হাদীসের উপরে বিস্তারিত আলোচনা কম শব্দে করা সম্ভব নয়। শুধুমাত্র হাদীস এবং উসূলে হাদীস বিষয়ের উপরে অসংখ্য গ্রন্থ বিগত প্রায় দেড় হাজার বছরে পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন ভাষায় রচিত, পঠিত এবং সমাদৃত হয়ে আসছে। বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে হাদীসের প্রকার-প্রকরণ বিবেচনা করা হয়েছে, যা আজকের এই প্রতিবেদনে তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
হাদীস কি? What is Hadith?
হাদীসের সংজ্ঞায় অনেকে বলেন- হাদিস মূলত: ইসলাম ধর্মের সর্বশেষ ঐশীবাণীবাহক হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী ও জীবনাচরণ। ফক্বীহগণের পরিভাষায় হাদীসের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলতে হয় হে, নাবী কারীম আল্লাহর রাসূল হিসেবে যা কিছু বলেছেন, যা কিছু করেছেন এবং যা কিছু বলার বা করার অনুমতি দিয়েছেন অথবা সমর্থন জানিয়েছেন তাকে হাদীস বলা হয়।
কিন্তু মুহাদ্দিসগণ এর সঙ্গে রাসুলুল্লাহ সম্পর্কিত বর্ণনা ও তার গুণাবলীর বিবরণকেও হাদীসের অন্তর্ভুক্ত করে থাকেন। হাদিসের উপদেশ মুসলমানদের জীবনাচরণ ও ব্যবহারবিধির অন্যতম পথনির্দেশ। হাদিসকে ইসলামি সভ্যতার ‘মেরুদন্ড’ বলা হয়। হাদিসের কর্তৃত্ব কুরআনের পরেই দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। হাদিসে ধর্মীয় অবশ্য করণীয় কাজের বিবরণ থেকে শুরু করে সালাতের সঠিক ধরন ও দাসদের প্রতি দানশীলতার গুরুত্ব পর্যন্ত সব কিছুরই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বুখারী শরীফের বিশিষ্ট ব্যাখ্যাগ্রন্থ عمدة القارى এর মধ্যে হাদীস সম্বন্ধে রয়েছে:
علم الحديث هو علم يعرف به اقوال النبى ﷺ وافعاله واخواله –
এর বাংলা অর্থ হল : ইলমে হাদীস এমন বিশেষ জ্ঞান যার সাহায্যে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা, কাজ ও অবস্থা জানতে পারা যায়।
সিহাহ সিত্তাহ বা ছয়টি বিশুদ্ধ হাদীসগ্রন্থ, Sihah Sittah or Six Pure Books of Hadith
হিজরী তৃতীয় শতাব্দীতে বেশ কয়েকজন মুসলিম মণিষী সারা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাদীস সংগ্রহ করেন। সংগ্রহকারীদের মধ্যে বিখ্যাত হলেন ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম আবূ দাউদ, ইমাম তিরমিজী, ইমাম নাসাঈ, এবং ইমাম ইবনে মাজাহ। উল্লেখিত মুসলিম মণিষীদের সংকলিত হাদীস গ্রন্থগুলো হলো সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, সুনানে আবূ দাউদ, সুনান আত-তিরমিজী, সুনানে নাসাই এবং সুনানে ইবনে মাজাহ। এই ছয়খানা হাদীসগ্রন্থকে সন্মিলিতভাবে সিহাহ সিত্তাহ বা ছয়টি বিশুদ্ধ হাদীসগ্রন্থ বলা হয়
হাদীস সংরক্ষণ ও বর্ণনা করার ফজীলত, Virtues of preserving and narrating hadith
