পেটের অতিরিক্ত মেদ বা ফ্যাট অনেকের জন্যই একটি অস্বস্তিকর বিষয়। আজকাল বয়স্কের তুলনায় কম বয়সীদের মধ্যে এই বিষয়টি বেশি লক্ষ্য করা যায়। অনেকেই হয়তো মানবেন না, কিন্তু এটা সত্যি যে ছোট ছোট অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসের কারণে আমাদের পেটে মেদ জমে। শুধু পেট নয় বরং শরীরের অন্যান্য স্থানেও মেদ জমে। আমাদের নিত্যদিনের অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলো এড়ানো গেলে এবং খাদ্য তালিকায় সামান্য বদল আনার মধ্য দিয়েই পেটের মেদ সহ কোমরের মেদ, মুখের চর্বি, উরুর মেদ, নিতম্বের মেদ কমানো সম্ভব।
নিত্যদিনের অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসের বদল, Changing unhealthy daily habits
যেসকল অভ্যাস বদল করার মধ্য দিয়ে পেটের মেদ কম করা সহজ হয়ে উঠতে পারে, সেগুলি হল :
১. দ্রুত খাওয়ার অভ্যাস বাদ দিতে হবে :
খাবার খাওয়া শুরু করার পর, খাবার পেটে যাওয়ার পর পাকস্থলী থেকে মস্তিষ্কে সংকেত পৌঁছায়। পেট ভরেছে কি ভরেনি তা বুঝতে মস্তিষ্কের প্রায় ২০ মিনিট সময় লাগতে পারে।
দ্রুত খাবার খাওয়ার ফলে পাকস্থলী থেকে মস্তিষ্কে সংকেত আদান প্রদান সঠিকভাবে হওয়ার আগেই অতিরিক্ত খাবার খেয়ে ফেলার সম্ভাবনা থাকে, কারণ ততক্ষণে পেট ভরে যাওয়ার খবরটি পাকস্থলী থেকে দ্রুত ব্রেইনে নাও পৌঁছাতে পারে। তাই দ্রুত খাওয়ার অভ্যাস এড়াতে হবে। খাওয়ার সময় খাবারের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। এই প্রক্রিয়াকে বলে ‘মাইন্ডফুল ইটিং’।
২. কোনো বেলার খাবার বাদ দেবেন না
অনেকে সকালের খাবার না খেয়ে একবারে দুপুরে খাবার খাওয়ার চিন্তা করেন। এক বেলা খাবার বাদ পড়লে সাধারণত অপরবেলায় বেশি খাবার বা অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। এভাবে পেটের মেদ বাড়ার সম্ভাবনা থাকে।
৩. বড় প্লেটের বদলে ছোট প্লেট বেছে নেওয়ার অভ্যাস করুন :
সাধারণত প্লেট আকারে যদি বড় হয় তবে প্লেটে বেশি খাবার নেওয়া যায়, ফলে অবচেতন মনেও সাধারণত অনেকেই একটু বেশী পরিমাণে খাবার নিয়ে খেয়ে ফেলে। এভাবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাওয়া হয়, ফলে ওজন বাড়ে এবং শরীরে মেদ জমে। তাই অতিরিক্ত খাওয়া এড়াতে ছোট প্লেটে খাবার নিন। খাবার প্লেটে নেওয়ার সময় পরিমাণের দিকে খেয়াল রাখবেন। এতে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত খাওয়ার সম্ভাবনা কমবে।
৪. সৌজন্যবোধ থেকে বেশি খাবেন না
