটোপ্লাসম কাপ্সুলাটাম, ক্রিপ্টোকক্কাস নিওফরমান্স ইত্যাদি।
নিউমোনিয়া সংক্রমণের পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য, Mode of transmission of pneumonia
নিউমোনিয়া রোগে প্রাথমিকভাবে আক্রান্ত হয় আমাদের শ্বাসনালী। সংক্রমিত উচ্চ শ্বাসনালীর প্রতিরোধী ক্ষমতা কম হয়ে আসে ফলে সংক্রমণ ধীরে ধীরে ওপর থেকে শ্বাসনালীর নিম্নাংশে ছড়িয়ে পড়ে। নিউমোনিয়ার সংক্রমণের মাত্রা রোগীর ইমুনিটির অপর নির্ভর করে। তাছাড়া এই রোগে আক্রান্ত হলে কাশি ও হাঁচির সাথে নাক এবং মুখ থেকে জীবাণুযুক্ত তরলের ক্ষুদ্র ফোঁটা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে অন্য কেউ প্রশ্বাসের সাথে এই জীবাণুযুক্ত বাতাস গ্রহণ করে সংক্রমিত হতে পারে। তাই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের নাক-মুখ ঢেকে রাখার জন্য বলা হয়।
নিউমোনিয়ার স্থায়ীত্বকাল, Pneumonia duration
সাধারণত নিউমোনিয়া ২ থেকে ৩ সপ্তাহ অবধি স্থায়ী হয়। বয়স্ক মানুষদের ক্ষেত্রে বা যাদের ফুসফুস, হার্ট, কিডনি এবং স্নায়বিক কোনো দুর্বলতা থাকে তাদের ক্ষেত্রে সেরে উঠতে একটু বেশি সময় লাগে, অন্যদিকে রোগীর যদি ডায়াবেটিস থাকে তবে নিউমোনিয়া-জনিত সমস্যা বেশি হতে পারে।
নিউমোনিয়া নির্ণয়ের পরীক্ষা পদ্ধতি, Tests to diagnose pneumonia
আগেকার সময়ে রোগ নির্ণয়ের সুবিধা তেমন উন্নত ছিলনা, সেক্ষেত্রে লক্ষণগুলো দেখেই বুঝে নিতে হয় যে রোগীর সমস্যা কি। তবে বর্তমানে বেশিরভাগ রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। কোনো ব্যক্তির দেহে নিউমোনিয়া সংক্রমণ হয়েছে কি না এবং তার তীব্রতা কত সেটা নির্ণয় করার জন্য চিকিৎসকরা যে সব বিশেষ পরীক্ষার নির্দেশ দেন, সেগুলো হল :
ব্লাড কালচার
ব্লাড কাউন্ট
চেস্ট এক্স-রে
চেস্ট স্ক্যান
স্পুটাম কালচার
![নিউমোনিয়া নির্ণয়ের পরীক্ষা পদ্ধতি](https://okbangla.com/wp-content/uploads/2023/08/az5-1024x770.jpg)
নিউমোনিয়ার চিকিৎসা কিভাবে করা যায়, Treatment of Pneumonia
নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় প্রাথমিকভাবে সাধারণত ফুসফুসে প্রদাহের তীব্রতা নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এটা অবশ্য বাড়িতে থেকেই নিরাময় করা সম্ভব। কিন্তু রোগের ভয়াবহতা যদি বৃদ্ধি পায়, তবে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করানো আবশ্যক। নিউমোনিয়ার প্রধান চিকিৎসাগুলি হল –
*অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ করা।
*কফ্ এর সমস্যা সমাধান করতে মেডিসিন ব্যবহার।
*জ্বরের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা।
![নিউমোনিয়ার চিকিৎসা কিভাবে করা যায়](https://okbangla.com/wp-content/uploads/2023/08/az2.jpg)
*শ্বাস প্রশ্বাস এর হার নিয়ন্ত্রণে রাখা। প্রয়োজনে অক্সিজেন দিতে হয়।
নিউমোনিয়া প্রতিরোধের কার্যকরী উপায়, Effective ways to prevent pneumonia
নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করতে হলে কিছু বিষয় নিয়ে সতর্ক থাকা উচিত। সেই বিষয়গুলো হল :
নিউমোনিয়া হলে নাক ও মুখ মাস্কে ঢেকে রাখা, ধুমপান বন্ধ করা, প্রাপ্ত বয়স্ক এবং শিশুদের ফ্লু এর ভ্যাক্সিন নেওয়া উচিত, ধোঁয়া ও ধুলো থেকে দূরে থাকুন, অপুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করা, নিজের প্রতি যত্ন নিতে হবে, পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে।অন্যের সামনে হাঁচি/কাশি দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। হাঁচি/কাশি দেয়ার সময় মুখ হাত দিয়ে ঢাকতে হবে বা রুমাল ব্যবহার করতে হবে।
