সিফিলিস রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা, Syphilis symptoms and treatment in Bengali

সিফিলিস রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা

সিফিলিস হল এক ধরণের সংক্রামক রোগ যা মূলত গোপনাঙ্গে অর্থাৎ যৌনপথে সংবাহিত হয়। সিফিলিস বিশ্বের প্রাচীনতম যৌনরোগের অন্যতম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ শারীরিক সংস্পর্শের মাধ্যমেও এটি একজনের দেহ থেকে অন্যের দেহে সংক্রমিত হতে পারে। একজন মানুষের মধ্যে এই রোগটি দীর্ঘসময় ধরে সুপ্তাবস্থায় থাকতে পারে, তবে উক্ত রোগ উৎসগত ভাবে একটি ব্যাকটেরিয়াল রোগ। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা সিফিলিস রোগ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

সিফিলিস রোগের প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গ, Main signs and symptoms of syphilis

এই রোগের আত্মপ্রকাশ দুই ভাবে হয় – বিস্তীর্ণ প্রদাহ এবং স্থানীয় প্রদাহ। বিস্তীর্ণ প্রদাহ এর ক্ষেত্রে সাধারণত শরীরের নির্দিষ্ট কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আক্রান্ত হয়ে থাকে।

অন্যদিকে স্থানীয় প্রদাহ এর ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট ভাবে রেখায়িত ক্ষত সৃষ্টি হয়, যা দেখতে অনেকটা হলদে এবং রাবারের মত শক্ত হয়। দেহের বিভিন্ন অংশে এক রকম খাঁজ কাটা ক্ষত সৃষ্টি হয় যা আলাদা হয়ে থাকা চামড়ার টুকরোর মত দেখায়। এছাড়া রোগের সংক্রমণ বৃদ্ধির সাথে যকৃৎ, শুক্রাশয়, টিবিয়া, আলনা, দাঁতের চোয়ালের হাড়ে সাধারণত আক্রান্ত হতে থাকে। রোগের সংক্রমণ সৃষ্টির উৎস হচ্ছে, ক্ষত বা কাটা চর্ম এবং শ্লেষ্মা ঝিল্লী, লালা, বীর্য, যোনির ক্ষরণ, এবং রক্ত।

সিফিলিস রোগের প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গ

সিফিলিস রোগের মূল লক্ষণগুলো হল দৃঢ়, ব্যথাহীন, চুলকানিহীন ত্বকের আলসার ইত্যাদি। তবে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের উপর ভিত্তি করে সিফিলিস তিনটি পৃথক পর্যায়ে ঘটে, আর এর প্রতিটি পর্যায়ের নির্দিষ্ট কিছু উপসর্গ রয়েছে, লক্ষণগুলো দেখে অনুমান করা যায় যে রোগটি কোন পর্যায়ে আছে। সেই অনুযায়ী রোগনির্ণয় ও চিকিৎসা করা হয়। জেনে নেওয়া যাক সিফিলিস রোগের প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গগুলি কি :

১) প্রাথমিক পর্যায়ের সিফিলিস আক্রান্তের মধ্যে যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা হল:

সংক্রমণের ৩ মাস অবধি সিফিলিস রোগের প্রারম্ভিক পর্যায় দেখা যায়। এই পর্যায়ে আক্রান্তের শরীরের বিভিন্ন অংশে ক্ষুদ্র যন্ত্রণাহীন ক্ষতের সৃষ্টি হয়, আর অন্য কোন গুরুতর উপসর্গ এই সময়ে দেখা দেয় না। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ের সিফিলিসের কোন চিকিৎসা ছাড়াই নিরাময় ঘটে।

২) দ্বিতীয় পর্যায়ের সিফিলিস আক্রান্তের মধ্যে যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা হল :

দ্বিতীয় পর্যায়ের সিফিলিস এই পর্যায়ে উপসর্গের অগ্রগতি ঘটে এবং হাতে, পায়ে ও যৌনাঙ্গেও ফুসকুড়ি দেখা দিতে শুরু করে। সংক্রমণের 6 মাস সময় ধরে এই পর্যায়টি স্থায়ী হয়। অনেক সময় এই সমস্যা স্থায়ী হওয়ার মেয়াদ আরো বেশিও হয়। এছাড়াও, সিফিলিস আক্রান্তের জ্বর, মাথা যন্ত্রণা এবং যৌনাঙ্গের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দিতে পারে।

