থাইরয়েড গ্রন্থি বা থাইরয়েড হল একটি অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি যা দুইটি লোব দ্বারা গঠিত, এর অবস্থান গ্রীবাতে। এর অবস্থান পুরুষের এডাম’স এপলের ঠিক নিচে। সহজভাবে বলতে গেলে গলার সামনের দিকে অবস্থিত থাইরয়েড গ্রন্থি শরীরে থাইরয়েড হরমোনের প্রধান উৎস। এই হরমোন শরীরের প্রতিটি কোষ, টিস্যু ও অঙ্গের কার্যকারিতায় প্রভাব ফেলে; বিপাকের হার, হৃৎপিণ্ডের কর্মক্ষমতা, হজমের প্রক্রিয়া, পেশি ও হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। তাই থাইরয়েডের সমস্যা হলে শরীরে নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে।
থাইরয়েড গ্রন্থির আকার- আকৃতি, Thyroid Gland Size- Shape :
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে থাইরয়েড গ্রন্থি দুই লোব বিশিষ্ট এবং ক্রিকয়েড ও শ্বাসনালি দ্বারা আবৃত থাকে। থাইরয়েড গ্রন্থি আমাদের দেহের একটি প্রজাপতি আকৃতির অঙ্গ। বাম ও ডানে দুই লোব ইস্থমুস দ্বারা সংযুক্ত আছে। প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের থাইরয়েড গ্রন্থির ওজন ২৫ গ্রাম, প্রতি লোব ৫ সেমি লম্বা হয় , ৩ সেমি প্রশ্বস্ত এবং ২ সেমি পুরু হয়ে থাকে। ইস্থমুস উচ্চতায় ও প্রশ্বস্ততায় প্রায় ১.২৫ সেমি হয়। নারীদের পিটুইটারি গ্রন্থি সাধারণত পুরুষের থেকে বড় , এছাড়া মহিলাদের ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় এটি আকার বেড়ে যায়।
থাইরয়েড গ্রন্থি ল্যারিংক্স ও শ্বাসনালি ঘেঁষে অবস্থিত। শ্বাসনালির দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় নালী পর্যন্ত ইস্থমুসের গঠন বিস্তৃত হয়। থাইরয়েড গ্রন্থির উপরের অংশ থাইরয়েড কার্টিলেজ পর্যন্ত যায় এবং নিচের অংশ শ্বাসনালির চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ রিং পর্যন্ত বিস্তৃত।
তাছাড়া আমাদের থাইরয়েড গ্রন্থিটি একটি পাতলা আবরণ দ্বারা আবৃত থাকে। এই আবরণের ক্ষেত্রে একটি বহিঃ ও একটি আভ্যন্তরীণ আবরণও থাকে। বহিঃ আবরণটি প্রিট্রাকিয়াল ফ্যাসিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে ক্রিকয়েড ও শ্বাসনালির কার্টিলেজ পর্যন্ত পৌঁছায়।
থাইরয়েড হরমোন নিঃসরণ, Thyroid hormone secretion :
আমাদের দেহে অবস্থিত থাইরয়েড গ্রন্থির প্রধান কাজ হল আয়োডিন সংবলিত হরমোন তৈরি। আয়োডিন সমৃদ্ধ হরমোনগুলো হল ট্রিথাইরোনিন (T3) ও থাইরক্সিন (T4)। আয়োডিনের তিনটি অণু থাকার ফলে এর নামকরণ T3 করা হয়েছে।
অন্যদিকে T4 এ চার আয়োডিন অণু থাকে। থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয় থাইরয়েড হরমোন। হরমোনগুলো দেহের মেটাবলিক রেট ও প্রোটিন সিন্থেসিসকে প্রভাবিত করে। থাইরয়েড গ্রন্থি ক্যালসিটোনিন নামক এক ধরনের হরমোন তৈরি করে যা ক্যালসিয়াম হোমিওস্ট্যাসিসে অবদান রাখে।
প্রোটিন কোডিং জিন, Protein coding genes :
অনেকেই হয়তো জানেন না যে মানব কোষের প্রায় ২০ হাজার প্রোটিন কোডিং জিন প্রকাশ প্রায়। উক্ত পরিমাণের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই সাধারণ থাইরয়েডে প্রকাশিত হয়। এসব জিনের প্রায় ২৫০ টি জিন মূলতঃ থাইরয়েডে প্রকাশিত হয় এবং ২০টি জিন অত্যন্ত সুচারুভাবে থাইরয়েড এর সাথে যুক্ত।
