পায়োরিয়া রোগ ও তার চিকিৎসা, Pyorrhea and its treatment in Bengali

পায়োরিয়া রোগ ও তার চিকিৎসা

আমাদের সকলের বাড়িতেই কারও না কারও শারীরিক সমস্যা লেগে থাকে। ছোটো হোক কিংবা বড়, বিভিন্ন কারণে দৈহিক বা মানসিক সমস্যা সবারই হয়। তবে সমস্যা ছোটো হলে আমরা সাধারণত সেটা তেমন গুরুত্ব দেই না, কিন্তু অনেক সময় ছোটখাটো সমস্যা থেকেই বড় রোগ হওয়ার ঝুঁকি থাকে, ঠিক যেমন আমরা আমাদের দাঁত বা মাড়ির কোনো সমস্যা হলে সেটা নিয়ে তেমন চিন্তা করি না, যতক্ষণ না এ নিয়ে মারাত্মক কষ্টে ভুগতে হয়।

এমনই একটি সমস্যা হল পায়োরিয়া। পায়োরিয়া বা পাইরিয়া হল দাঁত ও মাড়ির প্রদাহজনিত একটি রোগ। এই রোগে সাধারণত দাঁতের গোড়ায় পুঁজ সৃষ্টি হতে পারে। শিশুদের তুলনায় প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এই রোগটি বেশি দেখা যায়। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা উক্ত রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

পায়োরিয়া কি ? What is pyorrhea?

অনেকেই লক্ষ্য করে থাকবেন যে আমাদের দাঁত ও মাড়ির সংযোগস্থলে অনেক সময় শক্ত হয়ে কিছু পদার্থ জমে যায়, সেটা হল থুথুর মিনারেল থেকে তৈরি টার্টার Opens in a new tab.(Tartar) নামক পাথুরে পদার্থ। এই টার্টার ও খাদ্যের ভগ্নাংশ এভাবে জমা হওয়ার ফলেই পায়োরিয়া রোগের সূত্রপাত হয়।

এই রোগ হলে মাড়ি ক্রমে সংকুচিত হতে থাকে ফলে দাঁতের গোড়া অবমুক্ত হয়, যার ফলস্বরূপ ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটে। মাড়িতে ব্যাকটেরিয়ার ক্রমবৃদ্ধি তথা বিষাক্ত ও প্রদাহকারক উপাদানসমূহের অবমুক্তির ফলেই বিভিন্ন সমস্যা, যেমন মাড়িতে প্রদাহ, ব্যথা ও রক্তপাত হয়ে থাকে। দাঁতকে মাড়ির সাথে সংযুক্ত রাখার ক্ষেত্রে সহায়ক অস্থিকলাগুলো ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে গিয়ে দাঁতকে নড়বড়ে করে দেয় এবং উপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণ না করা হলে দাঁত পড়ে যায়। 

পায়োরিয়া কি ?

পায়োরিয়া রোগের প্রধান কারণ, Causes of pyorrhea

পায়োরিয়া রোগের প্রধান কারণ হল দাঁতের কম যত্ন নেওয়া। দেহের অন্য সকল ব্যাপারে যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি আমাদের যথাযথভাবে দাঁতেরও যত্ন নেওয়া উচিত। বিশেষ করে রাতে ঘুমানোর আগে যদি দাঁত ব্রাশ করা তথা দাঁতের ফাঁক থেকে নিয়মিত ময়লাগুলোকে পরিষ্কার করে রাখলে এ রোগ খুব সহজেই প্রতিরোধ করা যায়। তবে অনেকের দাঁতের সারি সমানভাবে থাকে না, বরং দাঁতগুলো এলোমেলোভাবে সজ্জিত থাকে, সেক্ষেত্রে ময়লা জমার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

এ ধরনের দাঁত পরিষ্কার রাখাও কঠিন কাজ, কিন্তু তবুও চেষ্টা করতে হবে যেন দাঁত ও মাড়ির সংযুক্ত অংশ পরিষ্কার থাকে। তবে জিজনিভাইটিস বা মাড়ির প্রদাহ জনিত সমস্যায় দীর্ঘদিন ভুগলে বা বার বার এই সমস্যা দেখা দিলে সেটা পায়োরিয়া রোগের মতো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, তাছাড়া এরূপ সমস্যার কারণে দাঁতের গঠন প্রনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

পায়োরিয়ার লক্ষণগুলোর কি কি, Symptoms of pyorrhea

পায়োরিয়ার লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে :

  • দাঁত ব্রাশ করার সময় বা শক্ত কোনো খাবারে কামড় দিতে গিয়ে মাড়িতে ব্যথা অনুভব করা বা রক্ত পড়া।
  • হঠাৎ করেই মাড়ি ফুলে যাওয়া।
  • দাঁতের নিচে মাড়িতে ঘা হয়ে ফেটে যাওয়া। 
  • দুর্গন্ধযুক্ত নিঃশ্বাস এবং মুখের মধ্যে ধাতব স্বাদ অনুভব করা।
  • মাড়ি ধীরে ধীরে দাঁত থেকে সরে গিয়ে নিচের দিকে নেমে যাওয়া ও দাঁতকে বড় মনে হওয়া।
  • মাড়ি লাল হয়ে ফুলে ওঠা। 
পায়োরিয়ার লক্ষণগুলোর কি কি

রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা পদ্ধতি, Diagnosis and treatment methods of pyorrhea

দন্ত চিকিৎসকরা পায়োরিয়া বা অন্য কোনো দাঁত বা মাড়ির রোগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দন্ত্যপরীক্ষা, এক্সরে ইত্যাদির মাধ্যমে সমস্যায় তীব্রতা সম্পর্কে বুঝতে চেষ্টা করেন। পায়োরিয়ার তীব্রতা পরিমাপ করার ক্ষেত্রে ডাক্তাররা একটি যন্ত্রের ব্যবহার করেন, যার নাম ‘পেরিয়োডন্টাল প্রোব’। তবে এই রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসার ক্ষেত্রে রয়েছে মুখ ভালোভাবে পরিষ্কার করে রাখা, দুই দাঁতের মাঝে তথা মাড়ি ও দাঁতের মাঝে ময়লা না জমতে দেওয়া, মুখ পরিষ্কারের সঠিক নিয়ম অনুসারে নিয়মিত দাঁত মাজা উচিত। তাছাড়া দাঁত থেকে মাড়ি আলাদা হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেকসময় কিছু এন্টিবায়োটিক খাবার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা, তবে সমস্যার তীব্রতা বুঝে অনেক সময় দাঁতের অপারেশনও করতে হয়।

রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা পদ্ধতি

দাঁত ও মাড়ির পরিচর্যা কিভাবে করবেন, How to take care of teeth and gums

পায়োরিয়া রোগ এড়াতে দাঁত ও মাড়ির সঠিক পরিচর্যা করা উচিত। কিভাবে করবেন জেনে নিন :

  • কোনো কিছু খাওয়ার পর প্রত্যেক বার মুখ কুলকুচি করতে হবে।
  • ভারী কিছু খাওয়ার পর ভালোভাবে ব্রাশ করতে হবে।
  • ব্রাশ করতে হবে ওপর থেকে নীচের দিকে।
  • দুটো দাঁতের মাঝখান পরিষ্কার রাখতে ডেন্টাল ফ্লস ব্যবহার করতে হবে।
  • প্রতিদিন রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে উষ্ণ গরম জলে অল্প নুন দিয়ে কুলকুচি করা উচিত। যাদের রক্তচাপের সমস্যা আছে তারা নুন না দিয়ে শুধু উষ্ণ গরম জলে কুলকুচি করুন।
  • ধূমপান থেকে বিরত থাকুন।
  • জীবাণুনাশক মাউথওয়াশ ব্যবহার করুন।
  • নিয়মিত দন্ত্য-পরীক্ষা এবং দাঁত পরিষ্কার করানো জরুরী।
  • পান সুপারি, জর্দা, সাদাপাতা খাওয়া এবং দাঁতের গোড়ায় গুল লাগানো বন্ধ করতে হবে।
জীবাণুনাশক মাউথওয়াশ ব্যবহার করুন।

দাঁত পরিচর্যা না করার ফলাফল কি, Consequences of not taking dental care

  • মাড়ি ও দাঁতের গোড়ায় তথা দুটো দাঁতের মাঝখানে খাবারের কণা জমতে জমতে একটা শক্ত মাস্ক অর্থাৎ ক্যালকুলাস তৈরি হবে, যা দাঁতের মাড়ির ক্ষতি করে। 
  • দাঁত ভালো রাখতে প্রতি দু’বছর অন্তর অন্তর ক্যালকুলাস-গুলোকে পরিষ্কার করিয়ে নিতে হবে। 
  •  দাঁত ও মাড়ি সুস্থ না থাকলে খাবার ভালোভাবে চিবানো যাবে না, ফলে পেটের সমস্যা তৈরি হবে।
  •  ভাঙা দাঁত থাকলে সেটা অবহেলা না করে তুলিয়ে নিন, নয়তো ভাঙা অংশ ছুঁচালো হয়ে জিভে লেগে জিভে ঘা তৈরি হতে পারে। যদি মুখের ভেতর কোনো ঘা ১৫ দিনের বেশি থাকে তবে সেটা ক্যানসারের মত সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। জিভে, গালে বা মাড়িতে সাদা প্যাচ, ব্যথাবিহীন ঘা থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। 

