ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন একটি আরবি বাক্যাংশ, কুরআনের একটি আয়াত (বাক্য) বা দোয়া, যার বাংলা অর্থ হল “আমরা তো আল্লাহরই এবং আর নিশ্চয়ই আমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী”। এই দোয়াটি মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা আবৃত্তি করা হয়। এই দোয়ার মাধ্যমে ইসলামী মুমিনরা বিশ্বাস করেন যে, জীবনের দ্বারা পরীক্ষিত হওয়ার মাঝখানে, উভয় ধৈর্যের চিহ্ন এবং একটি স্বীকৃতি হিসাবে যে ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, তিনি তাঁর উপাসকদের তাদের সহ্য ক্ষমতার চেয়ে বেশি পরীক্ষা করবেন না। এছাড়াও কেউ মারা গেছে শুনে মুসলমানরা এই দোয়াটি ব্যবহার করে থাকেন।
শোক প্রকাশের দোয়া, Prayer of condolence
ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন
ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন(কুরআন ২:১৫৬); আরবিতে إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّ إِلَيْهِ رَاجِعُونَ; এটি একটি দোয়া যা প্রায়ই শোক প্রকাশের জন্য বা বিপর্যয় এলে বলা হয়।
ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন কখন পড়তে হয়, When to read Innalillahi Wa Inna Ilahi Raziun
অনেকেই মনে করেন যে ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন শুধু মৃত্যুর সংবাদ শুনলেই পড়তে হয়। কিন্তু এই দোয়া শুধু এই সময় পড়তে হয় না বরং ‘ইন্না লিল্লাহ’ পড়ার অনেক কারণ ও গুরুত্বপূর্ণ ফজিলত রয়েছে। এই পবিত্র বাক্য আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ রাখার বড় উপায়। তার প্রিয় বান্দা হওয়ার ও তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের অন্যতম একটি পরিভাষা।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন, অবশ্যই আমি তোমাদের পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ ও জীবনের ক্ষতি এবং ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তারা (মুমিনরা) কোন মুসিবতে আক্রান্ত হলে বলে ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন (আমরা আল্লাহর এবং নিশ্চয় আল্লাহর কাছেই ফিরে যাব)।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৫৬)
এর থেকে যায় যে, বিপদের মুহূর্তে মুমিন বান্দা যদি আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে- ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন বলেন, এর ফলে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনকারী সকল বান্দার প্রতি আল্লাহ অফুরন্ত রহমত ও অনুগ্রহ পাঠাবেন।
ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনের মর্মার্থ, Meaning of Innalillahi Wa Inna Ilahi Raziun
ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনের আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, একজন মুমিন যে কোনো ধরনের বিপদ-আপদের সামনে এলেই ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ বলতে পারেন। মুমিন ব্যক্তির এ কথা বলার অর্থ কেবল মুখে বলা নয়; বরং মনে মনে একথা স্বীকার করে নেওয়া যে, ‘আমরা আল্লাহর কর্তৃত্বাধীন’। তাই যখন কোনো জিনিস আল্লাহর পথে কোরবানি করা হয়, তা ঠিক তার সঠিক ক্ষেত্রেই খরচ, ব্যবহৃত ও গৃহীত হয়। আর ‘আল্লাহর দিকে আমাদের ফিরে যেতে হবে’— এর অর্থ হচ্ছে, চিরকাল আমাদের এ দুনিয়ায় থাকতে হবে না। একদিন আল্লাহরই কাছে যেতে হবেই।
ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনের দোয়া, Innalillahi Wa Inna Ilahi Raziun Dua
দোয়াটির আরবি :
إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ، اللَّهُمَّ أْجُرْنِي فِي مُصِيبَتِي وَأَخْلِفْ لِي خَيْرًا مِنْهَا
- এর আরবি উচ্চারণ হল : ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন, আল্লাহুম্মা আজিরনি ফি মুসিবাতি; ওয়া আখলিফ-লি খাইরাম মিনহা।
- এর বাংলা অর্থ হল : আমরা আল্লাহর এবং নিশ্চয় আল্লাহর কাছেই ফিরে যাব। হে আল্লাহ! আমাকে আমার এই বিপদে বিনিময় দান করুন এবং আমার জন্য এরচেয়ে উত্তম ব্যবস্থা করে দিন।
ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনের দোয়া পড়ার ফজিলত, Innalillahi Wa Inna Ilahi Raziun Fazilat
