অজু পবিত্রতার মাধ্যম। নামাজ আদায়েরও প্রধান মাধ্যম, কারণ, অজু ছাড়া নামাজ হয় না। ইসলাম ধর্মে অজুর শুরুতে এবং অজুর সময় প্রতিটা অঙ্গ ধৌত করার সময় কিছু দোয়া প্রচলিত আছে। অনেকে জানতে চান যে এসব দোয়া কি সুন্নাহসম্মত কি না। মূলত অজুর আগে, মাঝে ও পরে দোয়া পড়া আল্লাহর রাসুল (সা.) থেকে প্রমাণিত। তাই এই সময়ে দোয়া পড়া সুন্নত বলে মনে করা হয় আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা অজুর সময় যে দোয়া পড়তে হয় সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
অজুর আগের দোয়া, Prayer before Ajr
অজুর আগে পড়ার দোয়া হলো-
বিসমিল্লাহ বলে অজু শুরু করা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি অজুর শুরুতে বিসমিল্লাহ বলবে না, তার অজু পরিপূর্ণ হবে না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৫)
অজু করার শুরুতে বিসমিল্লাহির রাহমানির রামিম পড়ার কথা হাদিসে এসেছে। (আবু দাউদ, হাদিস : ১/১৪; তিরমিজি, হাদিস : ১/১৩; কিতাবুল আজকার :২/২)
অজুর মাঝে পড়ার দোয়া, Ajur majhe porar doa
অজুর মাঝে যে দোয়া পড়া সুন্নত, সেটি হল :
اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي ذَنْبِي ، وَوَسِّعْ لِي فِي دَارِي ، وَبَارِكْ لِي فِي رِزْقِي
এর বাংলা উচ্চারণ : আল্লাহুম্মাগফিরলি জাম্বি ওয়া ওয়াসসি’লি ফি দারি, ওয়া বারিকলি ফি রিজকি।
এর বাংলা অর্থ : হে আল্লাহ, আমার গুনাগ ক্ষমা করে দিন। আমার ঘর-বাড়িতে প্রশস্ততা দান করুন। আমার রিজিকে বরকত-প্রাচুর্য দিন। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৯৯০৮; কানজুল উম্মাল, হাদিস : ৫০৮০; মুসনাদে আবি ইয়ালা, হাদিস : ৭২৭৩; মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা, হাদিস : ২৯৩৯১)
অজু করার মাঝে এই দোয়া পড়া সুন্নত। মুসলিমদের বিশ্বাস যে এটা পড়লে আল্লাহ তাআলা জীবনে ও আয়-রোজগারে এবং সবকিছু অনেক বরকত দান করেন।
অজু শেষের দোয়া, Prayer at the end of Aju
হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে যে, অজু শেষে কালেমায়ে শাহাদাত পড়তে হবে। এটা যে পড়বে সে জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছে, সেটা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে।
অজু শেষে যে দোয়া পড়বেন, সেটি হল :
أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ
এর বাংলা উচ্চারণ : আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু।
এর বাংলা অর্থ : আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর বান্দা ও রাসুল। হে আল্লাহ! আপনি আমাকে তাওবাকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন এবং পবিত্রতা অর্জনকারীদেরও অন্তর্ভুক্ত করুন। (সুনানে নাসায়ি কুবরা, হাদিস : ৯৯১২; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ১৬৯; সুনানে দারেমি, হাদিস : ৭১৬; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৩৪; কানজুল উম্মাল, হাদিস : ২৬০৭৪)
অজু শেষে আঙ্গুল তুলে দোয়া পড়া, At the end of Oju, raise your fingers and say a prayer
কিবলার দিকে তাকিয়ে বলা বা কিবলার দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে অজুর শেষে কালেমায়ে শাহাদাত পড়ার কথা বলেছেন অনেক ফিকাহবিদ। তবে এটা শুধু আদব বা শিষ্টাচার। একে জরুরি মনে করার প্রয়োজন নেই বা কেউ না করলে, তাকে তিরস্কার করা যাবেনা। (ফাতাওয়ায়ে রহিমিয়্যাহ : ৪/২১)।
এর সারমর্ম হলো- আসমানের দিকে তাকিয়ে এটা বলবে। (ফাতাওয়ায়ে শামি : ১/১১৯)
ফিকহের কিতাব বাদায়িউস সানায়িতে আছে, অজু করার পর কিবলার দিকে হয়ে কালেমায়ে শাহাদাত পড়বে। (বাদায়িউস সানায়ি : ১/২৩)
অজুর শেষে কী দোয়া পড়া হবে; এবিষয়ে বেশ কয়েকটি হাদিস রয়েছে। সকল হাদিসের সমষ্টি করলে দোয়াটি হয়–
: أَشْهَدُ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَحْدَهُ لا شَرِيكَ لَهُ ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ ، اللَّهُمَّ اجْعَلْنِي مِنَ التَوَّابِينَ ، واجْعَلْني مِنَ المُتَطَهِّرِينَ ، سُبْحانَكَ اللَّهُمَّ وبِحَمْدِكَ ، أشْهَدُ أنْ لا إلهَ إِلاَّ أنْتَ ، أسْتَغْفِرُكَ وأتُوبُ إِلَيْكَ
এর বাংলা উচ্চারণ : আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু। আল্লাহুম্মাজ-আলনি মিনাত-তাওয়া-বিনা, ওয়াজ-আলনি মিনাল-মুতা-ত্বাহহিরিন। সুবহানাকাল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা, আশহাদু আন-লা ইলাহা ইল্লা আনতা, আসতাগফিরুকা ওয়াতুবু ইলাইকা।
এর বাংলা অর্থ : আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। তিনি এক, তার কোনো শরিক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মাদ (সা.) তার বান্দা ও রাসুল। হে আল্লাহ! আমাকে তাওবাকারীদের ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন। মহা পবিত্র আপনি হে আল্লাহ্! আপনার প্রশংসার সাথে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। আমি আপনার নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং আপনার দিকেই ফিরে যাচ্ছি (অর্থাৎ তাওবা করছি)।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৩৪; তিরমিজি, হাদিস : ৫৫)
এক বর্ণনায় বলা আছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অজু করার পর নিম্নোক্ত দোয়া বলবে, তাহলে কাগজে এর আমল নামা লিখে এমনভাবে মুদ্রণ করা হবে, যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত নষ্ট হবে না। (নাসায়ি, হাদিস : ৯৯০৯; হাকিম, হাদিস : ১/৫৬৪)
উক্ত দোয়াটি হলো-
سُبْحَانَكَ اللهُمَّ، وَبِحَمْدِكَ أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ، أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْكَ
এর বাংলা উচ্চারণ : সুবহানাকাল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা, আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লা আনতা, আসতাগফিরুকা ওয়াতুবু ইলাইকা।
এর বাংলা অর্থ : মহা পবিত্র আপনি হে আল্লাহ্! আপনার প্রশংসার সাথে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। আমি আপনার নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং আপনার দিকেই ফিরে যাচ্ছি (অর্থাৎ তাওবা করছি)।’
অঙ্গ ধৌত করার সময়ের দোয়া, Dua at the time of washing the body
অজুর মাঝখানে বিভিন্ন অঙ্গ ধৌত করার সময় যে দোয়াগুলো পড়া হয়, সেগুলো অজুর দোয়া হিসেবে হাদিসে উল্লেখ করা হয় নি। তবে অনেকে মনে করেন, এই দোয়াগুলো বিভিন্ন সময়ে রাসুল (সা.) পড়েছেন বলে— প্রমাণিত আছে। এগুলো অনেক নেককার বান্দারাও পড়ে থাকেন, তাই এগুলো পড়া বিদআত হবে না; বরং বরকতের কারণ হবে। (ইসলাহি খুতুবাত : ১৩/১২৬)। তবে কিছু উলামায়ে কেরাম এই অতিরিক্ত দোয়া পড়া বিদআত বলেছেন। তাই এই দোয়া না পড়ারও অবকাশ রয়েছে।
অন্যদিকে ইসলামের কিছু প্রচলিত বইয়ে অজুর শুরুর একটি দোয়া লেখা আছে, সেটি হল : ‘বিসমিল্লাহিল আলিয়্যিল আজিম, ওয়াল আলহামদু লিল্লাহি আলা দ্বীনিআল ইসলাম। আল ইসলামু হাক্কুন, ওয়াল কুফরু বাতিলুন; আল ইসলামু নুরুন, ওয়াল কুফরু জুলমাতুন।’ কিন্তু দোয়াটি সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য-উৎস পাওয়া যায়নি।
অজুর কোনো অঙ্গের কোনো অংশ শুকনো থাকলে কি করতে হবে ? What to do if any part of the body is dry?
অজুর দোয়া পড়া ক্ষেত্রে অজুর অঙ্গগুলোতে পরিপূর্ণভাবে জল পৌঁছানো বা ভেজানো আবশ্যক বলে বর্ণিত। অজুর মূল অঙ্গ ৪টি : চেহারা, হাত, পা, মাথা। মাথা মাসেহ করা ফরজ, আর বাকি তিন অঙ্গ ধোয়া ফরজ। এ তিন অঙ্গের কোনো একটি স্থান শুকনো থাকলে তখন অজু হবে না। অজুর শেষে যদি কোনো ভাবে জানা যায়, এই তিন অঙ্গের কোথাও শুকনো রয়ে গেছে। তাহলে শুধু শুকনো জায়গা পানি দিয়ে ধুয়ে নিলেই হবে; নতুন অজু করতে হবে না। (আহসানুল ফাতাওয়া, খণ্ড : ০২, পৃষ্ঠা : ৩১৬)
আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে তিনি বলেন, এক সফরে রাসুল (সা.) আমাদের পেছনে রয়ে গেলেন। পরে তিনি আমাদের কাছে পৌঁছালেন, এদিকে আমরা (আসরের) নামাজ আদায় করতে দেরি করে ফেলেছিলাম এবং আমরা অজু করছিলাম। আমরা আমাদের পা কোনো মতে পানি দিয়ে ভিজিয়ে নিচ্ছিলাম। তখন তিনি উচ্চস্বরে বললেন– وَيْلٌ لِلأَعْقَابِ مِنَ النَّارِ বা ‘পায়ের গোড়ালিগুলোর (শুষ্কতার) জন্য জাহান্নামের শাস্তি রয়েছে।’ তিনি দুই বার বা তিনবার এ কথা বললেন। (বুখারি, হাদিস : ৬০; মুসলিম, হাদিস : ২৪১)
পরিশেষে, Conclusion
নামাজের জন্য অজু ফরজ। হাদিসে অজুকে নামাজের চাবি বলা হয়েছে। আর নামাজকে বলা হয়েছে জান্নাতের চাবি। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা অযুর দোয়া সম্পর্কে আলোচনা করলাম। আশা করি উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আপনারা এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন।