ঈদুল আযহা সম্পর্কে বিস্তারিত, Details about Eid-ul-Azha in Bengali

ঈদুল আযহা সম্পর্কে বিস্তারিত

ঈদ উল আযহা অর্থাৎ কোরবানির ঈদ, বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ এই বিশেষ উৎসব পালনের মাধ্যমে আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও নবী হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও হজরত ইসমাইল (আ.)এর অতুলনীয় আনুগত্য এবং মহান ত্যাগের পুণ্যময় স্মৃতি বহন করে। বিশ্বাস করা হয় যে পশু কোরবানি করে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা যায়। এজন্যই মুসলিম উম্মাহ প্রতি বছর পশু কোরবানি করে থাকে।

ঈদ উল আজহা মানে কি? What does Eid ul Azha mean?

ঈদুল আযহা

ঈদুল আযহা মূলত একটি আরবি বাক্যাংশ; যার অর্থ হলো ‘ত্যাগের উৎসব’। এই উৎসবের মূল বিষয় হল ত্যাগ করা।

এই বিশেষ দিনটিতে মুসলমানেরা ফযরের নামাযের পর ঈদগাহে গিয়ে দুই রাক্বাত ঈদুল আযহার নামাজ আদায় করে। তারপর স্ব-স্ব আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ ও উট আল্লাহর নামে কোরবানি করে। বছর বছর ধরে ইসলাম ধর্মে এভাবে ঈদ উল আজহা পালিত হয়ে আসছে।

ঈদুল আযহা ২০২৪ কত তারিখে? What is the date of Eid-ul-Azha 2024?

প্রতিটা ঈদ সাধারণ আরবি মাসের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী হয়ে থাকে সেই ক্যালেন্ডার থেকে আমরা ইংরেজি মাসের একটি তারিখ নির্ধারণ করে থাকি। সেই তারিখ অনুযায়ী ২০২৪ সালে কোরবানির ঈদ হবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ১৬ জুন এবং ভারত-বাংলাদেশে হবে ১৭ জুন।

২০২৫ সালে ঈদুল আযহা কবে? What is the date of Eid-ul-Azha 2025?

২০২৫ সালে ঈদুল আযহা বা কুরবানী ঈদ মুনসাইড বা নপেইজের হিসেব অনুযায়ী হিজরী সন ১৪৪৬ এর ঈদুল আযহা বা কুরবানী ঈদ ৬ ই জুন রোজ শুক্রবার হবে।

ঈদুল আজহা আমাদের যে শিক্ষা দেয়, The lesson that Eid-ul-Azha gives us :

 জিলহজ্জ মাসে হজের সময় উৎযাপন হয় এই ঈদ-উল-আজহা, যাকে ‘কুরবানি’-ও বলা হয়। আরবি ‘কুরবান’ শব্দটি ফারসি বা উর্দুতে ‘কুরবানি’ রূপে পরিচিত হয়েছে, যার অর্থ ‘নৈকট্য’। ইসলাম অনুসারে, মানুষ আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য কুরবানি দেয়।

মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে নির্দেশ দিয়েছেন, ‘আপনি আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন’ (সুরা কাউসার, আয়াত ২)।

বলাই বাহুল্য পশু কোরবানি মূলত একটি প্রতীকি ব্যাপার। পশু কোরবানির মাধ্যমে মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সবকিছুই কোরবানি করতে প্রস্তুত।

ইসলাম ধর্মে হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তার পুরো পরিবারের নজিরবিহীন কোরবানির ইতিহাস মুসলমানদেরকে ত্যাগের শিক্ষা দেয়। এই শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একজন মুমিন তার সবকিছুই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করতে সদা প্রস্তুত থাকে।

হজরত ইব্রাহিম (আ.) এবং তাঁর পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) এবং মা হাজেরার আল্লাহর প্রতি গভীর ভালোবাসার বহি:প্রকাশগুলোকে আল্লাহতায়ালা হজের অংশ হিসেবে গণ্য করেন। ইসলামের বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী, মহান আল্লাহ তা’আলা ইসলামের রাসুল হযরত ইব্রাহীম কে স্বপ্নযোগে তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি কুরবানি করার নির্দেশ দেন:

“তুমি তোমার প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে কোরবানি কর।”

