আমরা সকলেই জানি যে স্বাভাবিক রক্তচাপের পরিমাপ 120/ 80 mmHG। কিন্তু যদি তা কম বা বেশি হয় তখন চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সাধারণত মানুষ উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা নিয়ে বেশি চিন্তা করে থাকেন। কিন্তু রক্তচাপ যদি নীচে নেমে যায় তখনও তাকে অস্বাভাবিক হিসেবেই ধরা হয়। রক্তচাপ কমে গেলে তাও কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা নিম্ন রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করার উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
লো ব্লাড প্রেসারের সমস্যা, Problem of low blood pressure
আমাদের মধ্যে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা সব সময় লো ব্লাড প্রেসারের সমস্যায় ভোগেন। অনেকেই জিনগত ভাবেও এই সমস্যার শিকার। এই নিম্ন রক্তচাপের সমস্যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় হাইপোটেনশন। মহিলাদের মধ্যে ব্লাড প্রেসার লো হওয়ার প্রবণতা বেশি। ‘
কোনও কোনও মহিলা তো বুঝতেই পারেন না তিনি লো ব্লাড প্রেসারের সমস্যায় ভুগছেন। লো প্রেসারের এমনি কোনও ওষুধ নেই, কিন্তু অবহেলায় বিপদ বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রে লো ব্লাড প্রেসারের সমস্যা থাকলেও এর কোনো লক্ষণ দেখা দেয় না, ফলে তারা দিব্যি স্বাভাবিক ভাবেই আছেন। কিন্তু যাদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন লক্ষণ প্রকাশ পায় তাদের বিভিন্ন উপায়ে রক্তচাপ বাড়ানোর চেষ্টা অবশ্যই করা উচিত।
লো প্রেশার বা নিম্ন রক্তচাপের কারণসমূহ, Causes of low blood pressure
নির্দিষ্ট একটি কারণে নিম্ম রক্তচাপের সমস্যা হয় না, বরং এটি নানা কারণে হতে পারে। যেমন :
- ১) গরমে অতিরিক্ত ঘেমে শরীরে জলশূণ্যতা দেখা দিলে অনেকেই নিম্ম রক্তচাপের সমস্যায় আক্রান্ত হয়।
- ২) সঠিক খাবার না খেলে নিম্ম রক্তচাপের সমস্যা হতে পারে।
- ৩) অতিরিক্ত পরিশ্রম।
- ৪) দুশ্চিন্তা, মানসিক অস্থিরতা, ভয় ইত্যাদি কারণেও নিম্ম রক্তচাপের সমস্যা হতে পারে।
- ৫) শরীরে পুষ্টিজনিত সমস্যা থাকলেও নিম্ম রক্তচাপের সমস্যা হয়।
- ৬) অপর্যাপ্ত ঘুমের জন্যও নিম্ম রক্তচাপের সমস্যা হয়ে যায়।
- ৭) ডায়রিয়া হলে কিংবা ডায়রিয়ার সময় অত্যাধিক বমি হয়ে ডিহাইড্রেশনের ফলে নিম্ম রক্তচাপের সমস্যা হয়।
- ৮) হজমের ব্যাঘাত ঘটলেও নিম্ম রক্তচাপের সমস্যা হতে পারে।
- ৯) কোথাও কেটে গিয়ে বা অন্য কোন কারণে অতিরিক্ত রক্তপাত ঘটলেও নিম্ম রক্তচাপের সমস্যা হয়ে যায়।
- ১০) শরীরে রক্তশূণ্যতা দেখা দিলে নিম্ম রক্তচাপের সমস্যা হয়।
- ১১) হরমোনের ভারসাম্যহীনতা।
- ১২) গর্ভাবস্থায় হরমোনের প্রভাবে নিম্ম রক্তচাপের সমস্যা হয়ে থাকে।
নিম্ম রক্তচাপের লক্ষণ, Symptoms of low blood pressure
নিম্ম রক্তচাপের সমস্যার লক্ষণগুলো হল :
- মাথা ঘোরা।
- চোখের সামনে অন্ধকার দেখা।
- অজ্ঞান হয়ে পড়া।
- বসা থেকে উঠে দাঁড়ালে হঠাৎ মাথা ঘুরে যাওয়া বা ভারসাম্যহীন হয়ে যাওয়া।