হাদীস সংরক্ষণ ও বর্ণনা করা অত্যন্ত ফজীলত পূর্ণ। এর মাধ্যমে প্রিয়নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র কালামের হেফাযত করা হয় বলে মুসলমানদের বিশ্বাস। আর এই ধরনের ব্যক্তির ব্যাপারে প্রিয়নবী বলেছেন:-
نضرالله امرأسمع مقالتى فوعاهاواداها كماسمع فرب حامل فقه غير فقيه ورب حامل فقه الى من هوافقه منه –
এর বাংলা অর্থ হল : আল্লাহ পাক সেই ব্যক্তিকে সতেজ, ও সমুজ্জ্বল রাখুন, যে আমার কথাগুলো শুনেছে, সংরক্ষণ করেছে এবং অপরজনের নিকট তা পৌঁছে দিয়েছে। (আবু দাউদ)
হাদীসের ব্যাখ্যায় কোন কোন মুহাদ্দিস বলেছেন, যে ব্যক্তি মূলত অর্থেই হাদীস সন্ধানী হয় তার চেহারা সজীব বা নূরানী হয়ে ফুটে উঠবে।
আল্লাহর রাসূল হাদীস বর্ণনাকারীদের জন্য দোয়া করেছেন এবং তাদেরকে নিজের উত্তরসূরী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে বলেছেন:
اللهم ارهم خلفائى قالو يارسوالله ومن خلفائك قال الذين يرؤون الاحاديث ويعلمونـها الناس –
এর বাংলা অর্থ হল : হে আল্লাহ, আমার উত্তরসূরীদের প্রতি রহম কর“ন। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলুাল্লাহ! আপনার উত্তরসূরী কারা? তিনি বলেন, তারাই যারা আমার হাদীস বর্ণনা করে ও মানুষের নিকট শিক্ষা দেয়। হাদীস বর্ণনাকারীরা আরো একটি উপায়ে লাভবান হতে পারে। আল্লাহর রাসূল বলেছেন, “নিশ্চয়ই কিয়ামতের দিন তারাই আমার নিকটবর্তী হবে যারা অধিক হারে আমার প্রতি দরূদ ও সালাম পেশ করে।” (তিরমিযী)
হাদীসের প্রকারভেদ, Types of hadith
শাস্ত্রীয় আকারে দেখতে গেলে একটি হাদীসের দুটি অংশ আছে: প্রথমটি হল সনদ ( বা বর্ণনাকারীদের শৃঙ্খল, যারা হাদিস বর্ণনা করেছেন) এবং অপরটি মতন ( হাদিসের মূল পাঠ)। স্বতন্ত্র হাদিসকে মুসলিম ধর্মগুরু ও আইনবিদগণ “সহিহ” (প্রমাণিক), “হাসান” ( মধ্যম মানসম্পন্ন) এবং “জয়িফের” (দুর্বল) মতো তিনটি শ্রেণীতে শ্রেণীবদ্ধ করেছেন।
হাদীসের মূল বক্তব্যগুলোর উপর ভিত্তি করে হাদীসকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা:
ক্বওলী হাদীস:
রাসুলুল্লাহ কোন বিষয়ে যা বলেছেন, অর্থাৎ যে হাদীসগুলোতে তাঁর বক্তব্য বিবৃত হয়েছে তাকে ক্বওলী (বাণী সম্পর্কিত) হাদীস বলা হয়।
ফে’লী হাদীস:
মহানাবীর বিভিন্ন কাজকর্ম, চরিত্র ও আচার-আচরণের ভেতর দিয়েই ইসলামের যাবতীয় বিধি-বিধান ও রীতিনীতি পরিস্ফুট, তাই যে সকল হাদীসে তাঁর কোন কাজের বিবরণ উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোকে ফে’লী (কর্ম সম্পর্কিত) হাদীস বলে।
তাকরীরী হাদীস:
সাহাবীগণের যে কথা বা কাজগুলো নাবী কারীম-এর অনুমোদন ও সমর্থন প্রাপ্ত হয়েছে, সে ধরনের কিছুর বিবরণ থেকেও শরীয়াতের দৃষ্টিভঙ্গি জানা যায়। যে সকল হাদীসে এইরূপ কোন ঘটনার বা কাজের উল্লেখ আছে সেগুলো তাকরীরী (সমর্থন মূলক) হাদীস এর অন্তর্গত।
সুন্নি দৃষ্টিভঙ্গিতে হাদীস :