৩) তৃতীয় পর্যায়ের সিফিলিস আক্রান্তের মধ্যে যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা হল :

সাধারণত সিফিলিসের তৃতীয় পর্যায়েই অন্যতম পর্যায় হিসেবে ধরা হয়। এই পর্যায়টি উক্ত রোগের অগ্রসর পর্যায়, শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলি ক্ষতিগ্রস্থ হয় এই পর্যায়ে। এই পর্যায়েই রোগের সবথেকে গুরুতর উপসর্গগুলি দেখা যেতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল অন্ধত্ব, পক্ষাঘাত এবং হৃদযন্ত্রের সমস্যা ইত্যাদি। সঠিক সময় এই রোগের থেকে সৃষ্ট সমস্যাগুলোর চিকিৎসা করা না হলে এটি প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।

সিফিলিস তিনটি পৃথক পর্যায়ে ঘটে

সিফিলিসের প্রধান কারণ, main causes of syphilis

সিফিলিস রোগ সংক্রমণের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়াটি হল ট্রেপোনেমা প্যালিডাম। সাধারণত এই সংক্রমণটি কোনো অসুরক্ষিত যৌন সম্পর্কের মাধ্যমেই ছড়ায়।

সিফিলিস রোগ সংক্রমণের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়াটি হল ট্রেপোনেমা প্যালিডাম

বিশেষ করে সমকামী পুরুষদের মধ্যেই সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

আবার বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে এই রোগে আক্রান্ত মা থেকে সদ্যোজাত শিশুর মধ্যেও এই সংক্রমণ পরিবাহিত হতে পারে, এমনভাবে হওয়া সংক্রমণকে বলে কনজেনিটাল সিফিলিস বা জন্মগত সিফিলিস।

সমকামী পুরুষদের মধ্যেই সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে

অন্যদিকে কোনো আক্রান্ত ব্যক্তির অনাবৃত ফুসকুড়ি বা ক্ষতের সংস্পর্শে যদি কোনো সুস্থ ব্যক্তি আসে তবে তার মধ্যেও এই সংক্রমণ ছড়াতে পারে।

কিভাবে এই রোগটি নির্ণয় করা হয় এবং এর চিকিৎসা কি? How is syphilis diagnosed and what is its treatment?

সিফিলিস রোগ নির্ণয়করণ করার পদ্ধতি : 

যেকোনো রোগের চিকিৎসা সহজ হয়ে ওঠে যদি এর রোগনির্ণয় সঠিক ভাবে করা হয়। সিফিলিস রোগের ক্ষেত্রে কোন পরীক্ষা করার আগে চিকিৎসক রোগীর থেকে তার যৌনসম্পর্কের ইতিহাস সংগ্রহ করেন এবং ত্বক, বিশেষত যৌনাঙ্গের ত্বক, পর্যবেক্ষণ করেন। সবকিছু জানার পর যদি উপসর্গ ও পর্যবেক্ষণ সিফিলিসের দিকে ইঙ্গিত দেয় তবে আক্রান্তের রক্ত পরীক্ষা করা হয়, এবং সিফিলিসের ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান করার জন্য শরীরের ক্ষতগুলিকে পরীক্ষা করা হয়।

যদি আক্রান্ত রোগীর অবস্থা দেখে সন্দেহ করা হয় যে সে তৃতীয় পর্যায়ের সিফিলিসে ভুগছে তবে বিভিন্ন অঙ্গগুলির অবস্থা ঠিক আছে কি না তা জানার জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া সুষুম্নাকান্ড থেকে তরল সংগ্রহ করেও ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়, এই পরীক্ষা থেকে রোগটি স্নায়ুতন্ত্রে প্রভাব ফেলেছে কিনা তা জানা যায়।

বিভিন্ন পরীক্ষা করার পর সিফিলিস নিশ্চিতভাবে নির্ণয় হলে এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি যৌনসঙ্গীকেও পরীক্ষা করানোর জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। বংশগত সিফিলিস প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে গর্ভের প্রথম তিন মাসের সকল গর্ভবতী মহিলার সিফিলিস নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা ও W.R Test (Wassermann ReactionOpens in a new tab.) করানো উচিত।

