সারা বিশ্বে যে সব উৎসব মুসলমানদের অস্তিত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হল ‘ঈদ’। ‘ঈদ’ শব্দটি আরবি, যার অর্থ প্রত্যাবর্তন করা। বলাই বাহুল্য মুসলমানদের জাতীয় সাংস্কৃতিক চেতনার প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে ঈদ। ঈদ- উল -ফিতর বছরে একবার পালিত হয়, যা মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান উৎসব।
2024 সালের ঈদুল ফিতর কবে হবে? When is Eid ul Fitr 2024?
২০২৪ সালের মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হবে রমজান মাস। সেক্ষেত্রে ৯ বা ১০ এপ্রিল, মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলিতে পালিত হবে ইদ-উল-ফিতর। প্রসঙ্গত, চাঁদ দেখার উপর ইদের দিনক্ষণ নির্ভর করে।
ঈদের সূচনা কিভাবে হয় ? How does Eid Celebration begin ?
ইসলামের ইতিহাস অনুসারে জাহেলী যুগ থেকে মদীনাবাসী শরতের পূর্ণিমায় ‘নওরোজ’ এবং বসন্তের পূর্ণিমায় ‘ মেহেরজান’ নামে দুই উৎসব পালন করতো।
এ ব্যাপারে খাদিমুল রাসূল হযরত আনাস (রাদ্বি.) থেকে বর্ণিত,
‘‘ বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন (৬২২ খৃষ্টাব্দে) পবিত্র মক্কা নগরী থেকে হিজরত করে মদীনা মুনাওয়ারায় তাশরীফ আনলেন, তখন তাদেরকে (বৎসরে) দু’দিন খেলাধূলা করতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, এ দু’দিন কিসের? সাহাবাগণ জবাবে বললেন, জাহেলী যুগে আমরা এই দুই দিবসে খেলাধূলা বা আনন্দ প্রকাশ করতাম। অতপর রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ ফরমালেন, আল্লাহ তায়ালা উপরি-উক্ত দিন দু’টির পরিবর্তে তা অপেক্ষা উত্তম দু’টি দিন তোমাদের খুশি প্রকাশ করার জন্য দান করেছেন- এর একটি হচ্ছে- ‘ঈদুল আদ্বহা’ এবং অপরটি হচ্ছে- ‘ঈদুল ফিতর’। “
তখন থেকেই ইসলামী শরীয়তে ঈদ আনুষ্ঠান হিসেবে বছরের দুটি দিন পালিত হয়ে আসছে।
ঈদ- উল -ফিতর উদযাপন, Eid-ul-Fitr Celebration :
কবি নজরুলের ভাষায় বলা যায়-
‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ।’’
সর্বাধিক মহিমান্বিত ও সাওয়াবে ভর্তি মাস পবিত্র রামাজানের পরেই চন্দ্র বর্ষের দশম মাসের সূচনা দিনের মধ্য দিয়েই মাহে সাওয়ালের আগমন। সাওয়ালের বাঁকা চাঁদ বয়ে আনে মুমিন মুসলমানের আনন্দ উৎসবের স্লোগান মোবারক ঈদ! দীর্ঘ একমাস পবিত্র সিয়াম সাধনার পর সাওয়ালের প্রথম দিনে ইসলামী শরীয়তের প্রণেতা মুসলমানদের জন্য যে উৎসব নির্ধারণ করেছেন তা-ই হচ্ছে ‘ঈদুল ফিতর’।
ঈদ-উল-ফিতর উদযাপন হল আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার একটি বিশেষ দিন। মুসলমানদের পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং বৃহত্তর সম্প্রদায়ের সাথে ভালো সময় কাটানো এবং অভাবীদের প্রতি দয়া ও দাতব্য কাজ প্রসারিত করারও এটি গুরুত্বপূর্ণ সময়।
ঈদুল ফিতর উদযাপন ইসলামী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। রমজানের সমাপ্তি উদযাপন করার জন্য এটি মুসলমানদের পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে একত্রিত হওয়ার সময়।