জেনে রাখা ভালো যে, এই প্রোটিন সংলগ্ন জিনগুলো থাইরয়েড হরমোন সিন্থেসিসের সাথে জড়িত।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে; থাইরোগ্লোবিউলিন, টিপিও এবং আইওয়াইডি ফলিকুলার কোষে প্রকাশিত হয়।
থাইরয়েডের সমস্যা, Thyroid problems :
থাইরয়েডের সমস্যা থাইরয়েড হরমোনের প্রভাবে হয়, যেমন : হরমোন স্বল্পতা বা হাইপোথাইরয়ডিজম, হরমোন বেশি নিঃসরণ হওয়া বা হাইপারথাইরয়েডিজম।
থাইরয়েডের ক্ষেত্রে এ দুটি প্রধান সমস্যা দেখা যায়, এছাড়াও থাইরয়েড ফোলা, থাইরয়েড টিউমার ও থাইরয়েড ক্যানসারের মতো সমস্যাও হতে পারে।
দেহে আয়োডিন কম থাকলে থাইরয়েড হরমোন কম উৎপন্ন হবে অথবা থাইরয়েড ফুলে যাবে। এই ফুলে যাওয়াকেই বলা হয় গলগণ্ড। আবার জন্মগতভাবে থাইরয়েড গ্রন্থির ত্রুটিতেও থাইরয়েডে সমস্যা দেখা দেয়।
কারও থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে তার সন্তানদেরও এ সমস্যা হতে পারে। থাইরয়েডে সমস্যা দেখা দেয় শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ত্রুটি এবং অ্যান্টিবডি তৈরির কারণে।
নবজাতকের হাইপোথাইরয়েডিজম হলে দৈহিক ও মস্তিষ্কের গঠন ও বিকাশ ব্যাহত হয়। নানা রকম শারীরিক জটিলতার পাশাপাশি বুদ্ধি-প্রতিবন্ধিতাও হতে পারে।
কিশোর বয়সের আগে বা পরে অনেকেরই হাইপোথাইরয়েডিজম দেখা দেয়। এদের ক্ষেত্রেও বিকাশজনিত সমস্যা পরিলক্ষিত হয়; যেমন খর্বতা, কৈশোর প্রাপ্তিতে বিলম্ব, কিশোরীদের মাসিকের সমস্যা, মানসিক ধীরতা, পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়।
থাইরয়েডের সমস্যার লক্ষণ, Symptoms :
থাইরয়েডের সমস্যার লক্ষণ দেখলেই অনুমান করা যায় যে, থাইরয়েডের কোন ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। বলাই বাহুল্য সাধারণত নারীদের ক্ষেত্রেই থাইরয়েডের সমস্যা বেশি দেখা যায়। বিশেষত প্রজননক্ষম নারীদের হাইপোথাইরয়েডিজমের হার পুরুষদের তুলনায় প্রায় দশ গুণ বেশি, জটিলতাও বেশি।
থাইরয়েডের সমস্যার ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধি, সব সময় ক্লান্তিবোধ, অনিয়মিত মাসিক বা দীর্ঘদিন অতিরিক্ত মাসিকের মতো সমস্যা, স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে যাওয়া, চুল ও ত্বক শুষ্ক ও রুক্ষ হয়ে যাওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, বারবার গর্ভপাত, বন্ধ্যত্বসহ বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দেয়। থাইরয়েডের কোনও সমস্যা থাকলে শিশুদের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত, বয়ঃসন্ধি বিলম্ব ও মানসিক বিকাশে সমস্যাও দেখা দেয়।
অন্যদিকে হাইপারথাইরয়েডে হঠাৎ করেই ওজন কমা, কাঁপুনি, উদ্বেগ, অত্যধিক ঘাম ও ঋতুচক্রে কম রক্তক্ষরণের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। থাইরয়েডে সমস্যার কারণে অনেকের ক্ষেত্রে মাংসপেশির ক্ষয় বেড়ে যায়, সক্ষমতা কমে যায়। আবার অনেকের ক্ষেত্রে চোখ বড় হয়ে যেতে পারে।
থাইরয়েডের সমস্যা সমাধানের উপায়, Ways to solve thyroid problems :