স্বপ্ন অনুযায়ী পিতা ইব্রাহিম তা বাস্তবায়ন করলেন। তিনি ১০টি উট কোরবানি করলেন। আবারো একই স্বপ্ন দেখলেন। অতঃপর ইব্রাহীম এবার ১০০টি উট কোরবানি করেন।

কোরবানি

এরপর আবার একই স্বপ্ন দেখে তিনি ভাবলেন, তার কাছে তো এ মুহূর্তে প্রিয় পুত্র ইসমাইল ছাড়া আর কোনো প্রিয় বস্তু নেই। তখন তিনি পুত্রকে কোরবানির উদ্দেশ্যে প্রস্তুত করলেন। কোরআনে ইব্রাহিম (আঃ) এর পুত্রের কুরবানীর ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে,

  • ১০০| হে আমার পরওয়ারদেগার! আমাকে এক সৎপুত্র দান কর।
  • ১০১| সুতরাং আমি তাকে এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দান করলাম।
  • ১০২| অতঃপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইব্রাহীম তাকে বললঃ বৎস! আমি স্বপ্নে দেখিযে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি দেখ। সে বললঃ পিতাঃ! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে সবরকারী পাবেন।
  • ১০৩| যখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইব্রাহীম তাকে যবেহ করার জন্যে শায়িত করল।
  • ১০৪| তখন আমি তাকে ডেকে বললামঃ হে ইব্রাহীম,
  • ১০৫| তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে! আমি এভাবেই সৎকর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।
  • ১০৬| নিশ্চয় এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা।
  • ১০৭| আমি তার পরিবর্তে দিলাম যবেহ করার জন্যে এক মহান জন্তু।
  • ১০৮| আমি তার জন্যে এ বিষয়টি পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিয়েছি যে,
  • ১০৯| ইব্রাহীমের প্রতি সালাম বর্ষিত হোক।
  • ১১০| এমনিভাবে আমি সৎকর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।
  • ১১১| সে ছিল আমার বিশ্বাসী বান্দাদের একজন।

—সূরা সাফফাত ৩৭:১০০-১১১

আল্লাহ মানবজাতিকে এর শিক্ষা দিলেন, মানুষ জবাহ করার জিনিস নয়, জবাহ যদি করতে হয় তাহলে পশু জবাহ করো।

ঈদুল আজহার নামাজ, Namaz of Eid-ul-Azha :

 ঈদুল আযহার নামাজ

মুসলিমগণ ঈদুল আযহার নামাজ মসজিদে বা খোলা মাঠে আদায় করেন। জ্বিলহজ্জের ১০ তারিখে, সূর্য উদয়ের পর থেকে যোহর নামাজের সময় হবার আগ পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ে ঈদের নামাজ আদায় করা হয়।

তবে কোনো কারণবশত (যেমন: প্রাকৃতিক দুর্যোগ) নামাজ আদায় করা না গেলে নামাজ ১২ই যিলহজ্ব পর্যন্ত ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করা যাবে। ঈদের নামাজের আগে মুসল্লিরা উচ্চস্বরে “তাকবীর” উচ্চারণ করে।

“আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার,
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু,
আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার,
ওয়ালিল্লাহিল হামদ।”

ঈদুল আজহার নামাজ দুই রাক্বাত। এটি ওয়াজিব নামাজ। জামায়াতের সঙ্গে ছয় অতিরিক্ত তাক্ববিরের সঙ্গে এটি পড়তে হয়। নামাজ শেষে ইমামের জন্য খুৎবা পড়া সুন্নত ও খুৎবা শোনা ওয়াজিব।

পশু জবাই করার প্রচলন, Practice of slaughtering animals :

ইতিহাস থেকে জানা যায়, হজরত রসুলে পাক (সা.) এর শ্রদ্ধেয় পিতা একবার অসুস্থ হলে তার দাদা একশত উট জবাহ করেছিলেন (সিরাতে নববী)। এ থেকে বুঝা যায় যে, পশু জবাই করা রসূল (সা.) প্রচলন করেননি।

পশু জবাই করার মূল উদ্দেশ্য হলো, হৃদয়ে যদি কোন পশু সূলভ মনোভাব থাকে তবে সেই পশুত্বকে হত্যা করতে কোনো পশু জবাই করতে হবে।