পায়োরিয়ার সমস্যা দূর করার কিছু ঘরোয়া উপায়, Some Home Remedies to Get Rid of Pyorrhea

কিছু ঘরোয়া উপায় অবলম্বন করে পায়োরিয়ার সমস্যা কম করা সম্ভব। উপায়গুলি হল :

  • বটের নরম বাকল বেটে জলে ফুটিয়ে সেই জলে গার্গল করলে পায়োরিয়া প্রশ্রমিত হয়।
  • গাওয়া ঘিএর সঙ্গে কর্পূর মিশিয়ে রোজ দাঁতে মালিশ করলে পায়োরিয়া কমে যাবে।
  • সরিষার তেলের সঙ্গে লবন মিশিয়ে দাঁত মাজলে পায়োরিয়ার সমস্যা কমে যাবে।
  • পেয়ারা পাতা জলে ভালো করে ফুটিয়ে একটি কাথ তৈরি করে এটা দিয়ে দিনে কয়েক বার কুলকুচি করলে দাঁতের যন্ত্রনা নিবারণ হয়। 
  • পটলের পাতা, কচু, গোলমরিচ, পিপুল, ও সৈন্ধব লবন একসঙ্গে জলে ফুটিয়ে ঠাণ্ডা করে জল ছেঁকে নিতে হবে। এই জল দিয়ে দুই বেলা কুলকুচি করতে পারেন।
পায়োরিয়ার সমস্যা দূর করার কিছু ঘরোয়া উপায়

সতর্কতা, Precautions

যেসকল ব্যক্তি বহুমূত্র রোগজনিত সমস্যায় ভুগছেন তাদের ক্ষেত্রে পায়োরিয়া প্রদাহ বেশি দেখা যায়। এক্ষেত্রে মাড়ির সাথে তাদের শরীরেও প্রদাহের সমস্যা হতে পারে, যার কারণে তারা রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে অক্ষম হন। কোনো প্রমাণ না থাকলেও, চিকিৎসকদের ধারণা অনুযায়ী হৃদরোগ এবং প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সারের সাথে পায়োরিয়ার সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়।

উপসংহার, Conclusion 

মুখের ভিতরের বিভিন্ন সমস্যা তথা দাঁত ও মাড়ির সমস্যা অবহেলা করলে বড় ধরনের রোগে পরিণত হতে পারে। তাই নিয়মিত দাঁতের পরীক্ষা করলে মুখের ভেতরের অবস্থা সম্পর্কে সচেতন থাকা যায় এবং পায়োরিয়ার পূর্ব লক্ষণ শনাক্ত করা যায়, প্রাথমিক অবস্থায় সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া হলে সমস্যা আর বাড়তে পারে না।

'পেরিয়োডন্টাল প্রোব'

তবে দাঁত ও মাড়ি তথা দেহকে সুস্থ রাখতে প্রতিদিন কিছু ক্যালসিয়াম, লৌহ, ভিটামিন সমৃদ্ধ ফলমূল ও শাক- সবজি খাওয়া উচিত; যেমন- আমলকি, পেয়ারা, জাম্বুরা, আখ, কমলা, লালশাক, পালংশাক, কচুশাক, পুঁইশাক ইত্যাদি ৷

 

Oindrila Banerjee

Oindrila Banerjee, a master's graduate in Modern History from Calcutta University, embodies a diverse range of passions. Her heart resonates with the rhythm of creative expression, finding solace in crafting poetic verses and singing melodies. Beyond her academic pursuits, Oindrila has contributed to the educational realm, serving as a teachers' coordinator in a kindergarten English medium school. Her commitment to nurturing young minds reflects her belief in the transformative power of education. Oindrila's guiding principle in life, encapsulated in the motto, "There are two ways of spreading light: to be the candle or the mirror that reflects it,"

Recent Posts