থাইরয়েডের সমস্যা দেখা দিলে প্রাথমিক চিকিৎসা পদ্ধতি হল শরীরে থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করা। কিছু কিছু সবজি এক্ষেত্রে রোজকার খাবারে এড়িয়ে চলাই ভাল। হাইপোথায়রডিজমের ক্ষেত্রে যে খাবারগুলির দিকে হাত না বাড়ানোই ভাল, সেগুলি হল –
- ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য চেষ্টা করতে হবে ফ্যাটজাতীয় খাবার না খাওয়ার।
- ব্রোকলি
- ফুলকপি
- সয়াবিন
- বাঁধাকপি
- রাঙা আলু
- পিচ
- আয়োডাইজড নুন খেতে হবে।
- জিঙ্ক-রিচ ডায়েট খেতে হবে।
- গ্লুটেন ফ্রি ডায়েট করতে হবে।
থাইরয়েডের সুস্থতা বজায় রাখতে ময়দা, আটা, পাঁউরুটি, নুডলস ইত্যাদি এড়িয়ে চলতে হবে। এসবের বদলে খাওয়া যায়, কুইনোয়া কিংবা ব্রাউন রাইস।
এছাড়া অনেকরকম ফল ও সবজি খেতে পারেন; যেমন, কর্ন, স্কোয়াশ, গাজর, বিনস, ফুলকপি, মিষ্টি আলু, ভুট্টা,মটরশুঁটি, সবুজ শাকসবজি ইত্যাদি। মাছ, চিকেন, টোফু , ডাল, বাদাম, এগুলোও খাওয়া চলতে পারে।
থাইরয়েড হলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় ভিটামিন D এর ঘাটতি, ম্যাগনেশিয়াম ও সিলিনিয়ামের ঘাটতি হতে পারে। তাই ডায়েটে যাতে এই জিনিসগুলিও থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
অন্যান্য প্রাণীর থাইরয়েড, Thyroid of other animals :
থাইরয়েড গ্রন্থি সকল মেরুদন্ডী প্রাণীতে বিদ্যমান। মাছের ক্ষেত্রে, সাধারণত ফুলকার নিচে এই গ্রন্থির অবস্থান থাকে এবং সবক্ষেত্রে এটি দুইভাগে বিভক্ত হয় না। অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে থাইরয়েড কোষকলা শরীরের অন্যান্য অঙ্গ যেমন বৃক্ক, প্লীহা, হৃৎপিণ্ড অথবা চোখেও পাওয়া যায়।
বেশিরভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে শুধুমাত্র একটি থাইরয়েড গ্রন্থি পাওয়া যায়। কিছু কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রে এর আকৃতি মানুষের থাইরয়েড গ্রন্থির মতোই।
বিশ্ব থাইরয়েড দিবস, World Thyroid Day :
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বুঝতেই পারা যাচ্ছে যে থাইরয়েড হরমোন মানুষের বৃদ্ধি, বিকাশ, শারীরবৃত্তিক আর বিপাকীয় নানা ক্রিয়া-প্রক্রিয়া সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বর্তমানে বিশ্বে অন্যতম হরমোনজনিত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যা। ডায়াবেটিসের পরই হরমোনজনিত রোগের ক্ষেত্রে এর অবস্থান। বিশেষত নারীরাই এই সমস্যায় বেশি ভুগে থাকেন।
আগামী প্রজন্মের মেধা, প্রতিভার বিকাশে বর্তমানের মানুষদের, বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে থাইরয়েডের সুস্থতা বজায় রাখার চেষ্টা করা দরকার। তাই থাইরয়েড সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করার উদ্দেশ্যে ২৫ মে বিশ্ব থাইরয়েড দিবস পালন করা হয়।
উপসংহার, Conclusion :
থাইরয়েডের সমস্যার নানামুখী উপসর্গ ও জটিলতার ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগ শনাক্ত হতে দেরি হয়। প্রজননক্ষম নারীদের ক্ষেত্রে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার আগে আর গর্ভাবস্থায় কোনো উপসর্গ না থাকলেও থাইরয়েড পরীক্ষা করতে হবে। সুস্থ ও সুন্দর জীবনের জন্য নিজের থাইরয়েড সম্পর্কে জানুন, এর সমস্যা, রোগের উপসর্গ ও জটিলতা সম্পর্কে সচেতন হোন।