নিমন্ত্রণে খেতে গেলে আমরা অনেক সময় সৌজন্যবোধ থেকে বেশি খেয়ে ফেলি। কোথাও বন্ধুবান্ধব বা পরিচিতজনের সাথে দেখা হয়ে গেলে, পেট ভরা থাকা সত্বেও আবারও খাবার অর্ডার দেয়া হয়। এই অভ্যাসগুলো ওজন তথা শরীরে মেদ বাড়তে দিতে পারে। অতিভোজন বা ‘ওভারইটিং’ হলে সেই সময় যেমন শারীরিক অস্বস্তিতে পড়তে হয়, অন্যদিকে শরীরে মেদ জমার সম্ভাবনা থাকে।
৫. আনমনে খাওয়া পরিহার করতে হবে :
খাওয়ার সময়ে অন্য কাজে ব্যস্ত না থেকে বরং কি খাচ্ছেন এবং কতটুকু খাচ্ছেন সেদিকে নজর দিন। কেউ কেউ খাবার সময় টিভিতে বা ফোনে খেলা দেখতে শুরু করে, অথবা নাটক বা অন্য কিছু দেখতে দেখতে খাওয়ার অভ্যাস থাকে অনেকের। এভাবে আনমনে প্রয়োজনের চেয়ে বেশী খাওয়া হয়ে যায়। তখন গ্রহণ করা খাদ্যগুলো সাধারণত স্বাস্থ্যকর হয় না।
৬. সাদা চাল, সাদা আটার বিকল্প বেছে নিন
গবেষণায় দেখা গেছে যে সাদা চাল ও সাদা আটার মত প্রক্রিয়াজাত শস্যদানা বেশি খাওয়ার ফলে শরীরে মেদ জমার সম্ভাবনা বেশি থাকে। অন্যদিকে লাল চাল বা ঢেঁকীছাঁটা চাল এবং লাল আটার মতো গোটা শস্যদানা বেশি খেলে পেটে মেদ সহজে জমে না। সাদা চাল, সাদা আটা তৈরি করতে গিয়ে ফাইবার বা আঁশসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান ফেলে দেওয়া হয়। ফাইবার খাবারকে আস্তে আস্তে হজম করতে সহায়তা করে। ফাইবার ফেলে দেওয়ার ফলে খাবার দ্রুত হজম হয়, রক্তে সুগারের মাত্রা দ্রুত বেড়ে যায়।
৭. ‘লো-ফ্যাট বা ফ্যাট-ফ্রি খাবার’ খাওয়ার আগে খাবারের মোড়ক যাচাই করুন :
বাজারে পাওয়া যায় লো-ফ্যাট খাবার, যা খেয়েও আমাদের দেহে মেদ তৈরি হতে পারে—কথাটা শুনে খটকা লাগতেই পারে; কিন্তু এটা সত্যি। লো-ফ্যাট বা ফ্যাটমুক্ত খাবার অস্বাস্থ্যকর হতে পারে। লো-ফ্যাট খাবার তৈরি করার সময় ফ্যাট সরিয়ে বা কমিয়ে ফেললে অনেকের কাছেই তা কম সুস্বাদু মনে হয়। তাই খাবারকে সুস্বাদু করে বিক্রি বাড়াতে এসব খাবারে অতিরিক্ত চিনি যোগ করে বাজারজাত করা হয়ে থাকে। তাই লো-ফ্যাট বা ফ্যাট-ফ্রি কোনো খাবার কেনার আগে, তাতে চিনি যোগ করা হয়েছে কি না তা মোড়কের লেখা থেকে দেখে নিন।
৮. শুয়ে বসে না থেকে অ্যাকটিভ থাকার চেষ্টা করুন :
শুয়ে-বসে থাকলে শরীরে মেদ জমে। এর চেয়ে সপ্তাহে ৫ দিন ৩০ মিনিট করে দ্রুত হাঁটার অভ্যাস করুন। দেখবেন সারা সপ্তাহে মাত্র আড়াই ঘণ্টা ব্যায়াম করার মাধ্যমেই আপনি অনেক উপকার পাবেন। এতে রোগব্যাধির সম্ভাবনা কম হবে, পাশাপাশি চর্বির পরিমাণও কমবে। এভাবে জিমে না গিয়েও ঘরে বসে, কোন যন্ত্র বা ব্যায়ামের উপকরণের সাহায্য ছাড়াও মেদ কমানোর ব্যায়াম শুরু করা যায়।
মেদ কমানোর জন্য পুষ্টিবিদের পরামর্শ করা কিছু কৌশল, Some techniques suggested by nutritionists to reduce fat
