ঈদে মীলাদুন্নবী (সা.) মুসলমানদের জন্য এমন একটি আনন্দোৎসব, যার কোনো তুলনা হয় না। দিনটি সমগ্র বিশ্বে মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। মুসলিম সমাজে ‘ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) নামে সমধিক পরিচিত দিনটির নামকরণ ঈদ, মিলাদ আর নবী এই তিনটি শব্দ যোগে করা হয়েছে। পবিত্র ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম বিশ্বের ঈমানি প্রেরণার জয় ধ্বনি নিয়ে প্রতি বছর আমাদের মাঝে আসে রবিউল আওয়াল মাসে।
ঈদে মিলাদুন্নবী বলতে কি বুঝায়? What is meant by Eid-e-Milad (Mawlid al-Nabi)?
ঈদ অর্থ- আনন্দোৎসব, মিলাদ অর্থ- জন্মদিন আর নবী অর্থ নবী বা ঐশী বার্তাবাহক। তাহলে ঈদে মিলাদুন্নবীর অর্থ দাঁড়ায় নবীর জন্মদিনের আনন্দোৎসব। ঈদে মিলাদুন্নবী হচ্ছে হজরত মুহাম্মদ (সা.)- এর জন্মদিন উপলক্ষে বিশেষ উৎসবমুখর দিন। সারা বিশ্বের বহু মুসলিম অত্যন্ত জাঁকজমক, ভক্তি ও মর্যাদার সাথে আরবী বৎসরের ৩য় মাস রবিউল আউআল মাসের ১২ তারিখে, এই ঈদে মিলাদুন্নবী বা নবীর জন্মের ঈদ পালন করেন। কিন্তু অধিকাংশ মুসলিমই এই ‘ঈদের’ উৎপত্তি ও বিকাশের ইতিহাসের সাথে পরিচিত নন।
ঈদে মিলাদুন্নবি উপলক্ষ্যে মুসলমানদের আচার অনুষ্ঠান, Rituals of the Muslims on account of Eid-e-Milad (Mawlid al-Nabi)
নবীগণের মহাসম্মেলন ডেকে মিলাদুন্নবী মাহফিলের আয়োজক স্বয়ং আল্লাহ। ওই মজলিসে এক লাখ ২৪ হাজার মতান্তরে দুই লাখ ২৪ হাজার পয়গম্বর (আ.) উপস্থিত ছিলেন। ওই মজলিসের উদ্দেশ্য ছিল হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.)-এর জন্ম, শান ও মান অন্যান্য নবীর সামনে তুলে ধরা।
কোরআন মজিদের ৩য় পারা সুরা আলে এমরানে ৮১-৮২ নং আয়াতে মধ্যে আল্লাহতায়ালা মিলাদুন্নবী মাহফিলের কথা উল্লেখ করেছেন। নবীজীর সম্মানে এটাই ছিল প্রথম মিলাদ মাহফিল এবং মিলাদ মাহফিলের উদ্যোক্তা ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। সুতরাং মিলাদে মাহফিল অনুষ্ঠান হচ্ছে আল্লাহর সুন্নত।
সৃষ্টির শুরু থেকেই উভয় জগতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর সব রহমত ও দয়া এ নবীর অসিলায় প্রবাহিত করছেন। মহানবী (সা.)-এর আগমনের দিন পবিত্র ১২ রবিউল আউয়াল বিশ্ব ভুবনের জন্য নিঃসন্দেহে রহমত ও বরকতময়, আর সেই নবী আগমনের দিনে বিশ্বের কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মুসলমান অত্যন্ত আদব ও সম্মানের সঙ্গে প্রিয় নবীর আগমনক্ষণ তথা জন্মসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি স্মরণ করে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আনন্দ ও খুশি উদ্যাপন করে।
১২ রবিউল আউয়ালের রাত। মিলাদুন্নবির উৎসবের রাত। এ রাতে খাওয়া-দাওয়া, আনন্দ-উৎসবে মুখর হয়ে উঠে অনেক মুসলমান বসতিপূর্ণ পাড়া-মহল্লাগুলো। যারা এই উৎসব পালন করে থাকেন তাদের উৎসবমুখরতা দেখলে অনেকেরই হয়তো মনে হবে যে এটা নিশ্চয়ই মুসলিমদের সবচেয়ে বড় উৎসবের দিন। এদিন মুসলমানদের অনেকেই শ্লোগান দেয়, দেয়ালে লিখে, ‘সকল ঈদের সেরা ঈদ, ঈদে মিলাদুন্নবির ঈদ। ’
মিলাদ উল নবীর গুরুত্ব ও ফজিলত, Importance and Fazilat of Eid-e-Milad (Mawlid al-Nabi)
ঈদে মিলাদুন্নবীর তাৎপর্য ও ফজিলত বুঝতে হলে প্রথমে যাঁর জন্য এ ঈদে মিলাদুন্নবী পালিত হয় সেই দয়াল নবীর সঠিক পরিচয় জানতে হবে। তাঁর সব গুণকে নিঃশর্তভাবে বিশ্বাস করে নবীজি সম্পর্কে আল্লাহর হুকুম কী, সেই জ্ঞান অর্জন করে সেইভাবে ইবাদত করতে হবে।
ইসলামে রাসুলের প্রতি ভালোবাসা আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার মাপকাঠি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, তাই বলা যেতে পারে যে রাসুলপ্রেমই আল্লাহপ্রাপ্তির পূর্বশর্ত। যার ভেতর রাসুলের প্রতি ভালোবাসা নেই, সে মুমিন হতে পারে না।
প্রিয় নবীর শুভাগমন জগদ্বাসীর প্রতি আল্লাহর বিশেষ রহমত, তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে বিভ্রান্ত মানবজাতি আলোর পথের সন্ধান পেয়েছে, গোমরাহীর অতলগহ্বরে নিমজ্জিত দিকভ্রম বনি আদম তাঁরই অসিলায় সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে মর্যাদাপ্রাপ্ত। নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, লাঞ্ছিত, মানব গোষ্ঠীকে তিনি চিরকল্যাণকর আদর্শের পথে আহ্বান করেছেন এবং সম্মান ও মর্যাদার সাথে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ দেখিয়েছেন।
তাই তাঁর আবির্ভাব উম্মতের জন্য কত বড় রহমত ও সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী উদ্যাপন করে সেই মহান রবের নিয়ামত প্রিয় নবীকে স্মরণ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার মধ্যেই রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতের মুক্তির পথ ও পাথেয়।
রাসুলুল্লাহ (সা) এর জন্ম দিবস কবে? When is the birthday of Rasulullah?
রাসুলে আকরাম (সা) কোন তারিখে জন্মগ্রহণ করেন তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অনেকে মনে করেন যে তাঁর জন্ম হয় ১২ রবিউল আউয়াল, আবার অনেকের মতে জন্মের তারিখ ৯ রবিউল আউয়াল। কিন্তু বর্তমানে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সহায়তায় গবেষণা করে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে রাসুলুল্লাহ (সা) এর জন্মদিন ছিল ৯ রবিউল আউয়াল।
বর্তমান বিশ্বে সকলের নিকট সমাদৃত, সহিহ হাদিস নির্ভর শুদ্ধতম সিরাতগ্রন্থ হল ‘আর-রাহীক আল-মাখতুম’। উক্ত গ্রন্থে নবি করিম (সা) এর জন্ম দিবস সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ (সা) ৫৭১ খৃস্টাব্দে ২০ এপ্রিল মোতাবেক ৯ রবিউল আউয়াল সোমবার প্রত্যুষে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। এই তথ্যটি গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যুগের প্রখ্যাত আলেম মুহাম্মাদ সুলাইমান আল-মানসূর ও মিশরের প্রখ্যাত জোতির্বিজ্ঞানী মাহমুদ পাশা।
তাদের গবেষণা বিষয়ের একটি দিক হল যে আল্লাহর রাসুল (সা) সহিহ হাদিসে নিজেই বলেছেন তার জন্ম সোমবার দিন হয়েছে। মাহমুদ পাশা গবেষণা ও হিসাব করে দেখিয়েছেন, সে বছর ১২ রবিউল আউয়াল দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। সোমবার ছিল ৯ রবিউল আউয়াল।
১২ রবিউল আউয়াল দিনটি ঈদ হিসেবে পালন করার যুক্তি, Argument to celebrate 12 Rabiul Awal day as Eid
নবি করিম (সা) এর জন্ম দিবস ৯ রবিউল আউয়াল; তবে সর্বসম্মতভাবে তাঁর ইন্তেকাল দিবস হল ১২ রবিউল আউয়াল। যে দিনটিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মোৎসব পালন করা হয় সে দিনটি মূলত তাঁর মৃত্যু দিবস। তাই দিনটি ঈদ হিসেবে পালন করার আদৌ কোন যৌক্তিকতা নেই। মিলাদুন্নবী প্রায় সব ইসলামি দেশেই পালিত হয়। একমাত্র ব্যতিক্রম হল কাতার ও সৌদি আরব যেখানে এটি সরকারি ছুটির দিন নয় এবং নিষিদ্ধ।
রাসুলে করিম (সা) এর জন্মদিন পালন নিয়ে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি, Islamic view on celebrating Rasul Karim’s birthday:
জন্মদিন পালন নিয়ে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলতে গেলে, কোন ব্যক্তির জন্মদিবস পালন করা ইসলামসম্মত নয়। এটা হল খ্রিস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধসহ অমুসলিমদের রীতিতে আসে। ইসলাম ধর্ম কারও জন্মদিবস পালন অনুমোদন করে না।
- ১) বর্তমান অবধি ইসলাম অবিকৃত আছে এবং থাকবে। ইসলামে সকল হুকুম আহকাম, আচার-অনুষ্ঠান সুনির্ধারিত ও কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু নবি করিম (সা) এর জন্ম দিবস বা মিলাদ পালনের কথা কোথাও নেই। তাই ঈদে-মিলাদ পালন করা নিশ্চয়ই একটি বেদআতি কর্ম, আর বেদআত জঘন্য গুনাহের কাজ।
- ২) ইসলামে আনুমানিক একলাখ চব্বিশ হাজার নবি, তারপরে খুলাফায়ে রাশেদিন ও অসংখ্য সাহাবা, মনীষী, আওলিয়ায়ে কেরাম জন্ম গ্রহণ করেছেন ও ইন্তেকাল করেছেন। তাদের জন্ম বা মৃত্যু দিবস পালন ইসলাম-সমর্থিত বা সওয়াবের কাজ হত তবে বছরব্যাপী জন্ম-মৃত্যু দিবস পালনের ঘূর্ণাবর্তে মুলমানদের আবদ্ধ হয়ে যেতে হত।
- ৩) নবি করিম (সা) এর জন্মদিন পালনের প্রস্তাব সাহাবায়ে কেরাম রাজিয়াল্লাহু আনহুম কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। হিজরি ক্যালেন্ডার প্রবর্তিত হলে হযরত উমর রাজিয়াল্লাহু আনহু সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে বৈঠকে বসলেন। কোন এক স্মরণীয় ঘটনার দিন থেকে নতুন বর্ষগণনা পদ্ধতি প্রবর্তন করার সিদ্ধান্তে কেউ কেউ প্রস্তাব করলেন রাসুলুল্লাহ (সা) এর জন্ম তারিখ থেকে সন গণনা শুরু করা যেতে পারে। কিন্তু তখন উমর (রা) এ প্রস্তাব বাতিল করে বললেন, এ পদ্ধতি খৃস্টানদের।
- ৪) রাসুলুল্লাহ (সা) এর সাহাবাগণ ছিলেন নবিপ্রেমিক ও সর্বোত্তম অনুসারী। তারা কখনো নবি করিম (সা) এর জন্মদিনে ঈদ পালন করেননি। তাই তাদের সত্যিকারের অর্থে নবীপ্রেমিক বলা হয়।
- ৫) জন্ম দিবস কেন্দ্রিক উৎসব-অনুষ্ঠান মুসলিমদের জন্য পরিত্যাজ্য। বিধর্মীদের ধর্মীয় রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান যতই ভাল দেখা যাক না কখনো তা মুসলিমদের দ্বারা গ্রহণ করা জায়েজ নয়।
এ কথার সমর্থনে কয়েকটি দৃষ্টান্ত হল :
রাসুলে করিম (সা) বলেছেন –‘যে ব্যক্তি কোন জাতির সাদৃশ্যতা গ্রহণ করবে সে তাদের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে। ’
আজানের প্রচলনের সময় কেউ কেউ রাসুলুল্লাহ (সা) এর কাছে সালাতের সময় হলে আগুন জ্বালানোর প্রস্তাব করলেন, কেউ ঘণ্টাধ্বনি করার প্রস্তাব করলেন। কেউ প্রস্তাব করেন বাঁশী বাজানোর জন্য। কিন্তু রাসুলে করিম (সা) সকল প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দেন।
হিজরি সনের প্রবর্তনের সময় অনেকে রাসুলে করিম (সা) এর জন্মদিন থেকে সন গণনার প্রস্তাব করেন। কিন্তু, খ্রিস্টানদের অনুকরণ হওয়ার কারণে তা প্রত্যাখ্যাত হয়।
বাংলাদেশে ঈদে মিলাদুন্নবী সা রাষ্ট্রীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয় কত তারিখে? On which date was Eid Miladunnabi Sa declared as the national day in Bangladesh?
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১২ রবিউল আউয়ালকে সরকারিভাবে ছুটি ঘোষণা করেন। তারই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১২ রবিউল আউয়ালকে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করার ঘোষণা দেন।
শেষ কথা, Conclusion
বর্তমান মুসলিম উম্মাহর এই সংকটময় অবস্থা থেকে উত্তরণ ও ইসলামের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের প্রধান উপায় হচ্ছে প্রিয় নবীকে ভালোবাসা ও তাঁর সুন্নাহর অনুসরণ করা। বাংলাদেশি মুসলমানরা এই দিনকে ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী বলে অভিহিত করেন। অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের কাছে এই দিন নবী দিবস নামে পরিচিত।