জলাতঙ্ক রোগের নাম সকলেই শুনেছেন। এই রোগের উল্লেখ সবাইকে আতঙ্কিত করে দেয়। তবে পূর্ব থেকেই যদি এই জলাতঙ্ক রোগ সম্পর্কে সঠিক ধারণা এবং প্রতিরোধের উপায় জানা থাকে তবে কোনো জলাতঙ্ক আক্রান্ত প্রানীর কামড় দিলেও সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা জলাতঙ্ক রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
জলাতঙ্ক কি? What is rabies?
জলাতঙ্ক রোগ হাইড্রোফোবিয়া নামেও পরিচিত। এটি মূলত ভাইরাল সংক্রমণ যার সঠিক চিকিৎসা না হলে মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। এটি সংক্রামক রোগ যা খামার বা বন্য প্রাণীদের দ্বারা সংক্রামিত হয়; যেমন : কুকুর, বিড়াল, শেয়াল, রেকুন ইত্যাদি। জলাতঙ্ক রোগকে জুনোটিক রোগের অধীনে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে (জুনোটিক মানে প্রাণীদের সাথে সম্পর্কিত)।
জলাতঙ্ক ভাইরাসের নাম কি? What is the name of the rabies virus?
জলাতঙ্ক হল ভাইরাস জনিত এক ধরনের জুনোটিক রোগ (অর্থাৎ যে রোগ টি প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ায়)। রেবিজ ভাইরাস নামক এক ধরনের নিউরোট্রপিক ভাইরাস দিয়ে এই রোগ হয়। এই রোগ সাধারণত গৃহপালিত প্রাণী ও বন্য প্রাণীদের প্রথমে সংক্রমিত করে।
জলাতঙ্ক রোগের কারণ, Causes of rabies
মানুষের মধ্যে জলাতঙ্ক রেবিস ভাইরাসে আক্রান্ত প্রাণীর কামড়ের কারণে হয়। আক্রান্ত প্রাণীর লালার মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়ায়। খামারের প্রাণী যেমন কুকুর, গরু, ছাগল, ঘোড়া, খরগোশ এবং বন্য প্রাণী যেমন বাদুড়, কোয়োটস, শিয়াল এবং হায়েনারা আক্রান্ত হলে এগুলো জলাতঙ্ক ছড়াতে পারে। ভারতে, জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত কুকুরগুলি সংক্রমণের সবচেয়ে সম্ভাব্য উৎস, কারণ পোষা প্রাণীদের সাধারণত এসব রোগের টিকা দেওয়ানো হয়।
জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ ও উপসর্গ, Signs and symptoms of rabies :
জলাতঙ্কের উপসর্গ এবং লক্ষণগুলি দেখা দেওয়া পর্যন্ত ভাইরাসটি মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়ে এনসেফালাইটিস সৃষ্টি করে ফলে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু ঘটে।জলাতঙ্কের ইনকিউবেশন পিরিয়ড অর্থাৎ উপসর্গ এবং লক্ষণগুলি প্রকাশের পূর্বে রোগটি ব্যক্তির শরীরে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। এই রোগের প্রাথমিক উপসর্গগুলি হল মাথাব্যথা, গলা ব্যথা, জ্বর এবং আক্রান্ত জায়গায় খিঁচুনি।
এছাড়াও যেসব উপসর্গ দেখা দেয় সেগুলি হল :
অত্যধিক লালা নিঃসরণ, গিলতে অসুবিধা, উদ্বেগ, বিভ্রান্তি, অনিদ্রা আংশিক পক্ষাঘাত এবং কখনও কখনও কোমার মতো লক্ষণগুলি জলাতঙ্কের ইঙ্গিত দেয়।এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি শব্দ, আলো এবং এমনকি বাতাসের ঠান্ডা স্রোতে অসহিষ্ণু হয়ে যায়। বমি ভাব, বমি হওয়া, হিংসাত্মক আচরণ, অনিয়ন্ত্রিত শারীরিক উত্তেজনা, জলের প্রতি ভয়, চেতনা হ্রাস ইত্যাদি।
জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ কত দিন পর দেখা দেয়? After how many days symptoms of rabies appear?