বিপদে পড়লে মুমিনের উত্তম বৈশিষ্ট্য ও কর্তব্য হলো ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পড়া। কোরআনে ও হাদিসে বিপদে পড়লে ‘ইন্নালিল্লাহ’ পড়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং এর বিশেষ ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করা হাদীস অনুযায়ী বিচার করলে দেখা যায় যে, ধৈর্যশীলদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলছেন, তারা বিপদের সম্মুখীন হলে ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পড়ে।
এই বাক্য পাঠকারীরা কোরআন অনুযায়ী ধৈর্যশীল মুমিন এবং মহান প্রভুর প্রতি আস্থাশীল। বলাই বাহুল্য এই বাক্য পাঠে রয়েছে বিপুল সওয়াব। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘তোমাদের কারো ওপর কোনো বিপদ এলে অবশ্যই সে যেন ‘ইন্না লিল্লাহ…’ বলে। অর্থাৎ নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহ তাআলার এবং আমাদের অবশ্যই তাঁর দিকে ফিরে যেতে হবে। হে আল্লাহ! তোমার কাছে আমি আমার বিপদের প্রতিদান চাই। অতএব তুমি আমাকে এর প্রতিদান দাও এবং এর বিনিময়ে ভালো কিছু দান করো।’ (তিরমিজি: ৩৫১১)
এভাবে বিপদে ধৈর্যশীল বান্দা হিসেবে ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনের দোয়া পাঠ করার মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। তাঁর কাছে এর উত্তম প্রতিদান পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন— মুমিনের অবস্থা বিস্ময়কর। সব কাজই তার জন্য কল্যাণকর। মুমিন ছাড়া অন্য কেউ এ বৈশিষ্ট্য লাভ করতে পারে না। তারা সুখ-শান্তি লাভ করলে শোকর-গুজার করে আর অসচ্ছলতা বা দুঃখ-মসিবতে পতিত হলে ধৈর্যধারণ করে, প্রত্যেকটাই তার জন্য কল্যাণকর।’ (মুসলিম: ৭৩৯০)
তাছাড়া কারো মৃত্যুর খবর শুনে ইন্নালিল্লাহ পড়ার মাধ্যমে মুমিন নিজেকে মনে করিয়ে দেয় যে, এভাবে একদিন আমাকেও চলে যেতে হবে। এটি একইসঙ্গে নিজের জন্য অনেক বড় একটি উপদেশ। তাই আমাদের উচিত, ছোট-বড় বিপদে বিচলিত না হয়ে ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ বলা।
এর মাধ্যমে মহান আল্লাহ আমাদের উত্তম প্রতিদান দেবেন এবং হেদায়েতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করবেন।
উম্মে সালামা (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, কোন মুসলিম যখন বিপদে পড়ে, সে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন’ বলবে এবং এ দোয়া পাঠ করবে,
اللَّهُمَّ أْجُرْنِي فِي مُصِيبَتِي وَأَخْلِفْ لِي خَيْرًا مِنْهَا
দোয়ার বাংলা অর্থ : হে আল্লাহ! আমার বিপদে আমাকে প্রতিদান দিন এবং হারানো বস্তুর চেয়ে উত্তম বস্তু আমাকে দান করুন’ তাহলে আল্লাহ তাকে উত্তম বস্তু দান করেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯১৮)।
মানব-জীবনের বিপদাপদ এক একটি নিদর্শন ও উপলক্ষ। কীসের নিদর্শন? পার্থিব সুখের ক্ষণস্থায়িত্বের নিদর্শন। কীসের উপলক্ষ? মানুষের সতর্কতা ও সচেতনতার উপলক্ষ। সেই মানুষটিই তো জ্ঞানী যিনি উপলব্ধি করেন বিপদ-মৃত্যুর ভাষাহীন বাণী। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন-
الشَّقِيُّ مَنْ شَقِيَ فِي بَطْنِ أُمِّهِ وَالسَّعِيدُ مَنْ وُعِظَ بِغَيْرِهِ.
দুর্ভাগা সে যে মাতৃগর্ভেই ছিল দুর্ভাগা আর সৌভাগ্যবান সে যে উপদেশ গ্রহণ করে অন্যের দ্বারা। -সহীহ মুসলিম, ২৬৪৫।
কবি বলেন-
نحمدُ اللهَ وحدَه
نحنُ كلٌّ على خَطَر
ربَّ لاهٍ وعمرُه
قد تقضَّى وما شَعَر
رُبَّ عيشٍ قد كان فو
قَ المنى مونَقَ الزَّهَر
في قريرٍ من العُيو
نِ وظلٍ من الشَّجَر
وسرورٍ من النَّبَا
تِ وطيبٍ من الثَمَر
غيَّرتْه وأهلَه
سرعةُ الدهرِ بالغِيَر
نحمدُ الله وحدَه
إن في ذاك لمعتَبَر
প্রশংসা এক আল্লাহর/ আমরা যে মৃত্যুমুখে সবাই।
কত গাফিলজন রয়েছে গাফলতে,
অথচ আয়ু তার ফুরিয়ে গেছে।
কত সুখ ছিল আশারও অধিক-
ফল-ফসলে, বাগবাগিচায়,
হাসি-আনন্দে, শীতল বৃক্ষ-ছায়ায়।
অবশেষে চোখের পলকে,
সুখ ও সুখী দু’জনই চলে গেছে।
প্রশংসা এক আল্লাহর/ এ যে পরম শিক্ষা ভাই!
-তাফসীরে ইবনে কাসীর, সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৯০-১৯৪-এর অধীনে
পরিশেষে, Conclusion
যে কোনো বিপদ-আপদে ধৈর্য ধারণ ও আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা মুমিনের কর্তব্য। আল্লাহই মুমিনের চূড়ান্ত ভরসাস্থল। কুরআনে আল্লাহ তার সাহায্য প্রার্থনা করতে বলেছেন ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বিপদে মসিবতে ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পাঠ করার এবং ধৈর্যশীল মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।