সুন্নি ইসলামের পণ্ডিতদের মধ্যে হাদিস শব্দটি শুধুমাত্র মুহাম্মদের কথা, উপদেশ, অনুশীলন ইত্যাদিতেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি তাঁর সাহাবীদের কথা, উপদেশ ও অনুশীলন অন্তর্ভুক্ত করে। মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় হাদীসকে সহীহ হাদীস বলে তখনই গণ্য করা হয় যদি সেই হাদিসগুলোর মধ্যে ৫টি শর্ত পূরণ হয়। শর্তগুলো হল –
- হাদীসের সকল বর্ণনাকারী সৎ ও বিশ্বস্ত
- বর্ণনাকারীদের নির্ভুল বর্ণনার ক্ষমতা পূর্ণরূপে বিদ্যমান
- প্রত্যেক বর্ণনাকারী তার ঊর্ধ্বতন বর্ণনাকারী থেকে হাদীসটি স্বকর্ণে শুনেছেন বলে প্রমাণিত
- অন্যান্য প্রামাণ্য বর্ণনার বিপরীত নয় বলে প্রমাণিত
- সনদগত বা অর্থগত কোনো সূক্ষ্ম ত্রুটি নেই বলে প্রমাণিত।
শিয়া দৃষ্টিভঙ্গিতে হাদীস :
শিয়া ইসলামে হাদিস হলো, সুন্নাহের মূর্ত প্রতীক, যা মুহাম্মাদ সা. ও তার পরিবার আহল আল-বাইতের (বারো ইমাম ও মুহাম্মদের সা. কন্যা ফাতিমা) কথা, কাজ ও অনুশীলন। শিয়া দৃষ্টিভঙ্গিতে ছয়জন প্রসিদ্ধ হাদিস সংগ্রাহককে এতটা মূল্যায়ন করা হয় না। শিয়া মতানুসারে পাঁচজন প্রসিদ্ধ হাদিস সংগ্রাহক রয়েছেন।
- কিতাব আল-কাফী
- আল-ইস্তিবসার
- তহজীব আল-আহকাম
- মুন লা ইয়াহ্দুরুহু আল-ফাকিহ
- নাহ্জুল বালাগা
ইবাদি দৃষ্টিভঙ্গিতে হাদীস :
আরব রাষ্ট্র ওমানে ইবাদি মত প্রচলিত। এই মত অনুযায়ী সুন্নিদের অনুসৃত কিছু হাদিস গ্রহণ করা হয়, কিছু গ্রহণ করা হয় না। হাদিস গ্রহণের ব্যাপারে এই মতের অনুসারীদের নিজস্ব কিছু ধারণা রয়েছে।
সুন্নিরা বিপুল সংখ্যক হাদিস গ্রহণ করে থাকলেও ইবাদিরা তা করেন নি। ইবাদী মত অনুসারীদের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ এবং একচেটিয়া হাদিস গ্রন্থ হচ্ছে :আল-জামি আল-সহিহ্ – যার অপর নাম মুসনাদ আল-রাবি ইবন হাবিব। আবু ইয়াকুব ইউসুফ ইবন ইবরাহিম আল-ওয়ারিজলানি এই গ্রন্থ সংকলন করেছেন।
হাদিস শাস্ত্রের কিছু পরিভাষা, Some terminologies of hadith scriptures
সাহাবী (صحابى)
ঈমানের সঙ্গে যেসব ব্যক্তি ইসলামের নবীর সাহচর্য লাভ করেছেন ও তার একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন, তাদেরকে সাহাবী বলা হয়।
তাবিঈ (تابعى)
ইসলামের নবীর কোনো সাহাবীর নিকট যারা হাদীস শিক্ষা গ্রহণ করেছেন তাদেরকে তাবিঈ বলা হয়।
মুহাদ্দিস (محدث)
যে ব্যক্তি হাদিস চর্চা করেন এবং বহুসংখ্যক হাদিসের সনদ ও মতন সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান রাখেন তাকে মুহাদ্দিস বলা হয়।
শায়খুল হাদিস
হাদিস শাস্ত্রে গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী, দীর্ঘ দিন হাদিসের পঠন ও পাঠনে নিরত শায়খকে ‘শায়খুল হাদিস’ বলা হয়।
শায়খ (شيخ)
হাদিসের শিক্ষাদাতা রাবীকে (বর্ণনাকারীকে) শায়খ বলা হয়।
শাইখাইন (شيخين)
