ঈদ মুসলমানের প্রধান ধর্মীয় উৎসব, আর এই ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েই বলা হয় ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম’। ঈদের দিন পরস্পর দেখা-সাক্ষাতের সময় এক মুমিন আরেক মুমিনের সঙ্গে তথা একজন মুসলমানের সঙ্গে অন্য আরেক মুসলমান কল্যাণকর ভাব-বিনিময় করে থাকেন। আপনারা এখন হয়তো ভাবছেন যে, এই ভাব-বিনিময়ের ভাষা বা দোয়াটি কীভাবে করা হয়? আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা সেই দোয়া নিয়েই আলোচনা করবো।
তাবাকাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম অর্থ কি? Meaning of Takbabalallah minna wa minkum
উচ্চারণ : তাক্বাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম। অর্থ: `আল্লাহ তাআলা আমাদের ও আপনার নেক আমল তথা ভাল কাজগুলো কবুল করুন’। ঈদের দিনের আগের দিন সন্ধ্যার পর থেকে এই দোয়া দিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। এছাড়া সংক্ষেপে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে ‘ঈদ মোবারক’-ও বলা যায়।
ঈদ মুবারাক তাক্বাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম এর অর্থ কি? Meaning of Eid Mubarak Takbabalallah minna wa minkum ?
আন্তরিক শুভেচ্ছা। ঈদ হোক কল্যাণময় বরকতময়। অযথা তর্ক এড়িয়ে চলুন।
ঈদের দিন জামাআতে দেখা সাক্ষাৎ, Meeting in Jamaat on Eid day
মুমিন মুসলমান শাওয়ালের মাসের প্রথম দিন সকাল বেলা ঈদের জামাআতে হাজির হবে। সবাই পরস্পরের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করবে। হাসি মুখে সালাম ও কুশল বিনিময় করবে। একে অপরের সঙ্গে হাত মেলাবে, আলিঙ্গন করবে। একে অপরের জন্য বেশি বেশি দোয়া করবে। এসব দৃশ্য আমরা সকলেই হয়তো একবার হলেও দেখেছিল। ঈদের দিন এইরূপ ভালোবাসা ও আন্তরিকতার বিনিময় দেখে সকলের মন প্রসন্ন হয়ে যায়।
ঈদের দিন ধনী-গরিবের ভেদাভেদ থাকে না। সবাই কাঁধে কাঁধ মেলানো, উষ্ণ অভ্যর্থনা ও শুভেচ্ছা বিনিময়, পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর নেওয়া, পরস্পর মিলে-মিশে খাবার গ্রহণ— ইত্যাদি মুসলমান সমাজের ঐতিহ্য।
বছরে অন্তত ঈদের দিনে মানুষ সব ক্ষুদ্রতা, সংকীর্ণতা, তুচ্ছতা, হিংসা ও বিদ্বেষ ভুলে পরস্পরকে ভালবাসে। সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সামাজিক ঐক্য, সংহতি ও ভালবাসার নিবিড় বন্ধন সৃষ্টি হয়। আনন্দ উৎসবে প্রবাহিত হয় মানুষ হৃদয়, মন ও দেহে।
ভাব-বিনিময়ের ভাষা বা দোয়া, Language of communication or prayer or Dua
পরস্পরের দেখা-সাক্ষাতে এভাবে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা সুন্নাত। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দোয়াটি শিখিয়েছেন। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবাগণ ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ে একে অপরকে বলতেন-
تَقَبَّلَ اللهُ مِنَّا وَ مِنْكُمْ
এর আরবী উচ্চারণ : ‘তাক্বাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম।
এর বাংলা অর্থ : ‘আল্লাহ তাআলা আমাদের ও আপনার নেকা আমল তথা ভাল কাজগুলো কবুল করুন।’
রমজান মাসব্যাপী রোজা পালন, তারাবিহ, তাহাজ্জুদসহ নফল নামাজ, কুরআন তেলাওয়াত এবং মানুষের ভালো কাজগুলো কবুলে একে অপরের জন্য দোয়া ও কল্যাণ কামনা রয়েছে এ দোয়ায়।
তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম এর উত্তর কি? What is the reply of Takbabalallah minna wa minkum ? i
যে ব্যক্তি আপনাকে “তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম” বলে তার সাধারণ উত্তর হল “তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম” বলে জবাব দেওয়া। আপনি আমীন বা খায়ের মুবারকও বলতে পারেন। আপনি যদি ঈদের দিন এটি পড়ে থাকেন, তাহলে আপনাকে এবং আপনার পরিবারকে ঈদ মোবারক।
তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম কি সহীহ? Is Takbabalallah minna wa minkum sahiha?
