আমরা কতটা লম্বা হব সেটা জিনগত বিষয়, শৈশবকালীন পুষ্টি, এক্সারসাইজ ইত্যাদি অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। উচ্চতা নিয়ে যারা সমস্যায় পড়েছেন তাদের উদ্দেশ্যে আজকের এই প্রতিবেদন। নির্দিষ্ট কিছু অভ্যাস রোজ মেনে চললে ৫ সেমি থেকে প্রায় ১ ইঞ্চি পর্যন্তও উচ্চতা বৃদ্ধি করতে পারবেন। তবে এই বিষয়টাকে উচ্চতা বৃদ্ধি না বলে, বরং আপনার আসল উচ্চতার প্রাপ্তি বলে ধরে নেওয়াই হয়তো সঠিক হবে।
উচ্চতা বৃদ্ধির বয়স সীমা, Age limit for height gain :
অনেকেই হয়তো জানেন, সাধারণত ১৮-২১ বছর বয়সের পর উচ্চতা আর বৃদ্ধি পায় না। তবে নির্দিষ্ট কিছু অভ্যাস মেনে চলার মাধ্যমে এই বয়সের পরেও উচ্চতা বৃদ্ধি পেতে পারে। কিন্তু এটাও জেনে রাখা উচিত যে, প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে উক্ত নিতমগুলোতে দীর্ঘমেয়াদে সামান্য উপকার পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
উচ্চতা বৃদ্ধির কিছু সাধারণ নিয়ম, Some general rules for increasing height :
সাধারণত ১৮ থেকে ২১ বছর বয়সের পর উল্লেখযোগ্য হারে মানুষের উচ্চতা বৃদ্ধি ঘটে না। নির্দিষ্ট কিছু অভ্যাস মেনে চললে আধা ইঞ্চি থেকে এক ইঞ্চি পর্যন্ত উচ্চতা বাড়তে পারে। এখানে উচ্চতা বৃদ্ধির কিছু সাধারণ নিয়ম দেওয়া হল।
দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা :
অনেকেই এমন আছেন যারা নিজের অজান্তে ঝুঁকে দাঁড়ান বা হাঁটেন। এই অভ্যাস ত্যাগ করতে রোজ একটা দেওয়ালে পিঠ টানটান করে দাঁড়ান। এরপর কাঁধ দুটি পিছিয়ে নিয়ে গিয়ে দেওয়ালে ঠেকানোর অভ্যাস গড়ে তুলুন। হাঁটার সময় মেরুদন্ড ও ঘাড় সোজা রাখার চেষ্টা করুন। কাঁধ পেছনের দিকে টানটান রেখে কুঁজো হওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করুন। রোজ বেশ কয়েকবার এটি করলে আপনাকে পূর্বের তুলনায় লম্বা লাগবে।
নিয়মিত স্ট্রেচিং করুন :
আমাদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষেরই দিনের বেশিরভাগ সময় বসে অথবা দাঁড়িয়ে কাটে। এর ফলে আমাদের দেহের ভঙ্গিমায় উপর প্রভাব পড়ে। এর ফলস্বরূপ আমাদের মেরুদন্ড ঝুঁকে যায়। অনেকের ক্ষেত্রে এটি অভ্যাস পরিণত হয়, ফলে তাদের কাঁধ এবং ঘাড় সামনের দিকে ঝুঁকে থাকে। এর ফলে উচ্চতা আরও কম লাগে। তাই এই অভ্যাস ত্যাগ করে দেহের ভঙ্গিমা ঠিক রাখতে হবে। এর জন্য নিয়মিত ঘাড়, কাঁধ, মেরুদন্ডের স্ট্রেচিং করুন। ১ মাস করলেই পার্থক্য টের পাবেন।
পেটের পেশি শক্ত করতে হবে :
সঠিক উচ্চতা পেতে নিয়মিত কোর এক্সারসাইজ করুন। এক্সারসাইজ যেমন : ক্রান্চ, প্ল্যাঙ্ক, পেটের পেশির স্ট্রেচিং ইত্যাদি নিয়মিত করুন। যদি আপনার কোর মাসেল শক্ত হয় তবে আপনার বডির পশ্চার ভাল হবে।
সুষম আহার বজায় রাখুন :
রোজ পাতে পর্যাপ্ত প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, শাক-সবজি রাখার চেষ্টা করুন। অল্পবয়সীদের ক্ষেত্রে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অনেক সময় পুষ্টির অভাবে উচ্চতা বৃদ্ধি আটকে যায়।
তাছাড়া এমনিতেও প্রত্যেকেরই সুষম আহার করা প্রয়োজন। সুষম খাদ্যাভ্যাস অর্থাৎ শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ী সবরকম পুষ্টি উপাদান (প্রোটিন, শর্করা, ফ্যাট, ভিটামিন ও মিনারেল) সঠিক অনুপাতে প্রতিদিনের খাবারে গ্রহণ করা জরুরি। কোন বেলায় কোন খাবার, কতটা পরিমাণ খেতে হবে, সেটা জেনে বুঝে খাওয়া উচিত।
