বিগত দিনের বাংলার রোজা-রমজান কেমন ছিল?

বিগত দিনের বাংলার রোজা-রমজান

প্রাচীন বাংলার রোজা-রমজান ছিল এক ভিন্ন আঙ্গিকে পরিপূর্ণ, যা বর্তমান সময়ে খুব কমই দেখা যায়। মোগল আমল থেকে বাংলা অঞ্চলের রোজা-রমজানের যে চিত্র পাওয়া যায়, তা ছিল ঐতিহ্য, আচার-অনুষ্ঠান, ও সামাজিক মিলনের এক অপূর্ব সম্মিলন। মোগল সুবাদার ইসলাম খাঁ ১৬১০ সালে ঢাকায় এসে এই অঞ্চলের মুসলমান সমাজের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনে এক নতুন ধারা তৈরি করেছিলেন। আর এই রমজান মাস ছিল মুসলিম সমাজের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ, আনন্দময় এবং সমাজিক জীবনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু।

১. রমজান মাসের আগমন: তোপধ্বনি ও মিছিল

মোগল আমলের রমজান মাসের প্রথম দিন ঢাকায় বিশেষ প্রস্তুতি শুরু হত। রমজানের চাঁদ দেখার জন্য মানুষ অপেক্ষা করত। বাড়ির ছাদ, নদীর মাঝখানে নৌকায়, এমনকি গাছের ডালে উঠে অপেক্ষা করত লোকজন। চাঁদ দেখা যাওয়ার পর বিশেষভাবে তোপধ্বনি এবং বন্দুকের গুলির মাধ্যমে রমজান মাসের আগমন ঘোষণা করা হতো। মোগল আমলের সময় এটি একটি সাধারণ রীতি ছিল, যা উনিশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত চলতে থাকে। সে সময় ঢাকা শহরের নানা জায়গায়, বিশেষত বড়কাটরা, আহসান মঞ্জিল, এবং ছোটকাটরার উঁচু ইমারতের ছাদে লোকজন চাঁদ দেখত।

রমজান মাসের প্রথম দিন

২. তারাবিহ: মিলনমেলা ও ধর্মীয় উচ্ছ্বাস

রমজান মাস শুরু হওয়ার পরপরই তারাবিহ নামাজের আয়োজন শুরু হত। সে সময় ঢাকার মসজিদে, বাড়িতে, বা বিশেষ স্থানগুলোতে মুসল্লিরা একত্র হয়ে নামাজ পড়তেন। নামাজের সময় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতেন সবাই। কবি জসীমউদ্দীনের ‘তারাবি’ কবিতায় সে সময়ের দৃশ্য ফুটে উঠেছে। তারাবিহ নামাজে কোরআন খতমের রেওয়াজ উনিশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কেবল ধর্মীয় আচারই নয়, এটি ছিল সমাজিক মিলনের এক বড় উৎসব।

৩. সাহ্‌রি ও কাসিদা: আধ্যাত্মিক উত্সাহ

সাহ্‌রি সময় রোজাদারদের জাগানোর জন্য পাড়ায় যুবকদের দল গঠন করা হতো। এ সময় গাওয়া হতো বিভিন্ন গজল ও কাসিদা, যা রোজাদারদের ঘুম ভাঙাতে সাহায্য করত। কাসিদাগুলি হতো উর্দু, ফারসি এবং বাংলা ভাষায়। বিশেষ দুটি কাসিদা ছিল—”আল্লাহ্ কা বান্দেকো হাম আয়ে জাগানে কো” এবং “রোজদারও জাগো ওঠো, এ রাত সোহানি হ্যায়”। এসব কাসিদা গাওয়ার মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে এক ধরনের আধ্যাত্মিক উত্তেজনা তৈরি হতো।

