চাশত নামাজ বা সালাতুত দোহা নামাজের কথা আপনাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো শুনেছেন। এই নামাজ কিভাবে আদায় করতে হয় তা হয়তো অনেকেরই জানা নেই। তবে নামাজের সঠিক নিয়ম না জেনে নামাজ আদায় করা উচিত নয়। তাই আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা চাশতের নামাজের নিয়ম নিয়ে আলোচনা করবো।
চাশতের নামাজের সঠিক সময়, The correct time for Chaster Namaz :
চাশত বা দুহার নামাজ আদায় করার সঠিক সময় হল সূর্য মধ্য আকাশে স্থির হওয়ার আগ মুহূর্ত। চাশতের নামাজ দুহার নামাজ নামেও পরিচিত। ‘দুহা’ শব্দের অর্থ হল ‘প্রভাত সূর্যের ঔজ্জ্বল্য’, আর এই ঔজ্জ্বল্য আসে সূর্য স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হওয়ার পর। দুহা বা চাশতের নামাজ সূর্যের তাপ যখন প্রখর হতে শুরু করে তখন আদায় করা উত্তম।
নবী কারিম (স.) বলেছেন,
صلاة الأوابين حين ترمض الفصال
‘চাশতের নামাজ পড়া হবে যখন সূর্যের তাপ প্রখর হয়।’ (সহিহ মুসলিম: ৭৪৮)
সূর্য এক-চতুর্থাংশ উপরে উঠলে এই নামাজ আদায় করা হয়। সেক্ষেত্রে, গ্রীষ্মকালে ৯টা-১০টার দিকে, আর শীতকালে ১০টা-১১টার সময় চাশতের নামাজ আদায় করা হয়। কোনো সুন্নত নামাজে যেমন দুই রাকাত পড়ে ডানে ও বামে সালাম ফিরিয়ে থাকেন, এই নামাজের ক্ষেত্রেই তেমনই করতে হয়।
চাশতের নামাজ কত রাকাত জেনে নিন, Rakats in the Chashter Namaz :
চাশতের নামাজ দুই বা চার রাকাত পড়তে হয়। তবে চার রাকাত পড়াই উত্তম। কেউ চাইলে আরও বেশিও পড়তে পারে। এর কারণ এটি নফল নামাজ। তাই নফল নামাজ বেশি পড়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা নেই, বরং এক্ষেত্রে সওয়াব রয়েছে।
মক্কা বিজয়ের দিন দুপুরের আগে রাসুল (স.) আলী (রা.) এর বোন উম্মে হানি (রা.)-এর ঘরে ৮ রাকাত পড়েছিলেন বলে হাদিসে বর্ণিত রয়েছে। যদিও তিনি সংক্ষিপ্তভাবে রাকাতগুলো পড়েছিলেন, তবুও রুকু এবং সেজদায় তিনি পূর্ণ ধীরস্থিরতা বজায় রেখেছিলেন। পাশাপাশি তিনি প্রতি দুই রাকাত অন্তর সালাম ফিরিয়েছিলেন। (বুখারি: ২০৭)
ইসলামে কিছু হাদিসে নফল নামাজ দুই রাকাত করে পড়ার কথা রয়েছে। হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন,
صلاة الليل والنهار مثنى مثنى
‘দিন ও রাতের নফল নামাজ দুই দুই রাকাত করে।’ (তিরমিজি: ৫৯৭; আবু দাউদ: ১২৯৫)
চাশতের নামাজের ফজিলত জেনে নিন, Fazilat of Chaster Namaz :
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন,
‘আমার প্রিয়তম (রাসুল স.) আমাকে তিনটি বিষয়ে অসিয়ত করেছেন, যেন আমি তা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ত্যাগ না করি। প্রতি মাসে তিন দিন রোজা রাখা, দুহার নামাজ বা চাশতের নামাজ পড়া ও ঘুমানোর আগে বিতর আদায় করা।’ (সহিহ বুখারি: ১১৭৮)
অন্য এক হাদীসে ইরশাদ করা হয়েছে,
‘মানুষের শরীরে ৩৬০টি জোড়া আছে। অতএব, মানুষের কর্তব্য হলো প্রত্যেক জোড়ার জন্য একটি করে সদকা করা।’
সাহাবায়ে কেরাম বলেন,
‘হে আল্লাহর রাসুল! কার শক্তি আছে এই কাজ করার?’ তিনি বলেন, ‘মসজিদে কোথাও থুতু দেখলে তা ঢেকে দাও অথবা রাস্তায় কোনো ক্ষতিকারক কিছু দেখলে সরিয়ে দাও। তবে এমন কিছু না পেলে, চাশতের দুই রাকাত নামাজ এর জন্য যথেষ্ট।’ (আবু দাউদ: ৫২২২)
উপরোক্ত হাদিস থেকে আপনরা হয়তো বুঝতেই পারছেন যে, চাশতের নামাজ ৩৬০ সদকার সমতুল্য।
চাশতের নামাজের ফজিলত ও গুরুত্ব বর্ণনায় এক হাদিসে এসেছে যে,
হজরত আবু যার রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবি বলেছেন,
‘সকালে তোমাদের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাদকা করা আবশ্যক। প্রতিটি তাসবিহ (সুবহানাল্লাহ) সাদকা; প্রতি তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ) সাদকা। প্রতিটি তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) সাদকা; প্রতিটি তাকবির (আল্লাহু আকবার) সাদকা। সৎ কাজের আদেশ দেয়া সাদকা। অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা সাদকা। আর এগুলোর পরিবর্তে যথেষ্ট হবে চাশতের ২ রাকাআত নামাজ আদায় করা। ‘(মুসলিম)
