আজান একটি আরবি শব্দ। অনেকেই হয়তো জানেন যে, ইসলামের ফরজ বিধান নামাজ আদায়ের জন্য বিশেষ আহ্বানকে বলা হয় আজান। মুসলমানদের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী, দিনে পাঁচবার পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য মুয়াজ্জিন আজান দিয়ে থাকেন।
আযানের জবাব দেওয়ার পদ্ধতি, Method of answering the Azan:
মুয়াজ্জিন আজান দিলে এর জবাব দেওয়া সুন্নাত। ইসলামে আজানের জবাব দেওয়ার পদ্ধতি হলো, যখন মুয়াজ্জিন আযানের প্রত্যেকটি বাক্য বলে থেমে যাবেন, এরপর শ্রোতা ওই বাক্যটি নিজেও আবার অনুরূপভাবে বলবে। তবে একটি অংশে আযান ও জবাবের মধ্যে তফাৎ রয়েছে। সেটি হল, মুয়াজ্জিন যখন ‘হাইয়্যা আলাস সালাহ’ ও ‘হাইয়্যা আলাল ফালাহ’ বলার পর শ্রোতা ‘লা হাওলা ওয়া লা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ বলবে। এটাই ইসলামের বিশুদ্ধ অভিমত। (মুসলিম ৩৮৫) তবে আজানের কিছু বর্ণনায় ‘হাইয়্যা আলাস সালাহ’ ও ‘হাইয়্যা আলাল ফালাহ’ বলার সময়ও মুয়াজ্জিনের অনুরূপ বলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। (কিতাবুদ দোয়া, তাবারানি, হাদিস : ৪৫৮)
যারা আজানের জবাব দেয়ার পর আল্লাহর কাছে কোনো কোনো কিছু প্রার্থনা করেন; আল্লাহ তাআলা বান্দার সে চাওয়া পূর্ণ করেন।
আজানের জবাব দেওয়া ওয়াজিব, It is obligatory to respond to the Azan :
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে আজানের উত্তর দেয়া সুন্নত। আজান শ্রবণকারী এর জবাব মৌখিকভাবে দিয়ে থাকেন।
এ নিয়ে রসুলুল্লাহ সা. বলেন,
‘যখন তোমরা আজান শুনবে, এর জবাবে মুয়াজ্জিনের অনুরূপ তোমরাও বলবে। আজানের জবাব দেওয়ার পদ্ধতি হলো, মুয়াজ্জিন প্রত্যেকটি বাক্য বলে থামার পর শ্রোতা ওই বাক্যটি নিজেও অনুরূপভাবে বলবে। ‘
যেমন মুয়াজ্জিন যখন ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার’ বলবে, শ্রোতাও এটাই বলবে, ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার’।
আজানের জবাব দেওয়ার ফজিলত, Fazilat of answering the Azan :
আজানের জবাব দেওয়াকে অত্যন্ত ফজিলত পূর্ণ আমল বলে মনে করা হয়, যা আলেমদের সর্বসম্মতি মতে মুস্তাহাব।
ইবনে কুদামা বলেন,
ইবনে কুদামা বলেন, “এটি মুস্তাহাব হওয়ার ব্যাপারে আহলুল ইলমদের মধ্যে কোনও দ্বিমত আছে বলে জানি না।” (আল মুগনি ১/৫৯১)
হযরত আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত এক হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, মহনবী সা. বলেছেন,
“যে ব্যক্তি দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে মুয়াজ্জিন যা বলে তাই বলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (সুনানে আন-নাসাঈ)। এছাড়া, মহানবী সা. আরও বলেছেন, যখন তোমরা আযান শুনবে, এর জবাবে তোমরাও মুয়াজ্জিনের অনুরূপ বলবে।” (বুখারি)।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ইউসুফ রহ. আবদুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান আনসারী রহ. এক হাদীসে বর্ণনা করেছেন, আবু সায়িদ খুদরি রা. তাকে বলেন,
“আমি দেখেছি তুমি বকরি চরানো, বন জঙ্গলকে ভালোবাসো, নামাজের জন্য আজান দাও। তখন উচ্চকণ্ঠে আজান দাও। কেননা জিন, ইনসান বা যেকোনো বস্তু যতদূর পর্যন্ত মুয়াজ্জিনের আজান শুনবে, সে কিয়ামতের দিন তার পক্ষে সাক্ষ্য দেবে। তখন আবু সায়িদ রা. বলেন, এ কথা আমি মহানবী সা. এর কাছে শুনেছি।” (বুখারি)।
আজানের জবাব না দিলে কি গুনাহ হয়? Is it a sin if you don’t respond to the Azan?