ইমাম আহমাদ (রহঃ) বলেছেন: “ঈদের দিনে এক ব্যক্তি অন্যকে বললে দোষ নেই: তাকাব্বাল আল্লাহু মিন্না ওয়া মিনক ( আল্লাহ আমাদের এবং আপনার কাছ থেকে (এই ইবাদত) কবুল করুন)। ” এটি আল-মুগনি গ্রন্থে ইবনে কুদামাহ বর্ণনা করেছেন।
ঈদুল ফিতরের দোয়া কি? Dua of Eid-ul-Fitr
ঈদুল ফিতরের দোয়া
সাহাবীগণ ঈদের দিন একে অপরের সাথে দেখা করার সময় একে অপরকে নিম্নলিখিত দুআ করতেন। ” তাকাব্বাল আল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম “। “আল্লাহ আমাদের এবং আপনার কাছ থেকে (সৎ আমল) কবুল করুন।”
ঈদের দোয়া নিয়ে হাদীস, Hadith about Eid prayers
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহ তাআলা এ দুই দিনের পরিবর্তে এর চেয়েও উত্তম দু’টি দিন তোমাদেরকে দান করেছেন। আর সেই দিন দু’টি হলো- ১. ঈদুল ফিতর ও২. ঈদুল আজহা।’ (আবু দাউদ, নাসাঈ)
ওয়াসিলা (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে ঈদের দিন সাক্ষাৎ করলাম। আমি বললাম, ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা’। মহানবী (সা.) বললেন, ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা।’ (বায়হাকি, হাদিস : ৩/৪৪৬)
হাদিস শরিফে এসেছে- জুবাইর ইবনু নুফাইর (রা.) বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবীজি (সা.)-এর সাহাবোয়ে কেরাম ঈদের দিন পরস্পর সাক্ষাৎ হলে বলতেন ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়ামিন কুম’ আল্লাহ আমার এবং আপনার যাবতীয় ভালো কাজ কবুল করুক। (ফাতহুল কাদির, খণ্ড : ০২, পৃষ্ঠা : ৫১৭)
‘ঈদ মোবারক’ বলে শুভেচ্ছা বিনিময়, Eid Mubarak greetings
‘ঈদ মোবারক’ বলেও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। কিন্তু সালামের আগেই ঈদ মোবারক বলে শুভেচ্ছা বিনিময় করা বৈধ নয়। ঈদের শুভেচ্ছাবিনিময় করার সর্বোত্তম পদ্ধতি হলো, তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা বলা। তবে উপরে উল্লেখিত দোয়া করার সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করা আরো উত্তম। জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সন্ধ্যা থেকেই এক মুসলমান অপর মুসলমানের সঙ্গে দেখা হলেই পরস্পরের নেক আমল ও কোরবানি কবুলের এ দোয়ার মাধ্যমে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। বিশ্বাস করা হয় যে এতে আল্লাহ তাআলা এক মুমিন মুসলমানের জন্য অপর মুমিন মুসলমানের দোয়াকে কবুল করবেন। তাদের কোরবানি কবুল করবেন।
ঈদ মোবারক কখন বলতে হয় ইসলামে? When to greet Eid Mubarak in Islam?