তবে শিশুদের ক্ষেত্রে একটু বেশি সতর্ক থাকতে হয়, বিশেষ করে 2 মাসের কম বয়সী শিশুদের নিউমোনিয়া হলে তা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে যা করতে পারেন –
সময় মতো শিশুদের নিউমোক্ককাস, হাম এবং হুপিং কাশির (পারটুসিস) টিকা নেওয়া উচিত।
শিশুদের রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে জন্মের প্রথম ৬ মাস বুকের দুধ খাওয়ানো।
শিশুকে সঠিক সময়ে খাবার আর ওষুধ খাওয়ান।
![শিশুদের রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে জন্মের প্রথম ৬ মাস বুকের দুধ খাওয়ানো।](https://okbangla.com/wp-content/uploads/2023/08/az6.jpg)
নিউমোনিয়া রোগীদের খাবারের তালিকায় কি কি থাকা উচিত, Food to be taken by the pneumonia patients
নিউমোনিয়ার সাথে লড়াই করতে হলে রোগ প্রতিরোধকারী ক্ষমতা ভালো থাকা জরুরি, এর এরজন্য সুষম খাবার অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অনাক্রম্যতা বজায় রাখতে সহায়ক খাবারগুলো খাওয়া এক্ষেত্রে খুব জরুরি। তাছাড়া অনেক সময় এই রোগে আক্রান্ত রোগীর রক্ত কম হয়ে আসতে পারে, সেক্ষেত্রে রক্ত প্রবাহে নিয়ন্ত্রণ রাখে এবং দেহে রক্ত বাড়তে সহায়তা করে এমন সব খাবার খাওয়া বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। নিউমোনিয়া আক্রান্তদের শরীরে শক্তির জোগান দিতে যেসব খাবার খাওয়া উচিত সেগুলো হল –
নারকেলের জল
সহজ পাচ্য প্রোটিন এবং চর্বি, কার্বোহাইড্রেট
গরম দুধ
![নিউমোনিয়া রোগীদের খাবার](https://okbangla.com/wp-content/uploads/2023/08/az7.jpg)
তাজা ফলের রস ( ডালিম, মোসম্বি)।
পনির, ডাল, লেবুর জাতীয় খাবার।
সবুজ শাক এবং গরম স্যুপ।
টক দই জাতীয় প্রোবায়োটিক খাবার সমূহ।
যেসব খাবার এড়িয়ে চলা উচিত, সেগুলো হল :
ঠাণ্ডা জাতীয় পানীয় বা ঠাণ্ডা খাবার (আইস্ক্রিম)।
খাবারে অতিরিক্ত লবণ এড়িয়ে চলা উচিত।
স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং ট্রান্স ফ্যাট যুক্ত খাবার।
উপসংহার, Conclusion
সাধারণত বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে নিউমোনিয়া রোগ বেশি দেখা যায়। বিশেষ করে যারা দীর্ঘদিন ধরে কোনো রোগে ভুগছেন, অথবা যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়েছে বা কম তাদের ক্ষেত্রেই এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। নিউমোনিয়া অবহেলায় মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
![সাধারণত বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে নিউমোনিয়া রোগ বেশি দেখা যায়](https://okbangla.com/wp-content/uploads/2023/08/az3.jpg)
কিন্তু প্রাথমিক লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে সর্তক হলে হয়তো খুব সহজেই এর নিরাময় সম্ভব। তবে প্রাথমিভাবে কেউ যদি ঘরোয়াভাবে চিকিৎসা গ্রহণ করে থাকেন তাদের ক্ষেত্রে যদি সমস্যা বেড়ে ওঠে, যেমন অস্বাভাবিক জ্বর হওয়া, বেশি দিন ধরে কাশি, শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা, অতিরিক্ত ঘাম বা বুকে ব্যথা হওয়ার মত সমস্যা হয় তবে সাথে সাথে ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত।