থাইরয়েডের সমস্যা আজকাল যেন প্রতি ঘিরেই কারও না কারও মধ্যে দেখা দিচ্ছে। থাইরয়েডের নানা রকম সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত হলো হাইপোথাইরয়েডিজম। এটি থাইরয়েড হরমোন ঘাটতিজনিত রোগ। থাইরয়েড–সংক্রান্ত বিভিন্ন রোগ ব্যাধিগুলোর মধ্যে এই রোগে সর্বাধিক মানুষ আক্রান্ত হয়ে থাকেন।
বলাই বাহুল্য যে পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে এ রোগের আধিক্য বেশি। চিন্তার বিষয় এই যে, পুরুষ ও নারীদের প্রজননস্বাস্থ্যে থাইরয়েড হরমোনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। হরমোনটির তারতম্যের কারণে বন্ধ্যাত্ব পর্যন্ত হতে পারে।
আবার কিছু ক্ষেত্রে গর্ভকালীন মা ও গর্ভস্থ শিশুর নানাবিধ জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই থাইরয়েডের সমস্যা যাদের রয়েছে তারা এ নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে থাকেন। আজকের এই প্রতিবেদনে থাইরয়েড এর সমস্যায় প্রজননে অসুবিধা হয় কি না তা নিয়ে আলোচনা করবো।
থাইরয়েড হরমোনের অপর নাম কি? What is the other name of thyroid hormone?
থাইরয়েড গ্রন্থি দ্বারা উৎপাদিত প্রধান হরমোনগুলি হল থাইরক্সিন বা টেট্রাইওডোথাইরোনিন (T4) এবং ট্রায়োডোথাইরোনিন (T3)। এই দুটি হরমোন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মস্তিষ্ক থেকে অন্য আরেকটি হরমোন নিঃসরণ হয়, যার নাম হল টিএসএইচ। রক্তে থাইরয়েড হরমোন দুটি কম হয়ে গেলে টিএসএইচ বেড়ে যায়। রক্তে টিএসএইচ এর মাত্রা পর্যবেক্ষণ করে থাইরয়েডের কার্যকারিতা বোঝা যায়। কারও কারও ক্ষেত্রে প্রকট হাইপোথাইরয়েডিজম থাকে আবার অনেকের ক্ষেত্রবিশেষে এই হরমোনের মাত্রা প্রচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে। গর্ভকালীন সময়ে উক্ত দুটি অবস্থার ক্ষেত্রেই চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে।
গর্ভস্থ ভ্রূণের উপর থাইরয়েড হরমোনের প্রভাব, Effects of Thyroid Hormones on the Fetus :
গর্ভস্থ ভ্রূণের বিকাশ ও বৃদ্ধির জন্য নিজস্ব কোনো থাইরয়েড হরমোন থাকে না। এর জন্য গর্ভস্থ শিশুটি মায়ের ওপর নির্ভরশীল। তাই মায়ের হরমোন ঘাটতি গর্ভের শিশুর স্নায়বিক বৃদ্ধি ও বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। হরমোনের অভাবে শিশু হতে পারে বুদ্ধি বৈকল্যের শিকার। কিছু ক্ষেত্রে হরমোনের ঘাটতির কারণে গর্ভপাত হতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে অকাল প্রসব, গর্ভের ভেতর শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। থাইরয়েডের সমস্যার সম্মুখীন মহিলাদের ক্ষেত্রে বাচ্চারা সাধারণত জন্মগতভাবে কম ওজনের হয়ে থাকে। আবার কখনো গর্ভস্থ শিশু হতে পারে জন্মগত হাইপোথাইরয়েডিজম আক্রান্ত।
থাইরয়েড হরমোনের প্রভাবে গর্ভকালীন বিভিন্ন জটিলতা, Various pregnancy complications due to the effect of thyroid hormone :
গর্ভবতী মায়েরাও থাইরয়েড হরমোনের অভাবে বিভিন্ন জটিলতায় আক্রান্ত হতে পারেন। যেমন :
- গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ,
- ডায়াবেটিস,
- রক্তশূন্যতা
- মাংসপেশির দুর্বলতা,
- শরীরে ব্যথা–বেদনা ইত্যাদি সমস্যা বেশি হয়।
এছাড়াও কিছু ক্ষেত্রে হৃৎপিণ্ড বিকল হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়।
গর্ভকালে হাইপোথাইরয়েডিজমের সমস্যা, Complications of hypothyroidism during pregnancy :
গর্ভকালে হাইপোথাইরয়েডিজমের সমস্যা হওয়ার নেপথ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হলো গর্ভবতী মায়ের দেহে আয়োডিনের ঘাটতি। যেসকল অঞ্চলের মাটি ও শস্যদানায় আয়োডিনের ঘাটতি থাকে, সাধারণত সেখানকার মায়েরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়েন।
এই সমস্যার দ্বিতীয় প্রধান কারণ হলো অটোইমিউন থাইরয়েড রোগ। গর্ভবতী হওয়ার আগেই যাদের হরমোনের ঘাটতি জনিত সমস্যা থাকে, তাদের ক্ষেত্রে গর্ভকালে তা প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। এক্ষেত্রে গর্ভধারণের আগেই থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা জেনে নেওয়া জরুরি এবং উপযুক্ত চিকিৎসা করানো উচিত।
বিশেষ করে যাদের আয়োডিন ঘাটতিজনিত সমস্যা আছে, কিংবা অন্য কোনো অটোইমিউন রোগ ব্যাধির নজির রয়েছে কিংবা থাইরয়েড অ্যান্টিবডির উপস্থিতি দেহে বিদ্যমান, তারা অবশ্যই নিজের হরমোনের মাত্রা সম্পর্কে জেনে নেবেন।
পাশাপাশি টাইপ–১ ডায়াবেটিস, অতিমাত্রায় স্থূল নারী, ঘাড়ে কিংবা মাথায় রেডিও থেরাপি ব্যবহার করেছেন এমন মহিলারা কিংবা যাদের আগে থাইরয়েডের শল্যচিকিৎসা হয়েছে, তাদেরও হরমোনের মাত্রা কেমন, তা গর্ভধারণ করার আগে জেনে নিয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
থাইরয়েড হরমোন কম থাকার লক্ষণ, Symptoms of low thyroid hormone :
থাইরয়েড হরমোন কমে গেলে বেশ কিছু লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। সেগুলি হল :
- ওজন বৃদ্ধি,
- ক্লান্তি,
- কোষ্ঠকাঠিন্য,
- হঠাৎ ঠান্ডা অনুভব,
- অবসন্নতা,
- শুষ্ক ত্বক-চুল
এগুলো হল হাইপোথাইরয়েডিজমের অন্যতম প্রধান লক্ষণ।
থাইরয়েড সমস্যাযুক্ত মহিলা কি গর্ভবতী হতে পারেন? Can a woman with thyroid problems become pregnant?
থাইরয়েডের সমস্যায় আক্রান্ত অনেক মহিলার মনেই এই প্রশ্ন আছে যে “থাইরয়েড রোগী কি গর্ভবতী হতে পারেন?” উত্তরটি হবে হ্যাঁ, তবে এর জন্য কিছু অতিরিক্ত যত্নের প্রয়োজন হতে পারে।
হাইপারথাইরয়েডিজম এবং হাইপোথাইরয়েডিজমের মত থাইরয়েডের কর্মহীনতা মহিলাদের প্রজননকে প্রভাবিত করে। পরিবর্তিত ডিম্বস্ফোটন ফাংশন, মাসিক অনিয়ম এবং উচ্চ গর্ভপাতের হারের কারণে উর্বরতাকে প্রভাবিত করতে পারে।
প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, থাইরয়েড সমস্যাযুক্ত মহিলারা যদি সঠিক রোগ নির্ণয় করার মাধ্যমে চিকিৎসা গ্রহণ করে নিতে পারেন তবে বন্ধ্যাত্ব বা গর্ভপাতের মত সমস্যা হবে না।
গর্ভবতী হওয়ার জন্য মহিলাদের থাইরয়েডের মাত্রা কী হওয়া উচিত? What should be the thyroid range for women to be pregnant?