হাদিসে আছে, ‘পশু জবাই খোদা তা’লার নৈকট্য লাভের একটি মাধ্যম তবে তা ঐ ব্যক্তির জন্য যে নিষ্ঠার সাথে কেবল আল্লাহতায়ালার ভালোবাসায়, তার ইবাদাতের উদ্দেশ্যে ঈমান সহকারে পশু জবাই করে এমন কোরবানিকে আরবিতে ‘নুসক’ বলা হয়। এর আরেকটি অর্থ অনুগত।’

হিজরি বর্ষপঞ্জি হিসাবে জিলহজ্জ্ব মাসের ১০ তারিখ থেকে শুরু করে ১২ তারিখ পর্যন্ত ৩ দিন ধরে ঈদুল আজহার কুরবানি চলে। হিজরি চান্দ্র বছরের গণনা অনুযায়ী ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহার মাঝে ২ মাস ১০ দিন ব্যবধান থাকে।

পশু জবাই

কোরবানির গুরুত্ব, Importance of Qurbani :

মহানবী (সা.) বিভিন্ন সময় কোরবানির বিষয়ে তার উম্মতকে নসিহত করেছেন, কেননা কোরবানি শুধু একবারের জন্য নয় বরং তা সারা জীবনের জন্য।

হজরত ইবনে উমর (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) মদীনায় ১০ বছর অবস্থান করেছেন এবং বরাবর কোরবানি করেছেন (তিরমিজি)।

হাদিস থেকে জানা যায়, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘হে লোক সকল! জেনে রাখ, প্রত্যেক পরিবারের পক্ষে প্রত্যেক বছরই কোরবানি করা আবশ্যক’ (আবু দাউদ ও নাসাঈ)।

মহানবী (সা.) বলেছেন, “কোরবানির দিনে কোরবানি করাই সবচেয়ে বড় ইবাদত। কোরবানির জন্তুর শরীরের প্রতিটি পশমের বিনিময়ে কোরবানিদাতাকে একটি করে সওয়াব দান করা হবে। কোরবানির পশুর রক্ত জবাই করার সময় মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায় (মেশকাত)।”

ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, কোরবানির বিনিময়ে যদি সওয়াব পেতে হয়, তবে অবশ্যই কোরবানিটা একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে হতে হবে।

ঈদুল আযহার দিন থেকে শুরু করে পরবর্তী দুইদিন পশু কুরবানির জন্য নির্ধারিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, কুরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করে ১ ভাগ গরিব-দুঃস্থদের মধ্যে ১ ভাগ আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে এবং ১ ভাগ নিজেদের খাওয়ার জন্য রাখা হয়।

কোরবানির বর্তমান প্রেক্ষাপট, Present Context of Qurbani :

 বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোরবানী করার বিষয় যেন এক লোক দেখানো অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ঈদ উল আযহার কোরবানীর মূল শিক্ষা হচ্ছে ত্যাগ। এই বিশেষ দিন থেকে ত্যাগের শিক্ষা নিয়ে মানুষ ব্যক্তি জীবন ও সামাজিক জীবনে প্রয়োগ করবে।

কিন্তু বর্তমান সময়ে বেশিরভাগ মানুষই সঠিক নিয়মে যাকাত আদায় করে না, বরং লোক দেখানোর জন্য মোটা অঙ্ক দিয়ে বড় গরু জবাই করে লোকের কাছে বাহাবা পেতে চায়।

তাছাড়া আজকাল কোরবানী অবৈধ টাকা (সুদ, ঘুষ, চাঁদাবাজী, চুরি, ডাকাতি, বাটপারি) দিয়েও করেন অনেকে। বলতে গেলে, কোরবানীর আসল শিক্ষা কেউ গ্রহণ করতে চায় না।

কিন্তু এটা বুঝার বিষয় যে, আমরা যদি ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে কুরবানী করি তবে আল্লাহ যেমন খুশি হবেন তেমনি ত্যাগের মানসিকতা সমাজে সংসারে সকলকে সুখী হতে সহায়তা করবে।

শেষ কথা, Conclusion :

আত্মত্যাগের মহিমায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা আল্লাহর নামে কোরবানি করে তাদের জন্য সীমাহীন সওয়াবের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। ঈদ উল আযহার ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হোক সবার জীবন।

RIma Sinha

Rima Sinha is working as a writer and also as a journalist. she got her bachelor of arts degree from Tripura University. She has also completed Master of Arts in Journalism and mass communication from Chandigarh University.

Recent Posts