ঈদের নামাজ হচ্ছে একটি বিশেষ নামাজ, যা সালাতুল ঈদ এবং সালাতুল ঈদাইন নামেও পরিচিত। মুসলমানরা মূলত তাদের বিশেষ দুটি ধর্মীয় উৎসব ঈদের দিন এই নামাজ আদায় করে। এটি সাধারণত কোন খোলা জায়গা (মুসল্লা বা ঈদগাহ) অথবা মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। ঈদের নামাজ শুরু হয় সকাল থেকে এবং এই নামাজের সমাপ্তি হয় দুপুর বেলা।
ঈদের নামাজ কবে আদায় করা হয়, When is Eid prayer performed?
মুসলমানদের দুটি উৎসবে বৃহৎ আকারে একত্রিত হয়ে এই ঈদের নামাজ আদায় করা হয়, সেই দুটি উৎসব হলো:
- ঈদুল ফিতর (আরবি: عيد الفطر), হিজরী সনের দশম মাস, শাওয়াল মাসের প্রথম দিনে উদ্যাপন করা হয়।
- ঈদুল আযহা (আরবি: عيد الأضحى), হজ্জ তীর্থযাত্রার প্রধান দিন আরাফাতের দিনের পরবর্তী দিন হিজরী সনের দ্বাদশ মাস, জ্বিলহজ্জ মাসের দশম দিনে উদ্যাপন করা হয়।
ঈদের নামাজের গুরুত্ব, Importance of Eid Namaz
ঈদের নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে ইসলামী চিন্তাবিদগণ বিভিন্ন মতামত প্রকাশ করেছেন।
- হানাফী মাযহাব অনুসারে ঈদের নামাজ ওয়াজিব, মালিকি ও শাফেয়ী মাযহাব অনুসারে সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ এবং হাম্ববলী মাযহাব অনুসারে ঈদের নামাজ ফরজ।
- কোনো কোনো ইসলামী পণ্ডিতের মতে ঈদের নামাজ ফরজে আইন এবং কোনো কোনো ইসলামী পণ্ডিতের মতে ঈদের নামাজ ফরজে কেফায়া।
- কারো কারো মতে ঈদের দুই রাকায়াত নামাজ নফল।
তবে বলাই বাহুল্য যে প্রায় সকল দেশে মুসলিম সমাজে ঈদের নামাজ ধর্মীয় উৎসব হিসেবে প্রতি বৎসর উদযাপিত হয়।
ঈদের নামাজ কোথায় পড়া হয় ? Kothay Eid er Namaz pora hoy?
ঈদের নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করতে হয় এবং এই নামাজ সাধারণত খোলা মাঠে তথা ঈদগাহে পড়া হয়। তবে এরূপ স্থানের অভাবে বা আপৎকালে মাসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করা যায়। ঈদের নামাজের জন্য কোনো আজান ও ইকামত নেই। তবে জুমআর নামাজের মতোই উচ্চ আওয়াজে কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে ঈদের নামাজ আদায় করতে হয়।
ঈদের নামাজ পড়ার সময়, Eid prayer time
ঈদের নামাজ পড়ার সময় সম্পর্কে উল্লেখ করতে গিয়ে প্রথমেই বলতে হয় যে, চোখের দেখায় সূর্য দিগন্ত থেকে আনুমানিক দুই মিটার উচ্চতায় পৌঁছালে ঈদের নামাজ পড়া হয়। যোহর নামাজ পড়ার আগেই ঈদের নামাজ আদায় করতে হয়। ঈদুল ফিতরের নামাজ সুন্নাত হিসেবে কিছুটা দেরি করে এবং ঈদুল আজহার নামাজ দ্রুত আদায় করা হয়। ইসলাম ধর্মের পবিত্র উৎসব ঈদুল ফিতরে ফিতরা প্রদান করতে হয়; অন্যদিকে ঈদুল আজহায় ঈদের নামাজ সম্পন্ন করার পর আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু কুরবানী করা হয়।
ঈদের নামাজের নিয়ম, Eid prayer rules
ঈদের নামাজের পদ্ধতি প্রতিদিনের নামাজ থেকে একটু ব্যতিক্রম। এই নামাজে আজান ইকামত নেই। এক্ষেত্রে রয়েছে অতিরিক্ত ছয়টি তাকবির। ঈদের নামাজের নিয়ম জেনে নিন :
নামাজের নিয়ত করা
ঈদের নামাজের সালাতের জন্যও নিয়ত করা ফরজ। “ঈদুল ফিতরের ২ রাকাত ওয়াজিব সালাত আদায় করার জন্য নিয়ত করছি” – মনে মনে এই সংকল্প থাকাই যথেষ্ট। আরবি বা বাংলায় নির্দিষ্ট শব্দ ও বাক্যে মুখে উচ্চারণ করে “নিয়ত পড়া” জরুরি নয়। তবুও আরবী ভাষায় নিয়তের শব্দবাক্য জেনে রাখুন :
ঈদুল ফিতরের নামাজের নিয়ত (আরবি): নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তায়ালা রাকয়াতা সালাতি ঈদিল ফিতর, মায়া ছিত্তাতি তাকবীরাতি ওয়াজিবুল্লাহি তায়ালা ইকতাদাইতু বিহাযাল ইমাম, মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারীফাতি আল্লাহু আকবার।
ঈদুল ফিতরের নামাজের নিয়ত (বাংলা), Eid-ul-Fitr prayer Niyat (Bangla):
ইমামের পেছনে কেবলামুখী হয়ে ঈদুল ফিতরের দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ ছয় তাকবিরের সঙ্গে আদায় করছি।
ঈদুল আযহার নামাযের আরবি নিয়তের বাংলা উচ্চারণ: ‘নাওয়াইতু আন উছাল্লিয়া লিল্লাহি তা আলা রাকয়াতাই ছালাতি ঈদিল আযহা মাআ ছিত্তাতি তাকবীরাতি ওয়াজিবুল্লাহি তা আলা ইক্বতাদাইতু বিহাজাল ইমামি মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারীফাতি আল্লাহু আকবার।’
বাংলা অর্থ : ইমামের পেছনে কেবলামুখি হয়ে ঈদুল আযহার দু’রাকাত ওয়াজিব নামাজ ছয় তাকবিরের সঙ্গে আদায় করছি।
তাকবীরে তাহরিমা বলে সালাত শুরু করা তাকবীরে তাহরিমা “আল্লাহু আকবার” বলে সালাত শুরু করতে হবে। এরপর অন্যান্য সালাতের ন্যায় মনে মনে “সানা” পড়তে হবে।
১ম রাকাত:
অতিরিক্ত ৩টি তাকবীর
“সানা” পড়া শেষ হলে ইমাম সাহেব ৩ বার “আল্লাহু আকবার” বলে তাকবীর দেন, প্রথম তাকবীরের সময় কান পর্যন্ত হাত উঠিয়ে হাত ছেড়ে দিতে হবে; দ্বিতীয় তাকবীরের সময় কান পর্যন্ত হাত উঠিয়ে হাত ছেড়ে দিতে হবে; তৃতীয় তাকবীরের সময় কান পর্যন্ত হাত উঠিয়ে হাত নাভির নিচে বাঁধতে হবে।
এরপর ইমাম সাহেব সূরা ফাতিহা পড়েন, এর সাথে অন্য কোনো সূরা মিলাবেন। এরপর অন্যান্য সালাতের ন্যায় রুকু সিজদা আদায় করে ইমাম সাহেব ১ম রাকাত শেষ করে ২য় রাকাতের জন্য দাঁড়াবেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে যথারীতি ইমামকে অনুসরণ করতে হবে।
২য় রাকাত:
অতিরিক্ত ৩টি তাকবীর
ইমাম সাহেব ২য় রাকাতের শুরুতে সূরা ফাতিহা পড়বেন। এরপর এর সাথে অন্য কোনো সূরা বা সূরার অংশ তিলাওয়াত করবেন। রুকুতে যাওয়ার আগে ইমাম সাহেব ৩টি অতিরিক্ত তাকবীর দেবেন। প্রথম তাকবীর দেওয়ার সময় কান পর্যন্ত হাত উঠিয়ে হাত ছেড়ে দিতে হবে। দ্বিতীয় তাকবীর দেওয়ার সময় কান পর্যন্ত হাত উঠিয়ে হাত ছেড়ে দিতে হবে। তৃতীয় তাকবীর দেওয়ার সময়েও কান পর্যন্ত হাত উঠিয়ে হাত ছেড়ে দিতে হবে।
এরপর ইমাম সাহেব চতুর্থ তাকবীর বলবেন। উক্ত তাকবীর রুকুতে যাওয়ার জন্য। চতুর্থ তাকবীর শুনে রুকুতে যেতে হবে। এরপর বাকি সকল নিয়মকানুন অন্যান্য সালাতের অনুরূপ হবে। প্রসঙ্গত, ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য ইমাম ছাড়া ন্যূনতম তিনজন মুসল্লি হতে হবে।
ঈদের নামাজে অতিরিক্ত তাকবির, Extra takbeer in Eid prayer
ঈদের নামাজে অতিরিক্ত ছয় কিংবা বারো তাক্ববির রয়েছে।
ছয় তাকবির দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম এবং দ্বিতীয় রাক্বাতে শুরুতে অতিরিক্ত তিন তাক্ববির দিতে হয়।
বারো তাকবিরের ক্ষেত্রে প্রথম রাক্বাতের শুরুতে অতিরিক্ত সাত তাকবির এবং দ্বিতীয় রাক্বাতের শুরুতে অতিরিক্ত পাঁচ তাক্ববির দিতে হয়। প্রথম রাকাতে সানা পাঠ করার পর কানের লতি পর্যন্ত হাত তুলে সাতবার তাক্ববির দিতে হয়। দ্বিতীয় রাকাতে সুরা পাঠ শুরুর পূর্বে অতিরিক্ত পাঁচ তাকবির দিতে হয়।
খুতবা, Khutba
ঈদের নামাজ অন্যান্য নামাজের মত সালাম ফিরানোর মাধ্যমে নামাজ সম্পন্ন করা হয়। তারপর খুতবাঈদের নামাজ পড়া হয়, এর পর ইমাম খুতবা দেন আর মুসল্লিরা খুতবা মনোযোগের সঙ্গে শুনে। তবে অনেকের মতে খুতবা না দিলেও ঈদের নামাজ আদায় হয়ে যাবে। তবে ঈদের নামাজে ইমাম কর্তৃক খুতবা পড়া সুন্নত এবং মুসুল্লিদের খুতবা শোনাও ওয়াজিব। জুমার নামাজের ন্যায় প্রথমে বিষয় ভিত্তিক খুতবা এবং পরে সানি খুৎবা পাঠ করতে হয়। খুৎবার মাধ্যমেই ঈদের নামাজের সমাপ্তি হয়। খুতবার পরে দোয়া করা হয়।
জুমার খুতবার মতো এই খুতবা শোনা মুসল্লিদের জন্য ওয়াজিব। খুতবার সময় কথাবার্তা বলা, চলাফেলা করা, নামাজ পড়া সম্পূর্ণরূপে হারাম। (রদ্দুল মুহতার ১/৫৫৯)
ঈদের নামাজের কিছু বিশেষ দিক, Some special aspects of Eid prayers
- কেউ যদি ঈদের নামাজে প্রথম রাকাতের কেরাত অবস্থায় শরিক হয় তাহলে তাকবিরে তাহরিমার পর নিজে নিজে হাত তুলে অতিরিক্ত তিন তাকবির বলবে। অতঃপর বাকি নামাজ যথানিয়মে ইমামের সঙ্গে আদায় করবে। (তাতারখানিয়া ২/৬১৯)
- কারো যদি প্রথম রাকাত ছুটে যায় তাহলে ইমামের সালাম ফিরানোর পর দাঁড়িয়ে প্রথমে সুরা-কেরাত পড়বে। অতঃপর রুকুর পূর্বে তিন বার হাত তুলে তিন তাকবির দেবে। তারপর রুকুর তাকবির বলে রুকু সিজদা করে যথানিয়মে নামাজ শেষ করবে। (রদ্দুল মুহতার: ২/১৭৪)
- আর যদি কেউ প্রথম রাকাতে রুকুর পূর্বে জামাতে শরিক হয় এবং তাকবিরে তাহরিমার পর দাঁড়ানো অবস্থায় হাত তুলে অতিরিক্ত তিন তাকবির বলার সুযোগ না পায় তাহলে রুকুতে গিয় অতিরিক্ত তিন তাকবির বলবে। তবে সেক্ষেত্রে কান পর্যন্ত হাত উঠাবে না। (দুররুল মুখতার ১/২৭৪)
- কেউ যদি তাশাহহুদ (বৈঠক) অবস্থায় জামাতে শরিক হয় তাহলে তার নামাজও সহিহ হবে। এক্ষেত্রে ইমামের সালামের পর দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক নিয়মেই দুই রাকাত নামাজ পড়বে। অর্থাৎ প্রথম রাকাতের শুরুতেই অতিরিক্ত তাকবিরগুলো বলে নিবে। অতঃপর সুরা-কেরাত পড়বে। আর দ্বিতীয় রাকাতে কেরাতের পর রুকুর আগে অতিরিক্ত তাকবিরগুলো বলবে। (খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/২১৫)
শেষ কথা, Conclusion
ঈদের নামাজ আদায় করা ওয়াজিব। বছরে দুই বার ঈদের নামাজ পড়ার কারণে অনেকেই নামাজ পড়ার নিয়ম ভুলে যান। তাই ঈদের নামাজ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য উপরিউক্ত আলোচনায় তুলে ধরা হলো। আশা করি উল্লেখিত বিষয়গুলোর মধ্যে দিয়ে আপনারা ঈদের নামাজের নিয়মগুলো সহজে মনে রাখতে পারবেন।