ইতিহাস জুড়ে, ঈদ উল ফিতর উদযাপন বিভিন্ন অঞ্চল এবং সংস্কৃতির উপর নির্ভর করে বিভিন্ন রূপ এবং ঐতিহ্য ধারণ করেছে। কিছু জায়গায়, এটি বিস্তৃত উৎসব এবং উপহার বিনিময় দ্বারা চিহ্নিত করা হয়, অন্যদের মধ্যে এটি প্রার্থনা এবং প্রতিফলন দ্বারা চিহ্নিত একটি গৌরবময় উপলক্ষ স্বরূপ।
ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য জেনে নিন, Significance of Eid-ul-Fitr :
মুসলমানদের মধ্যে ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য অপরিসীম।
এ ব্যাপারে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
“হে আমার ফিরিশতাগণ, তোমরা বলতো! যে শ্রমিক তার কাজ পুরোপুরি সম্পাদন করে তার প্রাপ্য কি হওয়া উচিত? উত্তরে ফিরিশতাগণ বললেন, হে মাবুদ! পুরোপুরি পারিশ্রমিকই তার প্রাপ্য। ফিরিশতাগণ, আমার বান্দা-বান্দীগণ তাদের প্রতি নির্দেশিত ফরজ আদায় করেছে, এমনকি দোয়া করতে করতে ঈদের (ওয়াজিব) নামাজের জন্য বের হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় আমার মহিমা, গরিমা, উচ্চ মর্যাদা ও উচ্চাসনের শপথ, আমি অবশ্যই তাদের প্রার্থনায় সাড়া দেব। এরপর নিজ বান্দাগণকে লক্ষ্য করে আল্লাহ পাক ঘোষণা দেন; তোমরা ফিরে যাও, আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম এবং তোমাদের সাধারণ পাপরাশিকে পুণ্যে পরিণত করে দিলাম।”
ঈদুল ফিতর-এর ফযীলত ও তাৎপর্য সম্পর্কে হযরত সাঈদ আনসারী (রা.) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
‘ঈদুল ফিতরের দিনে আল্লাহর ফিরিশতাগণ রাস্তায় নেমে আসেন এবং গলিতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে থাকেন- মুসলমানগণ! তোমরা আল্লাহর দিকে দ্রুত ধাবিত হও। তিনি তোমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইবাদত কবুল করে অসংখ্য পুণ্য দান করে থাকেন। রোজা রাখার আদেশ করা হয়েছিল তোমাদেরকে, তা তোমরা পালন করেছো যথাযথভাবে। রাতেও জাগ্রত থেকে আল্লাহর ইবাদত করেছো। অতএব যাও, তাঁর নিকট থেকে গ্রহণ কর তোমাদের ইবাদতের প্রতিদান।’
হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ পাকের বাণী-
‘‘ রোজা আমার জন্য এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব।’’ ঈদের দিনে আল্লাহ তায়ালার এ ঘোষণা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। ঈদ শুধু আনন্দই নয়, ইবাদতও বটে। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু উমামা (রা.) বলেন, ‘‘ যে ব্যক্তি ঈদের রাতে ঈমানের সাথে এবং সওয়াবের নিয়তে জাগ্রত থেকে ইবাদত করে, তার অন্তর কিয়ামতের বিভীষিকা হতে মুক্ত থাকবে।’’
মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) হতে বর্ণিত আছে,
‘‘ যে ব্যক্তি পাঁচটি রজনী জাগ্রত থেকে ইবাদত করে তার জন্য বেহেশত্ ওয়াজিব হয়ে যায়। রজনীগুলো এই- জিলহজ্ব মাসের অষ্টম, নবম ও দশম তারিখের রাত, ঈদুল ফিতরের রাত এবং শাবান মাসের পনের তারিখের রাত অর্থাৎ শবে বারাআত।’’
উপরে উল্লেখিত বর্ণনাগুলো থেকেই অনুধাবন করা যায় যে ঈদুল ফিতরের মাহাত্ম্য, গুরুত্ব ও তাৎপর্য কতটুকু।
ঈদুল ফিতরের কি শিক্ষা পাওয়া যায় ? What is the lesson we learn from Eid-ul-Fitr?