ঈদের জন্য অভিনন্দন জানানো উচিত `ঈদের নামাজের পর । কিন্তু কেউ যদি ঈদ শুরু হওয়ার আগে এই ধরনের অভিনন্দন জানায়, তার বন্ধুকে প্রথম এই শুভেচ্ছা জানানোর জন্য, মনে হয় এতে দোষের কিছু নেই।
ঈদের দিন সালাম ও মুসাফাহা, Salaam and Musafaha on the day of Eid
ঈদের দিন ইসলামি শিষ্টাচারের অনুষঙ্গ হিসেবে সালাম ও মুসাফাহা করা হয়। সালামের মাধ্যমে মহান আল্লাহ পারস্পরিক ভালোবাসা বৃদ্ধি করেন।
হাদিসে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ঈমানদার না হওয়া পর্যন্ত তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর একে অন্যকে ভালো না বাসলে ঈমানদার হতে পারবে না। আমি কি তোমাদের এমন একটি কাজ শিখিয়ে দেব, যা করলে তোমরা পরস্পরে ভালোবাসতে পারবে? (সে কাজটি হলো) তোমরা পরস্পরের মধ্যে সালামের প্রচলন করো।’ (মুসলিম, হাদিস : ১/৪৭)
পারস্পরিক সাক্ষাতে মুসাফাহা বা হাত মেলানোর অনেক ফজিলত রয়েছে। মুসাফাহার সময় এ দোয়া পড়বে— ‘ইয়াগফিরুল্লাহু লানা ওয়া লাকুম।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যদি দুজন মুসলিম সাক্ষাৎ করে পরস্পর মুসাফাহা করে, তাহলে তারা (ওই স্থান থেকে) পৃথক হওয়ার আগেই তাদের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৫/৭৪; ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২/১২২০)
মুসাফাহা কিভাবে করবেন তা জেনে নিন, এর নিয়ম হলো- দুই হাতে মুসাফাহা করা। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, (মুসাফাহার সময়) আমার হাতটি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দুই হাতের মধ্যে ছিল। (বুখারি, হাদিস : ৫/২৩১১) আর মুসাফাহার সময় এ দোয়া পড়বে— ‘ইয়াগফিরুল্লাহু লানা ওয়া লাকুম।’ মুসাফাহার পর হাত বুকে লাগানোর বিধান নেই, জরুরিও নয় বটে। তবে মুআনাকা বা কোলাকুলি করাও মুসলিম সংস্কৃতির অংশ। ঈদের দিন যদি কারো সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয়, তাহলে মুআনাকা করতে কোনো বাধা নেই, বরং এতে সুন্নত আদায় হয়।
ঈদ মোবারক এর অর্থ কি? What is the meaning of Eid Mubarak?
ঈদ মোবারক একটি আরবি শব্দ যার অর্থ “ধন্য উৎসব”। ঈদ শব্দের অর্থ আনন্দ, খুশি বা উদযাপন ও উচ্ছ্বাস। আর মোবারক শব্দের অর্থ কল্যাণময় ও বরকতপূর্ণ। সুতরাং ঈদ মোবারকের অর্থ হলো- ঈদ কল্যাণময় হোক, অথবা আনন্দ উদযাপন কল্যাণজনক হোক। এই শব্দটি আরব মুসলিমরা পাশাপাশি সারা বিশ্বের মুসলমানরা ব্যবহার করে। আন্তর্জাতিকভাবে মুসলমানরা এটি ঈদ-দুল আযহা এবং ঈদ-দুল ফিতরের উৎসবগুলিতে শুভেচ্ছা বার্তা হিসাবে ব্যবহার করে।
ঈদ মোবারক এর আরবি উত্তর? Arabic reply of Eid Mubarak?
একই কথা আবার বলা যেতে পারে, অথবা আপনি ” আল্লাহ আপনাকে [ও] আশীর্বাদ করুন ” বা “ঈদ মুবারক” (عيد مبارك), “ঈদ সাঈদ” (عيد سعيد), বা “আল্লাহ ইবারেক ফিক/ই” (الله) বলতে বেছে নিতে পারেন يبارك فيك)।
মুসলমানের আনন্দের জন্য দুই ঈদের ঘোষণা, Announcement of two Eids for the joy of Muslims
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুমিন মুসলমানের আনন্দের জন্য দুই ঈদের ঘোষণা দেন। ঈদের প্রচলনের সে ঘটনাও উঠে এসেছে হাদিসের বর্ণনায়-
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করলেন, তখন মদিনাবাসীদের মধ্যে (উৎসব উদযাপনে) বিশেষ দুটি দিন (প্রচলিত) ছিল। সেই দুই দিনে তারা খেলাধুলায় মেতে উঠতো।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, (তাদের আনন্দ-উৎসবের) এ দুইটি দিনের তাৎপর্য কী? মদিনাবাসীরা জানালেন, (হে আল্লাহর রাসুল! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমরা জাহেলি (অন্ধকার) যুগ থেকে এ দুই দিন খেলাধুলা (উৎসব) করে আসছি।
শেষ কথা, Conclusion
ঈদের দিনের সুখ, সমৃদ্ধি, শান্তির কামনাই হোক প্রতিটি মুমিন মুসলমানের কামনা। পৃথিবীতে বিরাজ করুক জান্নাতি পরিবেশ। মানবজীবন হয়ে ওঠুক আনন্দময়। মুমিন মুসলমান একে অপরের সঙ্গে সাক্ষাতে ভালোবাসা বিনিময়ে জানানো হোক : ‘তাক্বাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম’। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে এ দোয়ার মাধ্যমে ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যমে পরস্পরের কল্যাণ ও মঙ্গল কামনা করর তাওফিক দান করুন। আমিন।