আজানের জবাব দেওয়ার বিষয়ে বেশকিছু হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে। হাদীস অনুসারে, যথাযথভাবে আজানের জবাব দেওয়ায় রয়েছে চিরস্থায়ী শান্তির স্থান জান্নাতের ঘোষণা।
আবু সাঈদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
‘যখন তোমরা আজান শুনতে পাও তখন মুয়াজ্জিন যা বলে তোমরাও তার অনুরূপ বলবে।’ (বুখারি ৩৯৯)
হজরত আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
‘আজান ও ইক্বামতের মাঝে যে দোয়া করা হয়, তা ফেরত দেয়া হয় না।’ (মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ)
অন্য হাদিসে এসেছে,
‘মুয়াজ্জিনের সঙ্গে সঙ্গে যে ব্যক্তি আজানের শব্দগুলো বলবে, সে জান্নাতে যাবে।’ (আবু দাউদ, মেশকাত)
বিভিন্ন হাদীসের বর্ণনার মাধ্যমে জানা যায় যে, মুমিনগণ যে যত ব্যস্ততা নিতেই থাকুক না কেনো, আজান শুনলে সুন্নত পালনার্থে আজানের জবাব দেয়ার চেষ্টা করা তাদের কর্তব্য। এ ক্ষেত্রে কখনো অলসতা করা উচিত নয়। আজানের জবাব দিলে সে ব্যক্তি সুন্নতের উপর আমল করার কারণে সওয়াব পাবে।
কিন্তু যদি কেউ জবাব না দেয়, তবে এতে কোনও গুনাহ নেই। পাশাপাশি আযানের জবাব দেওয়ার সাথে সালাত শুদ্ধ হওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। এর কারণ হল, আজানের জবাব দেওয়া এবং সালাত উভয়ই স্বতন্ত্র আমল। কোনোভাবেই একটি অপরটির উপর নির্ভরশীল নয়। তাই কোনো ব্যক্তি যদি আজানের জবাব না দিয়ে থাকে, তাতে সালাতের কোনও ক্ষতি হবে না।
আজানের জবাব ও দোয়া জেনে নিন, Know about the response of Azan and Dua :
আজানের পর দোয়া ও মুনাজাত মুলত নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দরুদ ও প্রশংসা। নবিজির দরুদ পাঠ ও প্রশংসায় মিলবে পরকালের সুপারিশ। এর চেয়ে বড় পুরস্কার মুমিনের জন্য আর কী হতে পারে! হাদিসের বর্ণনায় এসব ফজিলত, দরুদ ও দোয়া ওঠে এসেছে।
আজান শুনার পর রাসুল সা. একটি দোয়া পড়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। ইসলামে এই দোয়া পাঠ করার অনেক ফজিলতও তিনি বর্ণনা করেছেন। সেই দোয়াটি হল :
اللَّهُمَّ رَبَّ هَذِهِ الدَّعْوَةِ التَّامَّةِ، وَالصَّلاَةِ الْقَائِمَةِ، آتِ مُحَمَّداً الْوَسِيلَةَ وَالْفَضِيلَةَ، وَابْعَثْهُ مَقَامَاً مَحمُوداً الَّذِي وَعَدْتَهُ
উচ্চারণ:
আল্লাহুম্মা রববা হাজিহিদ দাওয়াতিত তাম্মাহ, ওয়াস সালাতিল কাইমাহ, আতি মুহাম্মাদানিল ওয়াসিলাতা ওয়াল ফাদিলাহ, ওয়াবআছহু মাকামাম মাহমুদানিল্লাজি ওয়াআদতাহ।