রেবিস ভাইরাসে আক্রান্ত প্রাণী বা মানুষ সুস্থ কাউকে কামড়ালে ওই সুস্থ ব্যক্তিও জলাতঙ্কে আক্রান্ত হন। এ রোগে আক্রান্ত হলে ফুসফুস, স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চিকিৎসকদের মতে, রেবিস আক্রান্ত প্রাণীর কামড় খাওয়ার ২ থেকে ৩ মাসের মধ্যে রোগীর মধ্যে জলাতঙ্ক রোগের উপসর্গ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
জলাতঙ্ক রোগ নির্ণয়, Diagnosis of rabies :
যদি কোনো ব্যক্তিকে রাস্তার কুকুর বা বন্য প্রাণী কামড়ায়, তবে জীবন বাঁচাতে অবিলম্বে টিকা দেওয়া উচিত। যদি প্রাণীটি একটি পোষা প্রাণী হয় সেক্ষেত্রে প্রাণীর মালিক পশুচিকিৎসকের থেকে যাচাই করিয়ে নিতে পারে যে প্রাণীটি র্যাবিস আক্রান্ত কিনা, যদি আক্রান্ত না হয় তবে শুধুমাত্র এই ক্ষেত্রেই ব্যক্তিটিকে টিকা নেওয়া প্রয়োজন নাও হতে পারে। জলাতঙ্কের পরীক্ষা করার ক্ষেত্রে ইমিউনোফ্লোরেসেন্স নামক একটি পদ্ধতিতে ত্বকের একটি ছোট টিস্যু ব্যবহার করে রেবিস অ্যান্টিজেন সনাক্ত করা যায়। সংক্রামিত রোগীর লালা থেকেও পরীক্ষা করা যেতে পারে। স্বাস্থ্যসেবা পেশাদাররা আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তের নমুনা, মেরুদণ্ডের তরল এবং ত্বকের নমুনা পরীক্ষা করে জলাতঙ্ক নির্ণয় করে।
সব কুকুর কামড়ালে কি জলাতঙ্ক হয়? Do all dog bites cause rabies?
বিশেষ করে র্যাবিস আক্রান্ত কুকুর কামড় দিলে ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে জলাতঙ্ক রোগ হতে পারে। তবে কুকুর কামড় দিলেই যে জলাতঙ্ক রোগ হবে তা কিন্তু ঠিক নয়, কুকুরের মধ্যে জলাতঙ্কের জীবাণু থাকতে হবে। র্যাবিস ভাইরাসে আক্রান্ত কুকুরের লালা থেকে ভাইরাসটি ছড়ায়।
১০ বছর পর কি জলাতঙ্ক হতে পারে? Can rabies occur after 10 years?
মানুষের মধ্যে জলাতঙ্কের ইনকিউবেশন সময়কাল সাধারণত 20-60 দিন। তবে, ফুলমিনান্ট রোগ 5-6 দিনের মধ্যে লক্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে; আরও উদ্বেগজনক, 1%-3% ক্ষেত্রে ইনকিউবেশন পিরিয়ড >6 মাস। নিশ্চিত জলাতঙ্ক এক্সপোজার পরে 7 বছর পর্যন্ত ঘটেছে , কিন্তু এই দীর্ঘ বিলম্বের কারণ অজানা।
কুকুরের নখের আচরে কি রেবিস রোগ হয়? Can rabies be caused by a dog’s scratch?
কুকুরের নখ থেকেও র্যাবিস ভাইরাস ছড়ায়। চেনা বা অচেনা যে কোনও কুকুর আঁচড়ালে যদি চিরে যায়, রক্ত না বেরয়, তাহলে প্রথমে নিয়ম মেনে ওই জায়গাটি উচ্চ ক্ষারযুক্ত সাবান ও ২ শতাংশ পোভিডিন আয়োডিন দিয়ে ধুতে হবে মিনিট ১৫ ধরে। তারপর অবশ্যই ভ্যাকসিন নিতে হবে।
জলাতঙ্ক রোগের প্রতিকার কি? What is the treatment for rabies?
