সুস্থ থাকতে চাইলে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরী। অতিরিক্ত ওজন দেহে বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। উচ্চতার সঙ্গে ওজনের সামঞ্জস্যতা প্রত্যেকটি মানুষের ক্ষেত্রেই থাকা প্রয়োজন। তবে অনেকেই হয়তো জানেন না যে উচ্চতা অনুযায়ী আপনার ওজন কত হওয়া প্রয়োজন।
বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী কত ওজন থাকলে আপনি ফিট? How much weight according to age and height are you fit?
অনেকের মনেই প্রশ্ন থাকে যে উচ্চতা এবং বয়স অনুযায়ী একজন ব্যক্তির কত ওজন হওয়া উচিত? এই প্রশ্নের একক উত্তর দেওয়া সহজ নয়, তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে একজন ব্যক্তির শরীরের ধরন, তার জীবনধারা, শারীরিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে এটি সম্পর্কযুক্ত। তবুও, কেউ চাইলেই সঠিক উচ্চতা থেকে ওজনের অনুপাত জেনে নিয়ে, নিজের ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, যা আপনাকে স্থূলতার মতো রোগ থেকে দূরে থাকতে সহায়তা করতে পারে।
উচ্চতা অনুযায়ী ওজন বজায় রাখতে না পারলে আমরা নানা রোগকে আমন্ত্রণ জানাব। অনেকেই জানেন না তাঁদের উচ্চতা অনুযায়ী কত ওজন থাকা উচিত। এই গণনাটি সাধারণত BMI (বডি ম্যাক্স ইনডেক্স) এর উপর ভিত্তি করে করা হয়, যা উচ্চতার সাথে সঠিক ওজন নির্ণয়ের একটি সাধারণ গাণিতিক সমাধান।
উচ্চতা অনুযায়ী আদর্শ ওজন নির্ণয় পদ্ধতি, Standard weight according to height method
আদর্শ ওজন মাপার পদ্ধতিতে প্রথমে একজন ব্যক্তির ওজন কিলোগ্রামে মাপা হয় আর উচ্চতা মাপা হয় মিটারে। কারও আদর্শ ওজন মাপতে হলে ওজনকে উচ্চতার বর্গফল দিয়ে ভাগ করতে হয়। এই ভাগফলকেই BMI বলা হয়; বডি মাস ইনডেক্স (BMI) হলো শরীরের উচ্চতা ও ওজনের আনুপাতিক হার, যা দিয়ে বোঝা যায় যে কোনো ব্যক্তি মাত্রাধিক ওজন বিশিষ্ট কিনা। এই BMI ১৮ থেকে ২৪-এর মধ্যে হলে তা স্বাভাবিক বলে মনে করা হয়। BMI এর মান বেশি হলে একে চিকিৎসার ভাষায় বলা হয় ওবেসিটি।
ওবেসিটি বলতে কী বোঝায়? What does obesity mean?
কোনও ব্যক্তির বিএমআই-এর মানের স্বাভাবিক সীমা, ২০-২৫ এর মধ্যে। কিন্তু, বিএমআই-এর মান ২৫-৩০ এর মধ্যে হলে বলা হয় সেই ব্যক্তি মোটা, ৩০ এর বেশি হলে চিকিৎসা পরিভাষায় বলা হয় ক্লাস-১ ওবেসিটি, ৩০-৩৫ হলে ক্লাস-২, ৩৫-৪০ হলে ক্লাস-৩ এবং ৪০ এর বেশি হলে সুপার ওবেসিটি।
ওবেসিটি হলে কী কী সমস্যা হতে পারে? What problems can obesity cause?