৪. ইফতার: রমজানের বিশেষ খাবার ও ঐতিহ্য

 রমজানের বিশেষ খাবার ও ঐতিহ্য

ইফতার বা ‘রোজাখোলাই’ রমজান মাসের এক বিশেষ আয়োজন ছিল। সেকালে ইফতারের জন্য প্রস্তুতি শুরু হতো শবে বরাতের পর থেকেই। ঢাকায় ইফতারের খাবারের তালিকা ছিল অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। খেজুর, শরবত, বিরিয়ানি, কাবাব, শিক কাবাব, টিকা কাবাব, বাখরখানি, ও হালিম ছিল সাধারণত ইফতারের প্রধান খাবার। মোগলদের প্রিয় ইফতার ছিল মুসাল্লাম কাবাব, শামি কাবাব, তাশ কাবাব ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল বিভিন্ন ধরনের শরবত, বিশেষত তোকমার সুগন্ধি শরবত এবং বেলের শরবত।

এছাড়া, রমজানে ইফতারি পাঠানোর একটি বিশেষ রীতি ছিল। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে ইফতারির জন্য ডালা পাঠানো হতো, যা ছিল এক ধরনের সম্মান প্রদর্শন এবং সামাজিক ঐক্য গড়ে তোলার একটি উপায়।

৫. রোজা রাখা: সামাজিক অনুশীলন ও রীতিনীতি

পুরানো ঢাকায় এবং সারা বাংলায় রোজা রাখার প্রবণতা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। যদিও তখনকার সময়ে গ্রামে অনেকেই রোজা রাখতেন না, কিন্তু শহুরে মানুষ, বিশেষত ঢাকার বাসিন্দারা রোজা রাখতে খুবই তৎপর থাকতেন। তবে সাধারণ কৃষক-মজুরেরা রোজা রাখার জন্য সবসময় সক্ষম হতেন না। বিশেষত নারীরা রোজা রাখতেন, যা ছিল তাদের ধর্মীয় নিষ্ঠার পরিচায়ক।

আবুল মনসুর আহমদ তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন, “তখন বয়স্করা তামাক ও পানি খেতো, তবে ভাত খাওয়া থেকে বিরত থাকতেন। তারা বিশ্বাস করতেন যে পানি ও তামাক খাওয়ার ফলে রোজা নষ্ট হয় না।” তবে ঢাকার মুসলমানদের মধ্যে রোজা রাখার প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল এবং ইফতারের আয়োজন ছিল এক ধরনের সামাজিক প্রতিযোগিতা।

৬. স্মৃতির পসরা: রমজানের রোমান্টিকতা

আজকের দিনে রমজান মাস এলে পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে। সেকালের রোজা-রমজানের সেই পরিবেশ, খাবারের বাহার, তারাবিহর আনন্দ, কাসিদার সুর, এবং ইফতারির আয়োজন আমাদের স্মৃতিতে বেঁচে থাকে। ইফতারের উৎসব, রোজার প্রথা, এবং বিশেষ মুহূর্তগুলো ছিল এক সময়ের সৌন্দর্য, যা বর্তমানে হয়তো অনেকটাই পরিবর্তিত। তবে রমজান মাসের সেই ঐতিহ্য এখনও আমাদের মাঝে কিছুটা রয়ে গেছে, যা আমাদের সংস্কৃতির একটি অমূল্য অংশ হিসেবে চিরকাল অমলিন থাকবে।

RIma Sinha

Rima Sinha is a professional journalist and writer with a strong academic background in media and communication. She holds a Bachelor of Arts from Tripura University and a Master’s degree in Journalism and Mass Communication from Chandigarh University. With experience in reporting, feature writing, and digital content creation, Rima focuses on delivering accurate and engaging news stories to Bengali readers. Her commitment to ethical journalism and storytelling makes her a trusted voice in the field.

Recent Posts

link to হাতের চাপ বলবে কতটা সুস্থ তুমি, ঠিক কীভাবে ফিরবে শরীরের জোর?

হাতের চাপ বলবে কতটা সুস্থ তুমি, ঠিক কীভাবে ফিরবে শরীরের জোর?

আপনার হাতের মুষ্টির চাপ (Grip strength) আপনার সামগ্রিক সুস্থতার এক দারুণ সূচক হতে...