কোনো খাবার বেশি খাওয়া বা কোনো খবর বাদ দেওয়া যাবে না। উদাহরণ স্বরূপ প্রোটিন জাতীয় খাবার (মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল, বাদাম ইত্যাদি) শরীরের বৃদ্ধির জন্য জরুরি; অন্যদিকে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি হাড়ের ঘনত্ব বাড়িয়ে উচ্চতা বাড়াতে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করে।
তাই প্রতিদিন খাবারে ক্যালসিয়াম (দুধ বা দুধজাতীয় খাবার, ছোট মাছ, ছোলা ইত্যাদি) ও ভিটামিন D রাখা দরকার। ভিটামিন D পেতে ডিম, মাছ ইত্যাদি খেতে হবে, পাশাপাশি গায়ে রোদ লাগাতে হবে। পাশাপাশি খাবারে জিংক (বাদাম, বীজ–জাতীয় খাবার) রাখলে উচ্চতা বাড়াতে অনেক সাহায্য করবে।
অতিরিক্ত মেদ ঝড়ানো উচিত :
দেহের অতিরিক্ত মেদ কমিয়ে নিলেও উচ্চতার উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কোমর সরু হলে আপনাকে আরও বেশি লম্বা লাগবে।
শারীরিক ব্যায়াম :
উচ্চতা বাড়াতে চাইলে কম বয়স থেকেই প্রতিদিন ব্যায়াম করা জরুরি। বিশেষ করে স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ, যা মেরুদণ্ডকে সোজা থাকতে এবং লম্বা করতে সাহায্য করে। ঝুলে থাকা, সাঁতার কাটা, দড়িলাফ, জগিং, বাস্কেটবল, ভলিবল, কিছু যোগব্যায়ামের চর্চা ইত্যাদিও করতে হবে। এই সব শারীরিক ব্যায়ামের অভ্যাস হাড়ের বৃদ্ধি ঘটানোর পাশাপাশি এইচজিএইচ গ্রোথ হরমোনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা উচ্চতা বাড়াতে কাজ করে।
পর্যাপ্ত ঘুম:
লম্বা হওয়ার কোনো কম বয়স থেকেই প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানো জরুরী। এর কারণ ঘুম আপনার শরীর বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ২০ বছরের কম বয়সের ছেলে মেয়েদের ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা ঘুমানোর প্রয়োজন। পরিমাণমতো ঘুম হলে শরীরে সঠিকভাবে গ্রোথ হরমোন তৈরি হয় এবং লম্বা হওয়ার ক্ষেত্রেও সুবিধা হয়। তাই নিয়মিত একই সময়ে ঘুমানো অভ্যাস করুন।
নেশাজাতীয় দ্রব্য থেকে দূরে থাকুন :
নেশাজাতীয় দ্রব্য শরীরের জন্য ক্ষতিকর হওয়ার পাশাপাশি দেহে হরমোনের পরিমাণও কমিয়ে আনে। এর প্রভাবে শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধা পায়। তাই আজই ধূমপান, মদ ও নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করা বন্ধ করুন এবং কথা সম্ভব এর থেকে বিরত থাকুন।
মানসিক চাপমুক্ত থাকুন :
আমরা সকলেই জানি যে শারীরিক বৃদ্ধিতে হরমোনের গুরুত্ব কত। ছেলে হোক কিংবা মেয়ে সবার ক্ষেত্রে হরমোনের উপরই শরীরের উচ্চতা নির্ভর করে। আপনি যদি মানসিক চাপে থাকেন, তবে আপনার হরমোন তৈরির প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে। তাই যতটা সম্ভব আনন্দে থাকুন, স্ট্রেস ফ্রি থাকার চেষ্টা করুন, মানসিক চাপমুক্ত থাকুন।
বসার ধরন ঠিক রাখুন :
বসার ধরনের ওপরও উচ্চতা নির্ভর করে। অনেকে সারাক্ষণ ঝুঁকে বসে কাজ বা পড়াশুনা করে, যেমন : কম্পিউটারে কাজ করা ইত্যাদি। এতে মেরুদণ্ড বেঁকে গিয়ে শরীরের উচ্চতাকে খাটো করে দেয়। তাই সব সময় সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে পিঠে সাপোর্টার ব্যবহার করে সোজা হয়ে বসার অভ্যাস করতে হবে।