ওবেসিটি-র কারণে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। বলাই বাহুল্য, ওবেসিটি বিভিন্ন রোগকে ডেকে আনে। যেমন, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস মেলিটাস, অস্টিও আরথ্রাইটিস, বন্ধ্যাত্ব, নিদ্রাহীনতা, মানসিক অবসাদ, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি। এছাড়াও ওবেসিটির সঙ্গে ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বেড়ে যাওয়ারও আশঙ্কা থাকে। একে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ‘মেটাবলিক সিনড্রোম’ বলা হয়।
উচ্চতা অনুযায়ী ওজন কত হওয়া প্রয়োজন, What should be the weight according to the height
জেনে নিন সাধারণভাবে উচ্চতা অনুযায়ী ওজন কত হওয়া প্রয়োজন :
- ১. ৪ ফুট ৭ ইঞ্চি থেকে ৫ ইঞ্চির জন্য ওজন থাকতে হবে ৪০-৫৮ কেজি; এটি পুরুষের জন্য প্রযোজ্য। আর নারীর জন্য ৩৬-৫৫ কেজি।
- ২. ৫ ফুট ১ ইঞ্চি পুরুষের ওজন ৪৮-৬০ কেজি ও নারীর ৪৫-৫৭ কেজি।
- ৩. ৫ ফুট ২ ইঞ্চি পুরুষের ওজন ৫০-৬০ কেজি ও নারীর ৪৬-৫৮ কেজি।
- ৪. ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি পুরুষের ওজন ৫১-৬৩ কেজি ও নারীর ৪৮-৬১ কেজি।
- ৫. ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি পুরুষের ওজন ৫২র ৬৬ কেজি ও নারীর ৪৮-৬৩ কেজি।
- ৬. ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি পুরুষের ওজন ৫৫-৬৮ কেজি ও নারীর ৫০-৬৫ কেজি।
- ৭. ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি পুরুষের ওজন ৫৬-৭০ কেজি ও নারীর ৫৩-৬৭ কেজি।
- ৮. ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি পুরুষের ওজন ৫৭-৭২ কেজি ও নারীর ৫৪-৬৯ কেজি।
- ৯. ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি পুরুষের ওজন ৬০-৭৪ কেজি ও নারীর ৫৬-৭১ কেজি।
- ১০. ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি পুরুষের ওজন ৬৩-৭৬ কেজি ও নারীর ৫৭-৭২ কেজি।
- ১১. ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি পুরুষের ওজন ৬৫-৭৯ কেজি ও নারীর ৫৯-৭৩ কেজি।
- ১২. ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি পুরুষের ওজন ৬৭-৮১ কেজি ও নারীর ৬১-৭৫ কেজি।
- ১৩. ৬ ফুট পুরুষের ওজন ৬৯-৮৩ কেজি ও নারীর ৬৩-৭৭ কেজি।
- ১৪. ৬ ফুট ১ ইঞ্চি পুরুষের ওজন ৭১-৮৫ কেজি ও নারীর ৬৫-৭৯ কেজি।
- ১৫. ৬ ফুট ২ ইঞ্চি পুরুষের ওজন ৭৩-৮৭ কেজি ও নারীর ৬৭-৮১ কেজি।
বয়স ও ওজনের মধ্যে সম্পর্ক, Relationship between age and weight
কোন বয়সে কত ওজন আদর্শ জেনে নিন :
- ১৯-২৯ বছর বয়সী একজন পুরুষের ওজন ৮৩.৪ কেজি হওয়া উচিত এবং একজন মহিলার ওজন ৭৩.৪ কেজি পর্যন্ত হওয়া উচিত।
- ৩০-৩৯ বছর বয়সী একজন পুরুষের ওজন ৯০.৩ কেজি পর্যন্ত হওয়া উচিত, অন্যদিকে একজন মহিলার ওজন ৭৬.৭ কেজি পর্যন্ত হওয়া উচিত।
- ৪০-৪৯ বছর বয়সী একজন পুরুষের ওজন ৯০.৯ কেজি এবং একজন মহিলার ৭৬.২ কেজি হওয়া উচিত।
- ৫০-৬০ বছর বয়সী পুরুষের ওজন ৯১.৩ কেজি এবং একজন মহিলার ওজন ৭৭.০ কেজি পর্যন্ত হওয়া উচিত।
উচ্চতা অনুযায়ী ওজন কম হওয়ার জটিলতা, Complications of losing weight according to height