গর্ভধারণের পরিকল্পনা করার সময়, থাইরয়েডের সর্বোত্তম কার্যকারিতা থাকা অপরিহার্য। সেক্ষেত্রে যেসব বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে, সেগুলি হল :
- TSH (থাইরয়েড-উদ্দীপক হরমোন) মাত্রা গর্ভাবস্থার আগে 0.4 থেকে 2.5 মিলিইউনিট প্রতি লিটার (mU/L) এর মধ্যে থাকা উচিত।
- T4 (ফ্রি থাইরক্সিন) মাত্রা স্বাভাবিক রেফারেন্স সীমার মধ্য থেকে উপরে হওয়া উচিত।
থাইরয়েড সমস্যা দূর করার টিপস, Tips to get rid of thyroid problem :
থাইরয়েডের সমস্যায় আক্রান্ত মহিলাদের ক্ষেত্রে গর্ভধারণের জন্য চিকিৎসা ছাড়াও কিছু প্রাকৃতিক পদক্ষেপ রয়েছে যা গর্ভের উর্বরতা উন্নত করতে সহায়ক। সেগুলো হল :
স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় রাখুন :
- সুষম খাদ্য খাওয়া,
- নিয়মিত ব্যায়াম করা
- মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা
ইত্যাদি উর্বরতাকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
মাসিক চক্র পর্যবেক্ষণ করুন :
- একটি ডিম্বস্ফোটন ভবিষ্যদ্বাণীকারী কিট ব্যবহার করুন,
- শরীরের তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ করুন,
- থাইরয়েড কার্যক্ষমতা নিশ্চিত করুন:
- সর্বোত্তম থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা নিশ্চিত করতে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
পুষ্টিকর উপাদান গ্রহণ করুন :
- সেলেনিয়াম এবং আয়োডিনের মতো পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করা থাইরয়েডের স্বাস্থ্য এবং উর্বরতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
গর্ভবতী হওয়ার জন্য কীভাবে থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণ করা যায় ? How to control thyroid to get pregnant?
থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আপনার থাইরয়েড অবস্থার সঠিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে মূল পদক্ষেপগুলো হল :
- নিয়মিতভাবে থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা নিরীক্ষণ করতে হবে : আপনার দেহে থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা সর্বোত্তম সীমার মধ্যে রয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করার জন্য কয়েকমাস পর পর রক্ত পরীক্ষা করা অপরিহার্য।
- নির্ধারিত থাইরয়েডের ওষুধ সেবন : চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী থাইরয়েডের ওষুধ সেবন করুন। সঠিক সময় এবং সঠিক পরিমাণে ওষুধের ডোজ সংক্রান্ত বিষয়ে নজর রাখুন। আপনি যদি গর্ভধারণের পরিকল্পনা করছেন বা আপনার যদি সন্দেহ হয় যে আপনি গর্ভবতী হতে পারেন তাহলে আপনার স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীকে জানান। কারণ গর্ভবতী হওয়ার পর ওষুধের ডোজ বাড়িয়ে দেওয়া বা কম করে দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
শেষ কথা, Conclusion :
থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা উর্বরতা এবং একটি স্বাস্থ্যকর গর্ভাবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। থাইরয়েডের সমস্যাকে ভুলেই অবহেলা করতে যাবেন না। নয়তো পরবর্তী সময়ে সমস্যা বেড়ে যেতে পারে। এসব সমস্যা গর্ভধারণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।
থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি গর্ভবতী মায়ের ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু ফুটতে (ওভুলেশন) বাধা দেয়। এ জন্য যাদের থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি আছে, তাদের কনসিভ করতে সমস্যা হতে পারে। তাই পূর্ব থেকেই সাবধান থাকা জরুরি এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা করিয়ে নেওয়া শ্রেয় ।
পাশাপাশি আরেকটা কথা মাথায় রাখতে হবে যে, মায়ের থাইরয়েডের রোগ থাকলে সন্তান প্রসবের পর শিশুকে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে পরীক্ষা করতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে কোনও সমস্যার ঝুঁকি না থাকে।
Frequently Asked Questions
নিয়মিতভাবে থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা নিরীক্ষণ করতে হবে এবং নির্ধারিত থাইরয়েডের ওষুধ সেবন
TSH (থাইরয়েড-উদ্দীপক হরমোন) মাত্রা গর্ভাবস্থার আগে 0.4 থেকে 2.5 মিলিইউনিট প্রতি লিটার (mU/L) এর মধ্যে থাকা উচিত। T4 (ফ্রি থাইরক্সিন) মাত্রা স্বাভাবিক রেফারেন্স সীমার মধ্য থেকে উপরে হওয়া উচিত।
থাইরক্সিন বা টেট্রাইওডোথাইরোনিন (T4) এবং ট্রায়োডোথাইরোনিন (T3)