এসব উপায়ে উচ্চতা বৃদ্ধি না হলে প্রয়োজনে একজন পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিতে পারেন। পুষ্টিবিদের মত অনুযায়ী সুষম ডায়েট চার্ট তৈরি করে নিন। তবে একটা কথা মাথায় রাখা জরুরি যে, উচ্চতা হঠাৎ করে বাড়বে না। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকবে। তাই ধৈর্য রাখতে হবে।
উচ্চতা বৃদ্ধিতে ব্যায়াম, Exercise to increase height :
আজকাল অনেকেই নিজের উচ্চতা বাড়ানোর জন্যে শরীরচর্চা করে থাকেন। সাধারণত একজন মানুষ কতটুকু লম্বা হবে সেক্ষেত্রে জেনেটিক ফ্যাক্টর ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে পিটুইটারি গ্ল্যান্ড থেকে নিঃসৃত গ্রোথ হরমোন আসলে আপনার শরীরের বৃদ্ধিকে অব্যাহত রাখে।
সচরাচর নারীরা ১৬ ও পুরুষেরা ১৮ বছর বয়সী হয়ে যাওয়ার পর প্রাকৃতিকভাবে লম্বা হতে পারে না। তবে যাদের বয়স ২০ ও ২৫ এর মাঝামাঝি আছে, তারা নিয়মিত ব্যায়াম ও কিছু অভ্যাসে পরিবর্তনের মাধ্যমে কিছুটা লম্বা হতে পারেন।
একথা অস্বীকার করার নয় যে, ব্যায়াম শরীরের বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু অল্প কয়েক দিন ব্যায়াম করেই বেশি ফল পাওয়ার আশা করা উচিত নয়। দুই থেকে তিন মাস নিয়মিত ব্যায়াম করলে উচ্চতার ক্ষেত্রে ভালো ফল পেতে পারেন। নিচে উচ্চতা বৃদ্ধির কয়েকটি সহজ ব্যায়ামের উপায় দেওয়া হলো।
- প্রথমে সমতল মেঝেতে লম্বা হয়ে শুয়ে পডুন। এরপর দুই হাতের তালুতে ধীরে ধীরে ভর দিয়ে শরীরের ওপরের অংশটি আস্তে করে ওপরে তুলুন। সবশেষ মেরুদণ্ড বাঁকা করে নিয়ে মাথা যতটা পারেন বাঁকা করুন।
- হাঁটু ভাঁজ করে নিতে বাঘের মতো হাতের তালু এবং পায়ের হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে পড়ুন। তারপর আপনার মাথা ওপরের দিকে বাঁকা করে নিয়ে পিঠ নিচের দিকে বাঁকিয়ে নিন। এবার আপনার মাথাটিকে নিচের দিকে করে নিন আর পিঠকে ওপরের দিকে বাঁকিয়ে তুলুন। ১০ সেকেন্ড পরপর এভাবে বেশ কয়েকবার করে নিতে পারেন।
- সমতল মেঝেতে দুই পা দুদিকে ছড়িয়ে বসে পড়ুন। এরপর আপনার হাঁটু দুটো ভাঁজ না করেই ডান হাঁটুতে ঝুঁকে নাক লাগানোর চেষ্টা করুন। তারপর বাঁ হাঁটুতে নাক লাগানোর চেষ্টা করুন। এভাবে ১০ সেকেন্ড পরপর বেশ কয়েকবার করতে থাকুন।
- প্রথমে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ুন। এরপর হাতের তালু ও পায়ের পাতার ওপর ভর দিন, এরপর নিজের শরীর ওপর দিকে বাঁকিয়ে উঁচু করে তুলুন। তবে মনে রাখবেন আপনার মাথা নিচে রাখতে হবে। এভাবে ১০ সেকেন্ড করুন।
- প্রথমে মেঝেতে সোজা হয়ে শুয়ে, তারপর হাঁটু ভাঁজ করে নিয়ে পায়ের গোড়ালি নিতম্বের কাছে নিয়ে আসুন। এরপর পাতের গোড়ালিকে হাত দিয়ে ধরুন। এরপর কোমরসহ নিতম্বকে ওপরের দিকে ওঠানোর চেষ্টা করুন। তবে মাথা নিচের দিকে রাখতে হবে। থাকবে। এভাবে ১০ সেকেন্ড স্থির থাকুন।
শেষ কথা, Conclusion :
আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা লম্বা হওয়ার সহজ কিছু উপায় উল্লেখ করেছি। বয়স অনুযায়ী যাদের বৃদ্ধি আটকে আছে তাদের ক্ষেত্রে এই উপায়গুলো লাভজনক হবে, কিন্তু যারা প্রাপ্ত বয়স্ক তাদের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিগুলো তেমন কার্যকরী নাও হতে পারে। বাড়িতে উপরিউক্ত পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করে দেখতে পারেন, উচ্চতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কিছুটা ফল পেতে পারেন।