জলাতঙ্ক রোগ প্রতিরোধের উপায় হলো টিকা নেওয়া। এই ভাইরাসের বেশ কিছু টিকা আবিষ্কার হয়েছে তবে সবচেয়ে নিরাপদ টিকা হলো হিউম্যান ডিপ্লয়েড সেল ভ্যাকসিন(HDCV)। অন্যান্য টিকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পিউরিফাইড চিক ইমব্রিও সেল ভ্যাকসিন, ডাক ইমব্রিও সেল ভ্যাকসিন, নার্ভ টিস্যু ভ্যাকসিন ইত্যাদি।
জলাতঙ্ক রোগের টিকার দাম কত? How much does the rabies vaccine cost?
নোভার্টিসের রেবিস ভাইরাস টিকার এক ডোজের দাম ৬৪০ টাকা। ইনসেপ্টা কোম্পানির এক ডোজের দাম ৫০০ টাকা। অন্যান্য কোম্পানিও একই দামে ওষুধ বাজারজাত করছে।
জলাতঙ্ক কি নিরাময় করা যেতে পারে? Can rabies be cured?
জলাতঙ্কের ইনকিউবেশন সময়কাল কয়েক দিন থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত হতে পারে। জলাতঙ্ক রোগের ক্ষেত্রে সাধারণত মানুষের মধ্যে 1-3 মাস ইনকিউবেশন পিরিয়ড থাকে। জলাতঙ্ক নিরাময়ের টিকা নেওয়া হল এই রোগ নিরাময়ের একমাত্র উপায়। যেহেতু এই রোগের উপসর্গ বুঝতে দেরি হয়, তাই কখনো কুকুর বা অন্য প্রাণী কামড়ালে বা আঁচড়ালে শীঘ্রই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া বাঞ্ছনীয়।
জলাতঙ্ক প্রতিরোধের টিপস, Rabies prevention tips :
এখানে কিছু টিপস রয়েছে জলাতঙ্কে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে:আপনার যদি বিড়াল, কুকুরের মতো পোষা প্রাণী থাকে তবে নিশ্চিত করুন যে তাদেরকে জলাতঙ্কের টিকা দেওয়া হয়েছে। যখন আপনার পোষা প্রাণী বাইরে থাকে তখন তাকে সর্বদা তত্ত্বাবধানে রাখার চেষ্টা করুন। বাড়ির বাইরে যেন না যায় সেদিকে খেয়াল করতে হবে। শিকারী প্রাণীদের থেকে আপনার পোষা প্রাণীকে রক্ষা করুন। অস্বাভাবিক আচরণ করে এমন উশৃঙ্খল প্রাণী আপনার কাছাকাছি থাকলে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে রিপোর্ট করুন।বন্য প্রাণীর থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন।
শেষ কথা, Conclusion :
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বুঝতেই পারছেন যে জলাতঙ্ক হল একটি মারাত্মক ভাইরাল রোগ যা মানুষ এবং প্রাণী উভয়ের জন্যই বিপদজনক। সংক্রামিত প্রাণীর কামড় বা আঁচড়ের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি একবার যদি জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়, তবে এই রোগের লক্ষণগুলি দেখা দিলে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে গিয়েও চিকিৎসা করতে দেরি হয়ে যায়। তাই পূর্ব থেকে সতর্ক হতে হবে। পোষা প্রাণীর টিকা এবং বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জলাতঙ্ক প্রতিরোধ করা যায়। জলাতঙ্ক একটি সার্বজনীন স্বাস্থ্য সমস্যা, তবে পূর্ব থেকেই এই রোগ প্রতিরোধ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান এবং সতর্কতা বজায় রাখে সহজে এই রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে।
Frequently asked questions
জলাতঙ্ক রোগের প্রাথমিক উপসর্গগুলি হল মাথাব্যথা, গলা ব্যথা, জ্বর এবং কামড়ের জায়গায় খিঁচুনি।
সংক্রামিত প্রাণীর লালার সংস্পর্শে এসে জলাতঙ্ক ছড়ায়।
জলাতঙ্কের উপসর্গগুলি না দেখা গেলে বা সময়মতো ভাইরাস শনাক্ত করেলে এটি পরিচালনা এবং চিকিত্সা করা যেতে পারে।