যদি কোন মহিলার সিফিলিস ধরা পড়ে তবে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা করা জরুরি। পাশাপাশি জন্মের পর নবজাতককেও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পরীক্ষা করাতে হবে যেন রোগ বাড়ার আগে নির্মূল করা যায়। যদি সেই সদ্যজাত শিশুর রোগ ধরা পড়ে তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এর চিকিৎসা করতে হবে। 

সিফিলিসের চিকিৎসা কিভাবে করা হয় :

রোগ নির্ণয় করার মাধ্যমে বুঝতে পারা যায় যে সিফিলিস কোন পর্যায়ে আছে, সেই হিসেবেই চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন করেন চিকিৎসকরা। রোগটি সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে খুব তাড়াতাড়ি এবং সম্পূর্ণভাবে জীবাণুটি নির্মূল করা সহজ হয়। কিন্তু যদি সংক্রমণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তবে চিকিৎসার মাধ্যমে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।

সিফিলিসের চিকিৎসা কিভাবে করা হয়

প্রাথমিক অবস্থায় সিফিলিসের জন্য এন্টিবায়োটিক ওষুধ দেওয়া হয়, আর এই ওষুধগুলো সাধারণত ইনজেকশনের মাধ্যমেই প্রয়োগ করা হয়। সিফিলিসের চিকিৎসা করার জন্য ব্যবহৃত হয় এমন একটি পরিচিত এন্টিবায়োটিক হল পেনিসিলিন। পেনিসিলিন এ কারও অ্যালার্জি থাকলে এরিথ্রোমাইসিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়।

তবে রোগ যদি তৃতীয় পর্যায়ে থাকে তাহলে মূলত উপসর্গগুলির উন্নতির জন্য সিফিলিস সারাতে ব্যাপক চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, কারণ এই পর্যায়ে রোগের জন্য দায়ী জীবাণুটিকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা আর সম্ভব নয়। পাশাপাশি রোগটির চিকিৎসা চলাকালীন আক্রান্ত ব্যক্তির যেকোন যৌন কার্যকলাপ বা ঘনিষ্ঠ শারীরিক সম্পর্ক থেকে বিরত থাকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, নয়তো এই রোগ খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।

সতর্কতা, Precautions 

যেকোনো যৌনরোগ এড়াতে একাধিক সঙ্গীর সাথে যৌনসম্পর্কে লিপ্ত না হওয়া খুব জরুরী। তাছাড়া যৌনসংগমের সময় কনডম ব্যবহার করা জরুরী বা যোনীর মধ্যবর্তী জেলি এবং ক্রীম ব্যবহার করতে হবে। এর সাথে পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে সঙ্গমের পর যৌনাঙ্গ পরিষ্কার করতে হবে।

যৌনসংগমের সময় কনডম ব্যবহার করা জরুরী

উপসংহার, Conclusion 

উপরের আলোচনা থেকে বুঝতে পারা যায় যে সিফিলিস রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে সুস্থ হয়ে ওঠা যায়। কিন্তু পূর্ব থেকেই নিজে যদি সতর্ক থাকা হয় তবেই এই রোগ আমাদের শরীরে বাসা বাঁধতে পারবে না। লোকজনদের অবশ্যই সিফিলিস নামক রোগের মারাত্মকতা সম্পর্কে শিক্ষা দিতে হবে। রোগ থেকে বাঁচতে পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও ব্যক্তিগত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে উপদেশ দিতে হবে।

Oindrila Banerjee

Oindrila Banerjee, a master's graduate in Modern History from Calcutta University, embodies a diverse range of passions. Her heart resonates with the rhythm of creative expression, finding solace in crafting poetic verses and singing melodies. Beyond her academic pursuits, Oindrila has contributed to the educational realm, serving as a teachers' coordinator in a kindergarten English medium school. Her commitment to nurturing young minds reflects her belief in the transformative power of education. Oindrila's guiding principle in life, encapsulated in the motto, "There are two ways of spreading light: to be the candle or the mirror that reflects it,"

Recent Posts