কারও ওজন যদি স্বাভাবিকের চেয়ে কম হয়, তবে তার কারণ হবে যথেষ্ট পরিমাণ খাবার না খাওয়া, এছাড়া অপুষ্টিতে ভোগা অথবা কোনো রোগে আক্রান্ত হওয়াও এর পেছনে দায়ী হতে পারে। উচ্চতার অনুপাতে অস্বাভাবিকভাবে কম ওজন হলে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। যেমন—
- পুষ্টিহীনতা
- রক্তশূন্যতা
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া
- হাড় ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া ও অস্টিওপোরোসিস
- মাসিক ও গর্ভধারণে সমস্যা হওয়া
তবে একজন সুস্থ ও নীরোগ মানুষ কম ওজনের অধিকারী হতেই পারেন। কিন্তু তিনি জীবনধারায় যদি স্বাস্থ্যকর খাবারের অভ্যাস মেনে চলেন এবং নিয়মিতভাবে শরীরচর্চা করে থাকেন, তাহলে তার ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা কম হলেও সাধারণত ওজন বাড়ানোর প্রয়োজন হয় না। তবে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সঠিক পরিমাণ ও স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করা খুব জরুরী।
উচ্চতা অনুযায়ী ওজন নিয়ন্ত্রণ, Weight control according to height
কোনো ব্যক্তির বিএমআই স্বাভাবিক সীমার মধ্যে থাকলেও যদি ওজন ও মেদ সময়ের সাথে ক্রমশ বাড়তে থাকে, তাহলে হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, পিত্তথলির পাথর ও টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও তাল মিলিয়ে বেড়ে যায়।
আমাদের গ্রহণ করা খাবার থেকে আমাদের দেহে জমা হওয়া শক্তি বা ক্যালরির পরিমাণ যখন প্রতিদিন খরচ হওয়া শক্তির চেয়ে বেশি হয় তখনই ওজন বাড়তে শুরু করে, যার ফলে অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতার মতো স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। তাই ওজন কমাতে হলে প্রয়োজন হল একটি সুস্থ জীবনধারা।
এর জন্য বিশেষভাবে কিছু করতে হবে না, বরং নিজের মধ্যেই কিছু পরিবর্তন এনে একটি সুস্থ জীবনধারা চর্চা করা সম্ভব। এরজন্য স্বাস্থ্যকর খাবারের অভ্যাস মেনে চলতে হবে, পাশাপাশি নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে।
খাবারের তালিকা থেকে ফ্যাট ও চিনিযুক্ত ক্যালরিবহুল খাবারগুলোর পরিমাণ কম করে দিতে হবে। দেহের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোর চাহিদা মেটাতে বেশি বেশি ফলমূল, শাকসবজি, ডাল, পূর্ণশস্য (যেমন: লাল চাল ও লাল আটা) ও বাদামজাতীয় খাবার ডায়েটে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এক কথায় বলতে গেলে দৈনন্দিন অভ্যাসে ছোটো ছোটো কিছু পরিবর্তন এনেও ওজন কমানোর প্রচেষ্টা করা যায়।
শেষ কথা, Conclusion
প্রত্যেক ব্যক্তির তাদের উচ্চতা অনুযায়ী ওজন বজায় রাখা উচিত। শরীরে যেন মেদ না জমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে, পাশাপাশি দেহে পুষ্টির অভাব যেন না হয় সেটাও নিশ্চিত করতে হবে, তবেই সুস্থ ও সবল থাকা সম্ভব। আশা করি আজকের এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আপনারা উচ্চতা অনুযায়ী ওজন কত হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে জানতে পেরেছেন।