- খুব বেশী তৃষ্ণা অনুভূত হওয়া।
- ঘনঘন শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া।
- ক্লান্তি অনুভব হওয়া।
- হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া।
- হঠাৎ অতিরিক্ত ঘাম হওয়া ইত্যাদি।
রক্তচাপ কম থাকলে প্রায়শই উক্ত সমস্যাগুলো দেখা দেবে। এমন অবস্থায় অনেক সময় মস্তিষ্কে সঠিক পরিমাণে রক্ত পৌঁছতে পারে না, যার ফলে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। কিছু মানুষের ক্ষেত্রে শ্বাস নিতে অসুবিধেও হতে পারে।
নিম্ম রক্তচাপের সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করার উপায়, Ways to control low blood pressure
নিম্ম রক্তচাপের সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মেনে চলতে পারেন কয়েকটি ঘরোয়া টোটকা। সেগুলি হল :
- রোজ সকালে চা কিংবা কফি খেতে পারেন। আমরা সকলেই জানি যে চা আমাদের শরীর ও মনকে চনমনে করে তোলে, তাছাড়া যারা কফি খান তাদের ক্ষেত্রে কফিতে থাকে ক্যাফেইন দেহে উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। তাই যখনই মাথা ঘোরা বা চোখের সামনে সবকিছু আবছা হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয় তখন এক কাপ গরম চায়ে বা কফিতে চুমুক দিন। তবে দুধ, চিনি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন। গ্রিন টি, লিকার চা এসবই খাওয়া উচিত।
- গরমের দিনে অতিরিক্ত ঘাম হওয়ার ফলে ঘামের সাথে শরীর থেকে বহু খনিজ উপাদান বের হয়ে যায়। তাই ক্লান্তি অনুভব হয়, পাশাপাশি রক্তচাপ কম হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই গরমের দিনে নিয়ম করে রোজ এক গ্লাস করে নুন-চিনি-লেবুর শরবত খান। এতে রক্তচাপের সমস্যা থাকবে নিয়ন্ত্রণে, সাথে শরীর হাঁটাচলার এনার্জিও পাবে।
- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে গরমের দিনে খেতে পারেন বাটার মিল্ক। বাটার মিল্ক কিন্তু শরীরের জন্যেও খুব ভাল। আগেকার সময়ে এটি নিজের ঘরেই তৈরি করা হত, তবে আজকাল ছাঁচ বাজারে কিনতেই পাওয়া যায়। এছাড়াও চাইলে দই একটু জল মিশিয়ে পাতলা করে তার সাথে নুন আর জিরের গুঁড়ো মিশিয়েও ঘরেই বানিয়ে নিতে পারেন ঘোল। এটি খেলে শরীর ঠাণ্ডা থাকবে, পাশাপাশি শক্তিও পাবেন, ফলে রক্ত চলাচল সঠিকভাবে হবে।
- আদা, দারচিনি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। তাই চা বানানোর সময় এই দুই উপাদান যোগ করতে পারেন, এতে রক্তচাপের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তাছাড়া দুধের মধ্যে খেজুর দিয়েও খেতে পারেন। অথবা রোজ কিছু ড্রাই ফ্রুট খাওয়ার অভ্যাস করুন, যেমন কিসমিস, কাঠ বাদাম, পেস্তা ইত্যাদি, এতেও এই সমস্যার সমাধান হয়। তাছাড়া নিয়মিত ভাবে টমেটো, গাজর খেলেও রক্তচাপের সমস্যা থেকে উপকার পাওয়াব যায়।