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয় যে, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“যে ব্যক্তি সূর্যোদয়ের পূর্বে কিছু ভক্ষণ না করে অর্থাৎ খাবার না খেয়ে চার রাকাত নামাজ আদায় করে এবং প্রতি রাকাত নামাযে সূরা ফাতিহা পড়ার পর সূরা ফালাক এবং নাচ পার্ট করে এই নামাজ আদায় করে তার চল্লিশ বছরের পাপ ক্ষমা করে দেয়া হবে।”
চাশতের নামাজের নিয়ত কিভাবে করবেন, Niyat of Chaster Namaz :
চাশতের নামাজ এর নিয়ত নিয়ে বিভ্রান্তি যেন না হয়, তাই নিম্নে চাশতের নামাজের আরবি এবং বাংলা উচ্চারণ উল্লেখ করছি :
نَوَيْتُ أَنْ أَصَلَّى لِلَّهِ تَعَالَى رَكَعَتَى صَلوةِ الضُّحَى سُنَّةُ رَسُولِ : اللهِ تَعَالَى مُتَوَجْهَا إِلَى جِهَةِ الْكَعْبَةِ الشَّرِيفَةِ : اللَّهُ أَكْبَرُ
বাংলা উচ্চারণঃ
নাওআইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তা’আলা আরবা’আ রাকাআতে সালাতি দোহা, সুন্নাতু রাসুলিল্লাহে তাআলা মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ শরীফাতে আল্লাহ আকবর।
বাংলা অর্থ:
কিবলামুখী হয়ে আল্লাহর ওয়াস্তে নবীর সুন্নাত দুই রাকা’আত চাশতের নামাযের নিয়্যাত করছি, আল্লাহু আকবার।
চাশতের নামাজ সুন্নত হিসেবে গণ্য, তাই চাশতের নামাজের নিয়ত করার সময় অবশ্যই আমাদের সুন্নাত হিসেবে নিয়ত করতে হবে।
তবে চাশতের নামাজের ক্ষেত্রে উচ্চারণ করে নিয়ত করতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, বরং আপনারা চাইলে মনের অন্তরে ইচ্ছা পোষণ করেও মহান আল্লাহ তায়ালার নামে চাশতের নামাজের নিয়ত করতে পারেন। তারপর আল্লাহু আকবার বলে নামাজ শুরু করতে পারেন।
চাশতের নামাজের নিয়ম, Rules for Chaster Namaz :
চাশতের নামাজের নিয়ম নফল নামাজের মতো। ইমাম মুজাহিদ হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বলা হয় যে, হযরত মোহাম্মদ সাঃ এর বাণী অনুসারে-
“যে ব্যক্তি চাশতের নামাজের ৪ রাকাত নামাজ পড়বে, তাদের প্রথম রাকাতে সূরা ফাতিহা ১০ বার এবং আয়তুল কুসরী ১০ বার, দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ফাতিহা ১০ বার এবং সূরা কাফিরুন ১০ বার, তৃতীয় রাকাতে সূরা ফাতিহা ১০ বার এবং সূরা নাস এবং সূরা ফালাক ১০ বার, চতুর্থ রাকাতে সূরা ফাতিহা ১০ বার এবং সূরা ইখলাস ১০ বার পাঠ শেষ করে বৈঠকে তাশাহুদ ও সালাম করতে হবে। এরপর ৭০ বার এসতেকফা পড়ার পর ৭০ বার নিম্নের এই দোয়াটি পাঠ করতে হয়।”
سبحان الله والحمد لله ولااله الاالله والله اكبر ولاحول ولاقوة الابالله العلي العظيم
ইসলামে বিশ্বাস করা হয় যে, এই দোয়াটি পড়ার মধ্য দিয়ে আসমান এবং জমিনের সমস্ত মানব দানবের অত্যাচার-অবিচার থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
শায়খ আবদুর রহমান বিস্তামী (রহঃ) গ্রন্থে হতে পাওয়া যায় যে, সালাতুল ইশরাক চার রাকাত নামাজ যেভাবে পড়া হয় ঠিক সেভাবে প্রথম রাকাত ফাতিহা সূরা পড়ার পর সূরা ইখলাস ৩ বার পাঠ করতে হবে। একইভাবে দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ রাকাত নামাজ আদায় করতে হবে।
আবু হুরাইরা (রা.) বলেন,
“ প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) আমাকে তিনটি বিষয়ে আমল করার উপদেশ দিয়েছেন, প্রতি মাসের প্রথম তিনদিন রোজা রাখা; চাশতের নামাজ (সালাতুদ্ দুহা) আদায় করা এবং ঘুমাতে যাওয়ার আগে বিতরের নামাজ আদায় করার।” (বুখারি, হাদিস নং ২৭৪; মুসলিম, হাদিস নং ১৫৬০)
চাশতের নামাজ নিয়ে কুসংস্কার, Superstitions about Chaster Namaz :
চাশতের নামাজ নিয়ে অনেক কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। এই নামাজে সূরা শামস ও যুহা পড়ার হাদীসটি মিথ্যা (সিলসিলাহ যায়ীফাহ, আলবানী ৩৭৭৪নং)।
শেষ কথা, Conclusion :
নফল নামাজগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ নামাজ হল চাশত নামাজ বা সালাতুত দোহা নামাজ। হাদিস থেকে জানা যায় যে, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা) নিয়মিত এই নামাজ আদায় করতেন। সেক্ষেত্রে দেখতে গেলে, আমাদের উচিত মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা) এর দেখানো পথ অনুসরণ করা।