শীত হোক কিংবা গ্রীষ্ম, বহু মানুষ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে চর্ম রোগে ভোগেন। সাধারণত যেকোনো ধরনের চর্মরোগে জ্বালাপোড়া, চুলকানি, ব্যথা ইত্যাদি সমস্যা থাকে। শরীরে প্রবল তাপ থাকলে ত্বকে সাদা বা বাদামী দাগ দেখা দেয় বা ফোঁড়া ও ব্রণ বের হয় এবং সময়মতো চিকিৎসা না করলে পুঁজও বের হয়। এছাড়াও অনেক সময় ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবেও ত্বকের নানা রকম সমস্যা দেখা যায়। এমন অবস্থায় কি করা উচিৎ তা অনেকেই বুঝে উঠতে পারেন না। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা চর্ম রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে আলোচনা করবো।
চর্মরোগের কারণসমূহ, causes of skin disease
- যেকোনো ব্যক্তির চর্মরোগ হতে পারে। তবে যাদের চর্মরোগ বেশি হওয়ার ঝুঁকি থাকে তাদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণ থাকে। সেগুলো হল :
- বেশিরভাগ সময় রোদে কাটালে চর্মরোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
- পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকা সত্ত্বেও যদি কোনো অ্যান্টিবায়োটিক বা অন্যান্য ওষুধ খেলে ত্বকের রোগ হতে পারে।
- মাসিক চক্রের অনিয়মিত সমস্যা থাকার কারণেও কিছু কিছু মহিলাদের চর্মরোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
- শরীরে অতিরিক্ত গ্যাস জমার কারণে ত্বকে শুষ্কতা দেখা দিতে পারে, ফলে ত্বকের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
- সবসময় অতিরিক্ত আঁটসাঁট পোশাক পরলে এবং নাইলনের কাপড় বেশি পড়ার কারণেও ত্বকের রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
- স্নানের সময় অতিরিক্ত সোডাযুক্ত সাবান ব্যবহারেও এই রোগ হতে পারে।
- দীর্ঘায়িত ধুলো মাটিতে কাজ করার ফলে এবং অতিরিক্ত ঘাম হওয়ার কারণেও চর্ম রোগ হতে পারে।
উপরিউক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও আরো বহু কারণে চর্মরোগ হতে পারে। ব্যক্তি বিশেষে চর্মরোগের ধরনও বিভিন্ন হয়।
সাধারণ কিছু চর্মরোগের বিবরণ, description of common skin diseases
অ্যাথলেট ফুট :
এটি মূলত একটি ছত্রাকজনিত রোগ। এই ধরনের চর্মরোগের ক্ষেত্রে সাধারণত পায়ের পাতা কিংবা দুই আঙুলের মাঝখানে চুলকানি বা জ্বালা অনুভূত হয়। এই সমস্যার ক্ষেত্রে পা সাবান দিয়ে ধুয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করে শুকিয়ে নিতে হবে, তবে অ্যান্টিসেপটিক সাবান ব্যবহার করেই ধুতে হবে। তারপর শুকনো ত্বকে অ্যান্টি ফাংগাল ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে এবং কথা সম্ভব জুতা না পরে খালি পেয়ে বিশ্রাম নিন অথবা প্রয়োজনে খোলা জুতা পরতে হবে।
দাদ :
গরমের দিনে দাদের সমস্যা প্রায়ই দেখা যায়। এই চর্মরোগের ক্ষেত্রে চামড়ার উপর গোল চাকার মতো লালচে ক্ষতস্থান সৃষ্টি হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্ষতস্থানে চুলকানি হয়। এই দাদ সাধারণত ঘাড়, পায়ের পাতা, বগলে ক্ষত সৃষ্টি করে থাকে। সেক্ষেত্রে সবসময় পরিষ্কার জামা কাপড় পরতে হবে। ক্ষতস্থানে নখের আঁচড় দেওয়া বা কোনো রকম কাটাছেঁড়া করা যাবে না, নয়তো সমস্যা বেড়ে যেতে পারে। ক্ষত অংশে অ্যান্টি ফাংগাল ক্রিম লাগাতে হবে।
একজিমা :
ত্বকে জ্বালা, ত্বক ফেটে যাওয়া, চুলকানি এগুলো হল একজিমার লক্ষণ। ত্বকের এই সমস্যাটির ক্ষেত্রে নারিকেলের তেল লাগালে অনেকটা আরাম পেতে পারেন। এছাড়া এই সমস্যা দেখা দিলে সব সময় সুতির কাপড় পরার দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
টিনিয়া ক্যাপিটিস :
এই রোগে সাধারণত মাথার ত্বকে দাদ হয়। এই ধরনের সমস্যা সাধারণত গরমকালে দেখা দেয়। মাথার ত্বকে অতিরিক্ত ঘাম হওয়ার ফলেও এই ধরনের চর্মরোগ হতে পারে। তবে এই ছত্রাকজনিত রোগের ফলে ক্ষত স্থান দেখা যেতে পারে ভ্রু, দাড়িতেও। এক্ষেত্রে ক্ষত অংশ অ্যান্টি ফাংগাল শ্যাম্পু বা অ্যান্টিসেপটিক সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিয়ে শুকিয়ে নিতে হবে। এভাবে এই সমস্যা দূর করা সম্ভব।
চর্মরোগের ঘরোয়া চিকিৎসা, Home remedies for skin disease
চর্মরোগ হলে চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করে তাদের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ খেতে পারেন। তবে ঘরোয়া কিছু উপাদান আছে যা আপনাকে চর্মরোগের সমস্যায় আরাম পেতে সহায়তা করতে পারে। সেগুলি হল :
- চর্মরোগ হলে অনেকের চুলকানির সমস্যা দেখা দেয়। সেক্ষেত্রে লেবু ও বেকিং সোডা দিয়ে একটি পেস্ট তৈরি করে চুলকানি হওয়া স্থানে লাগালে চুলকানি কম হয়। এরজন্য দুই চামচ বেকিং সোডা ও এক চামচ লেবুর রস একসাথে মিশিয়ে ত্বকে লাগান। ৫ থেকে ১০ মিনিট অপেক্ষা করে ধুয়ে ফেলুন। প্রতিদিন স্নানের আগে চুলকানির স্থানে এই পেস্টটি ব্যবহার করলে চুলকানি কমে যাবে।
- ত্বকের জন্য দারুণ ভালো উপকার দেয় চন্দন। ক্ষতের অংশের দাগ দূর করতেও চন্দন বেশ কার্যকরী। তবে যাদের ত্বক শুষ্ক তাদের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার না করে ভালো। তবে চর্মরোগে উন্নত মানের চন্দনের গুঁড়ার প্রলেপ চুলকানির স্থানে লাগিয়ে রাখলে উপকার পাবেন।
- চর্মরোগ হলে নিম ব্যবহার করতে পারেন। এই প্রাকৃতিক উপাদানে আছে অ্যান্টি-ব্যাক্টেরিয়াল গুণ। ত্বকের যে কোনো চুলকানি কম করতে নিম বেশ উপকারি। ক্ষত অংশে নিম পাতা বেটে ত্বকে প্রলেপ লাগান, প্রথমে একটু জ্বালাপোড়া বোধ হলেও এতে উপকার পাবেন। আর নিমের সাথে নারিকেল তেল মিশিয়েও লাগাতে পারেন, এতে ত্বকের ফোলাভাবও কমে যাবে এবং ত্বক কোমল হয়, পাশাপাশি চুলকানিও কমে। এছাড়া স্নানের কিছুক্ষণ আগে বালতিতে জল নিয়ে নিমপাতা বাটা বা কিছু পাতা চটকে জলে মিশিয়ে রেখে দিন, এই জলে স্নান করলেও ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা দূরে থাকবে।
- মূলা পাতার রস ত্বকে লাগালে যেকোনো ধরনের চর্মরোগের হাত থেকে উপশম পাওয়া যায়। কিছু চর্মরোগের ক্ষেত্রে ফোসকা/ ফুসকুড়ি ইত্যাদিও দেখা যায় সেক্ষেত্রে প্রতিদিন তিল ও মুলা খেলে ত্বকের ভিতর জমে থাকা পানি শুকিয়ে যায়, ফোলাভাব দূর হয়। মূলায় রয়েছে ক্লোরিন এবং সোডিয়াম উপাদান, এই দুটি উপাদানই পাকস্থলীতে মল স্থির হতে দেয় না এবং এর কারণে গ্যাস বা বদহজম হয় না। এছাড়াও মূলায় প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে, যা হজম নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। পেট পরিষ্কার থাকলে চর্মরোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। তাছাড়া প্রতিদিন মুলা খেলে মুখের দাগ, দাদ, ফুসকুড়ি এবং ব্রণ ইত্যাদিও নিরাময় হয়।
- চর্মরোগ সারাতে আপেলের রসও বেশ উপকারী, এই রস লাগালে বিভিন্ন ত্বকের সমস্যার উপশম হয়। প্রতিদিন একটি বা দুটি আপেল খেলে চর্মরোগ সেরে যায়। তৈলাক্ত ত্বকে ব্রণের উপদ্রব বেশি হয়। তৈলাক্ত ত্বক দূর করতে একটি আপেল ভালো করে পিষে পুরো মুখে লাগান এবং দশ মিনিট পর হালকা গরম পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেললে “তৈলাক্ত ত্বকের” সমস্যা দূর হয়।
- ফোঁড়া ও ব্রণের সমস্যায় রসুনের রস লাগালে তাৎক্ষণিক উপশম হয়। এছাড়াও সরিষার তেলে রসুনের কয়েকটি কুঁড়ি মিশিয়ে গরম করে (হালকা গরম করে) ত্বকে লাগালে চুলকানি ও খোস-পাঁচড়ার সমস্যা চলে যায়।
- চর্মরোগ ক্ষেত্রে হলুদ পিষে তিলের তেলে মিশিয়ে শরীরে মালিশ করলে আরাম পাওয়া যায় এবং ত্বকের সমস্যাও নিমেষে দূর হয়।
- দাদ, চুলকানির মতো রোগ সারাতে করলার রস ত্বকে লাগাতে হবে।
- তুলসীর রস অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণে সম্পন্ন। তাই চর্মরোগ হলে ক্ষত অংশে তুলসী পাতা ডাঁটা সহ পিষে রস বের করে লাগিয়ে রাখতে পারেন। এতে সহজে রোগ সেরে যাবে।
- আগুনে পেঁয়াজ পুড়িয়ে তা ফোঁড়া এবং ফুসকুড়িতে বেঁধে রেখে দিন, এতে ক্ষত অংশে পুঁজ থাকলে তাও বের হয়। তাছাড়া এভাবে সব ধরনের জ্বালাপোড়া, ফোলা, ব্যথা নিরাময় হয়। সংক্রমণের ক্ষতও এই পদ্ধতির ব্যবহারে সেরে যায়।
- পুদিনা ও হলুদের রস মিশিয়ে চুলকানিতে লাগালে সঙ্গে সঙ্গে আরাম পাওয়া যায়।
চর্মরোগ থেকে দূরে থাকতে যা করা উচিত, What to do to stay away from skin diseases?
- প্রতিদিন সকালে এক কাপ গাজর এবং বিটের রস পান করলে সমস্ত চর্মরোগ সেরে যায়। শীতে ত্বকের শুষ্কতা নিয়ে অনেকেরই সমস্যা হয়, তাই গাজর ও বিট খাওয়া উচিত, কারণ গাজরে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, তাই প্রতিদিন গাজর খেলে ত্বকের শুষ্কতা দূর হয়, বিট ও বহু উপকারী উপাদানে পরিপূর্ণ যা ত্বক উজ্জ্বল ও সুস্থ রাখতে সহায়ক।
- একটা সময় পর্যন্ত মানুষ এই সব ভেষজ উপাদান ব্যবহার করতো সুস্বাস্থ্যের জন্য। এমনই একটি প্রাকৃতির ভেষজ হল চিরতা। পেট ঠান্ডা রাখা, রক্ত পরিষ্কার করার পাশাপাশি এই চিরতা নানা রকম চর্মরোগের ক্ষেত্রেও উপকারী। সপ্তাহে 2 থেকে ৩ দিন এর সেবন করলে সহজে আপনার কোনো চর্মরোগের সমস্যা দেখা দেবে না। বহুকাল পূর্ব সময় থেকে বাংলার ঘরে ঘরে চিরতার জল পান করার অভ্যাস রয়েছে। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য রোজ সকালে চিরতার জল পান করা উচিত। এজন্য চিরতার একটি ছোট ডাল এক গ্লাস জলে সারারাত ভিজিয়ে রাখতে হবে। সকালে জলটি ছেঁকে নিয়ে পান করতে হবে, এতে রক্তের সমস্যা দূর হয় ফলে ত্বক সুস্থ থাকে।
- শসা খেলে চর্মরোগ উপশম হয়। এছাড়া শসার রস ত্বকেও লাগাতে পারেন, এটি ত্বকে লাগালে ত্বকের ময়লা দূর হয় এবং মুখ উজ্জ্বল হয়। ময়লা দূর হয় বলে সহজে ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাক ত্বকে বাসা বেঁধে নিতে পারেনা। ফলে চর্মরোগ সহজে দেখা দেবে না।
- গরম জলে লবণ দিয়ে স্নান করলে শীতকালে হওয়া চর্মরোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। যদি চর্মরোগ হয়ে থাকে তবে এই ব্যবহারে রোগ দূর হয়।
শেষ কথা, Conclusion
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আপনারা চর্ম রোগ প্রতিরোধ করার বিভিন্ন উপায় সম্পর্কে জানতে পারলেন। আশা করি বিভিন্ন সমস্যায় এই পদ্ধতিগুলো আপনার কাজে আসবে। তবে এভাবে ত্বকের সমস্যা সমাধান না হলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত এবং প্রয়োজনে ওষুধ সেবন জরুরী।