সাহাবীগণের মধ্যে আবু বকর ও উমরকে একত্রে শায়খায়ন বলা হয়। কিন্তু হাদিসশাস্ত্রে ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমকে এবং ফিক্হ-এর পরিভাষায় ইমাম আবু হানিফা ও আবু ইউসুফকে একত্রে শায়খায়ন বলা হয়।
হাফিজ (حافظ)
সনদ ও মতনের বৃত্তান্ত সহ এক লক্ষ হাদিস যিনি আয়ত্ত করেছেন তাকে হাফিজ বলা হয়।
হুজ্জাত (حجة)
তিন লক্ষ হাদিস যিনি আয়ত্ত করেছেন তাকে হুজ্জাত বলা হয়।
হাকিম (حاكم)
সব হাদিস যিনি আয়ত্ত করেছেন তাকে হাকিম বলা হয়।
রিজাল (رجال)
হাদিসের রাবি সমষ্টিকে রিজাল বলে। যে শাস্ত্রে রাবি বা বর্ণনাকারীদের জীবনী বর্ণিত তাকে আসমাউর-রিজাল (اسماء الرجال) বলা হয়।
রিওয়ায়ত (رواية)
হাদিস বর্ণনা করাকে রিওয়ায়ত বলে।
সনদ (سند)
হাদিসের মূল কথাটুকু যে সূত্র পরম্পরায় গ্রন্থ সংকলনকারী পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে সনদ বলা হয়।
মতন (متن)
হাদিসের মূল কথা ও তার শব্দ সমষ্টিকে মতন বলে।
মরফু’ (مرفوع)
যে হাদিসের সনদ ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) পর্যন্ত পৌঁছেছে, তাকে মরফু’ হাদিস বলে।
মাওকুফ (موقوف)
যে হাদিসের বর্ণনা-সূত্র ঊর্ধ্ব দিকে সাহাবী পর্যন্ত পৌঁছেছে, তাকে মাওকুফ হাদিস বলে। এর অপর নাম আসার (اثار) ।
মাকতু (مقطوع)
যে হাদিসের সনদ কোনো তাবিঈ পর্যন্ত পৌঁছেছে, তাকে মাকতু’ হাদিস বলা হয়।
মুত্তাফাকুন আলাইহি (متفق عليه)
যে হাদিসের বিশুদ্ধতার ব্যাপারে ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম উভয়ই একমত হয়ে উক্ত হাদিস লিপিবদ্ধ করেছেন তাই মুত্তাফাকুন আলাইহি হাদিস।
সহিহ (ﺻﺤﻴﺢ )
যে মুত্তাসিল হাদিসের সনদে উল্লেখিত অর্থাৎ (ইত্তেসালে সনদ, জাবত, আদালত, সাজ না হওয়া, দোষ মুক্ত হওয়া,) প্রত্যেক বর্ণনাকারীই পূর্ণ আদালত ও জাবতা-গুণসম্পন্ন এবং হাদিসটি যাবতীয় দোষত্রুটি মুক্ত তাকে সহিহ হাদিস বলে।
হাসান (حسن)
যে হাদিসের কোনো বর্ণনাকারীর জারতগুণে পরিপূর্ণতার অভাব রয়েছে তাকে হাসান হাদিস বলা হয়।
যয়িফ ( ﺿﻌﻴﻒ)
যে হাদিসের বর্ণনাকারী কোনো হাসান হাদিসের বর্ণনাকারীর গুণসম্পন্ন নন তাকে যয়িফ/য’ইফ/ জইফ হাদিস বলে।
মাওজু’ (موضوع)
যে হাদিসের বর্ণনাকারী ইসলামের নবীর নামে মিথ্যা কথা রটনা করেছে বলে প্রমাণিত হয়েছে, তার বর্ণিত হাদিসকে মাওজু’ হাদিস বলে। এরূপ ব্যক্তির বর্ণিত হাদিস গ্রহণ করা হয় না।
কুদসি’ (حديث قديس)
যে সকল হাদিসকে ইসলামের নবী (হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর বানী বলে উল্লেখ করেছেন সেগুলোকে হাদিসে কুদসি বলা হয়।
শেষ কথা, To conclude
প্রিয়তম রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নবুয়াতী জীবনের সকল কথা, কাজ এবং অনুমোদনই হচ্ছে হাদীস। আশা করি এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আপনারা হাদীস সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য জানতে পেরেছেন।