ইসলামে পালনীয় অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে নিহিত আছে সুদূরপ্রসারী শিক্ষা। ঈদুল ফিতরে আছে আনন্দ ও ইবাদত, সাথে আছে সুসংঘবদ্ধতার মহান শিক্ষা।
বিশিষ্ট লেখক মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান এর মতে,
‘‘ঈদ রুচিশীল ও মননশীল সংস্কৃতির শিক্ষা দেয়। ঈদ উৎসব সময়ানুবর্তিতা ও নিয়মানুবর্তিতা শেখায়। চাঁদ দেখে রোজা শুরু করা ও শেষ করার মধ্য দিয়ে যেমন সময়ানুবির্ততা শেখায় তেমনি ইফতার, সেহরি ঈদগাহের নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়েও সময়ানুবর্তিতার শিক্ষা পাওয়া যায়। এভাবে মুসলমানদের জীবনে ঈদুল ফিতর এক উজ্জ্বল ও সুন্দর শৃঙ্খলাবোধের সম্মিলন ঘটায়।
মূলত রামাদ্বান এক মাসের একটি প্রশিক্ষণ কোর্স। এ কোর্সের প্রশিক্ষক স্বয়ং আল্লাহ এবং শিক্ষার্থী হল মুসলিম উম্মাহ। এর সিলেবাস রামাদ্বানের নিয়ম-কানুন এবং নম্বরপত্র হচ্ছে তাকওয়া অর্জন, আর এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল হচ্ছে বাস্তব জীবনের প্রত্যেক ধাপে ধাপে প্রতিটি পদে পদে তাকওয়ার সুচিন্তিত শিক্ষা।”
ঈদুল ফিতরে সকল মানুষের সমান অধিকার এ স্লোগানের উপাদান বিদ্যমান।
অন্যদিকে বিদ্রোহী কবি নজরুলের কথায় বলতে গেলে-
ইসলাম বলে, সকলের তরে মোরা সবাই, / সুখ-দুখ সমভাগ করে নেব সকলে ভাই,/ নাই অধিকার সঞ্চয়ের।/ ঈদ্-অল্-ফিতর আনিয়াছে তাই নববিধান,/ ওগো সঞ্চয়ী উদ্বৃত্ত যা করিবে দান, / ক্ষুধার অন্ন হোক তোমার।
প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনান্য দিনের তুলনায় ঈদের দিন তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠার জন্য উৎসাহিত করেছেন৷ ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ঈদের দিন ভোরে উঠে পড়ে এবং এই বিশেষ উৎসবের জন্য বিভিন্নভাবে প্রস্তুতি নেয়৷
ঈদ-উল-ফিতরের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে জামাতে ঈদের নামাজ আদায়, গরিব-দুঃখীদের মধ্যে ফিতরা বিতরণ এবং ভালো খাওয়া–দাওয়ার আয়োজন। প্রতিফলন এবং আনন্দের মধ্যে, ঈদুল ফিতর হল দাতব্য করার একটি সময়, তাই এই অনুষ্ঠান জাকাত আল-ফিতর নামেও পরিচিত।
ঈদের দিনে স্নান করে, নতুন পোশাক পরিধান করা, সুগন্ধি ব্যবহার করা ইত্যাদি কাজ করা বাঞ্ছনীয়, যার মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও উন্নত মন-মানসিকতার শিক্ষা অর্জিত হয়।
এছাড়াও এদিন পরিবার এবং বন্ধুদের নিয়ে ভ্রমণ, চিরাচরিত মিষ্টি খাবার, উপহার দেওয়া- নেওয়া, মেলার আয়োজন, আনন্দ মিছিল, শোভাযাত্রা, খেলাধুলা, ইত্যাদি বিভিন্ন কার্যকলাপে নিয়োজিত থাকেন মুসলমানরা।
ঈদে নামাজ আদায়, Namaz on Eid :
ঈদুল ফিতরের নামাজে অতিরিক্ত ছয় তকবিরসহ দু’রাকাত ওয়াজিব নামাজ পড়তে হয়। নামাজের শেষে ইমাম সাহেব পর পর দুটি খুতবা পড়েন।
নামাজ শেষে মুসলমানরা উচ্চ–নিচ, ধনী–গরিব ও বয়সনির্বিশেষে পরস্পরের সঙ্গে কোলাকুলি, সালাম ও কুশল বিনিময় করে। এ ছাড়া অনেকে এ দিন আত্মীয়স্বজন ও পুণ্যবানদের কবরও জিয়ারত করে।
শেষ কথা, Conclusion :
ঈদ-উল-ফিতরের মত পবিত্র অনুষ্ঠানের দিন ধনী ব্যক্তিগণ ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বেই গরীবদেরকে যাকাত প্রদান করে থাকে। মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য, শক্তি, শান্তি ও প্রগতি তথা ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হওয়ার বৈষয়িকতা ও আধ্যাত্মিকতার শিক্ষা পাওয়া যায় ঈদুল ফিতর থেকে।
বৃহৎ মুসলিম জনসংখ্যা সহ অন্য বেশকিছু দেশে, ঈদ-উল-ফিতর একটি জাতীয় ছুটির দিন। স্কুল, অফিস ইত্যাদি বন্ধ রয়েছে বলে, সকলেই পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীদের একসাথে উদযাপন উপভোগ করতে পারে।