আমরা প্রায়ই ভাজাপোড়া, মুড়ি-চানাচুর এসব খাবার খাচ্ছি। এসব অতিরিক্ত, অস্বাস্থ্যকর খাবার থেকে আসে অতিরিক্ত ক্যালরি, যা শরীরে চর্বি জমার ক্ষেত্রে দায়ী। তাই মেদ কমাতে এইসব অতিরিক্ত তেলযুক্ত খাবার গ্রহণ করা এড়িয়ে চলতে হবে। তবে একটা কথা বলতেই হয় যে পেটের মেদ কমাতে হলে ডায়েট, ব্যায়াম, এই সব আপনার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হতে পারে যদি আপনি সঠিকভাবে ব্যবহার না করেন। যেসব কৌশলের মাধ্যমে শরীরের ফ্যাট গলে যাবে, সেগুলো হল :
১) মেদ কমাতে ডায়েট :
পেটের চর্বি কমাতে, পুষ্টিবিদরা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন; যেমন চর্বিহীন প্রোটিন, তাজা শাকসবজি, ফলমূল, কম চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত খাবার ইত্যাদি। মেদ কমানোর জন্য সুষম খাবার খুবই জরুরি। খাবার সময় প্লেটের অর্ধেক সালাদ দিয়ে পূরণ করতে হবে, এক চতুর্থাংশ থাকতে হবে গোটা শস্য এবং শেষ চতুর্থাংশ প্রোটিন জাতীয় খাবার যোগ করতে পারেন। এভাবেই খাবার গ্রহণ করার পরামর্শ দেন পুষ্টিবিদরা।
২) প্রতিদিন যে পরিমাণ ক্যালোরি নিতে হবে :
শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাপ অনুযায়ী ক্যালোরি গ্রহণ করার চেষ্টা করুন। অতিরিক্ত ক্যালোরি গ্রহণ করার ফলে মেদ বেড়ে যেতে পারে।
৩) প্রতিদিন ব্যায়ামের প্রয়োজন
পুষ্টিবিদরা মেদ কমানোর জন্য পরামর্শ দেন যে, সপ্তাহে তিন দিন ৫০ মিনিটের শারীরিক শক্তি প্রশিক্ষণ, ২ দিন কার্ডিও, ২ দিনের হালকা ব্যায়াম করতে হবে, যেমন সিঁড়ি বেয়ে ওঠা, ১০,০০০ স্টেপ হাঁটা ইত্যাদি।
৪) প্রতিদিন ব্যায়ামের প্রয়োজন :
পুষ্টিবিদদের মতে, মেদ ঝরাতে হলে বাইরের খাবার না খেয়ে শুধুমাত্র ঘরের রান্না করা খাবার খান। তবে কোনও দিন বাইরে খাবার খেতে গেলে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার পূর্ণ খেয়াল রাখুন। তবে বাইরের খাবারে তেল মশলার পরিমাণ বেশি থাকে, কিন্তু বাড়িতে খাবার তৈরি করার ক্ষেত্রে আপনি চাইলে প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী তেল মশলা ব্যবহার করতে পারেন। এ ছাড়া অতিরিক্ত নুন ও চিনি খাওয়া এড়িয়ে চলুন।
শেষ কথা, Conclusion
স্থূলতা বর্তমান সময়ের সবচেয়ে সাধারণ সমস্যা। এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া আরও বড় সমস্যা। শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমা হয় আরামে থাকার কারণে, যেমন বসে থাকা রুটিন এবং ফাস্ট ফুড। এমন পরিস্থিতিতে, মেদ কমাতে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ জীবনধারা পরিবর্তন করা জরুরি। উপরিউক্ত উপায়গুলো অবলম্বন করে আপনারা পেটের মেদ সহ শরীরের বিভিন্ন অংশের মেদ ঝরাতে সক্ষম হতে পারেন।