অর্থ: হে আল্লাহ, আপনি এই পরিপূর্ণ আহ্বান এবং প্রতিষ্ঠিত সালাতের রব। মুহাম্মদ সা.-কে (জান্নাতে প্রবেশের) মাধ্যম (সবার মধ্যে বিশেষ) সম্মান দান করুন। তাকে প্রশংসিত স্থানে পৌঁছে দিন, যার প্রতিশ্রুতি আপনি তাকে দিয়েছেন।
হজরত জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু এক হাদীসে বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
‘যে ব্যক্তি আজান শুনে এ দোয়া পড়বে কেয়ামতের দিন সে আমার সুপারিশ পাওয়ার অধিকারী হবে।’ (বুখারি, মিশকাত)
অন্য এক দোয়ার আরবী উচ্চারণ হল :
‘আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহ, ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু। রাদিতু বিল্লাহি রাব্বাও ওয়া বিমুহাম্মাদির রাসুলাও ওয়া বিল ইসলামি দ্বীনা।’
অর্থ : আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতিত কোনো মাবুদ নেই। তিনি একক, তাঁর কোন শরিক নেই। আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসুল। আমি আল্লাহকে প্রভু হিসাবে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রাসুল হিসেবে এবং ইসলামকে দ্বীন হিসেবে পেয়ে খুশী হয়েছি।’
হজরত সাদ ইবনু আবি ওয়াক্কাছ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
‘যে ব্যক্তি মুয়াজ্জিনের আজান শুনে এ দোয়া পড়বে তার গুনাহসমূহ মাফ করা হবে।’ (মুসলিম ও মিশকাত)
একাধিক আযানের জবাব, Response to multiple Azan:
সাধারণত শহরাঞ্চলে একাধিক মসজিদ থাকে এবং একটি মসজিদ থেকে অন্য মসজিদের দূরত্ব কম হয়। মাইক ব্যবহার করে আযান দেওয়া হয় বলে একই স্থানে থেকে একাধিক মসজিদের আজান শোনা যায়। সেক্ষেত্রে অনেকেরই মনে প্রশ্ন আসে যে, কোনো ব্যক্তি একাধিক মসজিদের আজান শুনলে, তিনি কিভাবে আজানের উত্তর দেবেন? সেই ব্যক্তির কি যেকোনো একটি মসজিদের আজানের উত্তর দেওয়া উচিত, নাকি সবগুলো মসজিদের আজানের উত্তর দিতে হবে? সেক্ষেত্রে রসাসুল্লাহের নির্দেশনা অনুযায়ী, যদি কেউ একাধিক মসজিদের আজান শোনে তবে সে নিকটবর্তী মসজিদ বা নিজ মহল্লার মসজিদের আজানের উত্তর দিলে দায়মুক্ত হয়ে যাবে।
অন্যদিকে আল্লামা মাওয়ার্দি (রহ.) বলেন, দ্বিতীয় ও তৃতীয় মুয়াজ্জিনের আজানের উত্তর দেওয়া বৈধ; বরং এটা মুস্তাহাব।
শেষ কথা, Conclusion :
আজান মুসলিমদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন ফরজ বিধান নামাজ আদায়ের জন্য আজান দেয়া হয়। নামাজের গুরুত্বের পাশাপাশি আজানেরও যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে আজানের জবাব দেয়ার এবং আজানের পর নিজেদের জন্য দোয়া করার তাওফিক দান করুন।