- রোজ সকালে খালি পেটে একগ্লাস ইষদুষ্ণ জল খাওয়ার অভ্যাস করুন। সাথে ৭-৮টা তুলসি পাতা চিবিয়ে খান। তুলসি পাতার মধ্যে থাকে ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, আর এই উপাদানগুলো আমাদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও তুলসি পাতা চা এর মধ্যে দিয়েও খেতে পারেন। তাছাড়া তুলসী পাতার মধ্যে থাকে ইগেনোল নামে পরিচিত এন্টি অক্সিডেন্ট, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সহায়তা করে।
- নিম্ন রক্তচাপের সমস্যা এড়াতে চাইলে সারাদিন অল্প অল্প করে কিছু না কিছু স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া উচিত। সাধারণত আমরা সারা দিনে তিনবার খাই, কিন্তু তার পরিবর্তে যদি আপনি আপনার রোজকার খাওয়া-দাওয়াকে পাঁচটি ছোট ভাগে ভাগ করে নেন, তাহলে বেশি উপকার পাওয়া যাবে। এমনকি এটি ডায়াবিটিস রোগীদের জন্যেও কার্যকরী।
- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাদাম দুধ খেতে পারেন। এটি শক্তিবর্ধক হিসেবেও কাজ করে। রাতে ঘুমনোর আগে ৭-৮ টি কাঠবাদাম জলে ভিজিয়ে রাখুন। সকালে সেগুলোর খোসা ছাড়িয়ে পেস্ট করে নিন। এবার এক গ্লাস ইসোদুষ্ণ দুধ নিয়ে তাতে বাদামের পেস্ট মিশিয়ে নিন। এই দুধ পান করুন এতে শরীরে রক্ত চলাচল সঠিকভাবে হবে। আলমন্ড দুধে কোলেস্টেরল কিংবা অপ্রয়োজনীয় চর্বি নেই, বরং এতে থাকে ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড। যে সব মানুষের লো ব্লাড প্রেসার রয়েছে তাদের সকলেরই এটি অবশ্যই খাওয়া উচিত।
- বিটের রস হাই প্রসার ও লো প্রেসার উভয়ের জন্যই উপকারী। বিট রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই হাইপোটেনশনের রোগীরা দিনে এক কাপ বিটের রস খেতে পারেন। এভাবে এক সপ্তাহ খেলে উপকার দেখতে পাবেন। এরজন্য বিট কুচিয়ে নিয়ে সেগুলো চিপে রস আলাদা করে নিন, এতে এক চিমটি লবণ যোগ করতে পারেন। তবে কুচানো টুকরোগুলো ফেলে না দিয়ে সেগুলো সালাদের সাথেও উপভোগ করতে পারেন।
- বিটের রসের মত গাজরের রসও দেহের জন্য বেশ উপকারী, তাই রোজ না পারলেও সপ্তাহে অন্তত ৪ দিন গাজরের রস করে খেয়ে দেখুন। শরীরে সুস্থতা বজায় থাকবে।
- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে শরীরকে হাইড্রেটেড রাখা জরুরি। তাই জল সঠিক পরিমাণে খেতে হবে। চাইলে মাঝে মাঝে ডাবের জলও খেতে পারেন, কারণ এতে থাকে সোডিয়াম যা আমাদের দেহে সোডিয়ামের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। পাশাপাশি শরীরকে হাইড্রেটেড রাখে।
শেষ কথা, Conclusion
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে অনেকই সচেতন থাকে তবে নিম্ন রক্তচাপ নিয়ে কেউই গুরত্ব দেয় না। রক্তচাপ বৃদ্ধি বা হ্রাস দুটোই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। নিম্ন রক্তচাপ বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তেমন ক্ষতির কারণ হয় না। তবে নিম্ম রক্তচাপের সমস্যা যদি দীর্ঘমেয়াদি হয় তবে এটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক হয়ে উঠে। তাই উপরিউক্ত উপায়গুলো মেনে চলুন এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করুন।