আমাদের মধ্যে অনেকেই রাতের খাবার খাওয়ার পর পরই ঘুমিয়ে পড়েন। আবার অনেকে এমনও আছেন যারা রাতের খাবার খাওয়ার পর মহান আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন আমল করে থাকেন। অনেকে আবার একটু সময় হাঁটাহাঁটি করেন।
যে যাই করুক না কেন সবাই এক সময় ঘুমাতে যায়। তবে অনেকেই হয়তো জানেন না যে মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা ঘুমানোর আগে দোয়া পড়েন। ঘুমোতে যাওয়ার আগে নবী রাসূল (সা.) কোন দোয়াটি পাঠ করতেন মুসলমান হিসেবে তা আমাদের সবারই জানা দরকার। তাই আজকের এই প্রতিবেদনে ঘুমানোর আগের দোয়া সম্পর্কে আলোচনা করবো।
ঘুমানোর আগে ও পরের দোয়া, Ghumanor aage o porer Doya
ঘুমানোর আগে ও পরে বিশ্বনবি যে দোয়া পড়তেন,
হজরত হুযাইফাহ রাদিয়াল্লাহ আনহু তে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতের বেলায় নিজ বিছানায় শোয়ার (ঘুমানোর আগে) সময় নিজের হাত গালের নিচে ধরে রাখতেন। অতঃপর বলতেন-
اَللَّهُمَّ بِاسْمِكَ أَمُوتُ وَأَحْيَا
- এর উচ্চারণ হল- আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়া আহইয়া।
- এর বাংলা অর্থ হল : ‘হে আল্লাহ! আপনারই নামে মরে যাই আবার আপনারই নামে জীবন লাভ করি।’
আর যখন (ঘুম থেকে) সজাগ হতেন, তখন বলতেন-
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَحْيَانَا بَعْدَ مَا أَمَاتَنَا وَإِلَيْهِ النُّشُورُ
- এর উচ্চারণ হল- ‘আলহামদু লিল্লাহিল লাজি আহইয়ানা বা’দা মা আমাতানা ওয়া ইলাইহিন নুশুর।’
- এর বাংলা অর্থ হল : ‘সব প্রশংসা ওই আল্লাহর জন্য, যিনি মৃত্যুর পর আমাদের জীবন দান করেছেন এবং তার দিকেই আমাদের পুনরুত্থান।’আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বিশ্বনবির ঘুমানোর এ ছোট্ট আমলটি নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করার তাওফিক দান করুন।
ইসলামের নির্দেশিত পদ্ধতিতে ঘুম, Bengali prayer for sleep as per Islamic instruction
মুমিনের প্রতি কাজই ইবাদত বলে গণ্য। ঘুমও এর ব্যতিক্রম নয়। যদি কোনো ব্যক্তি ইসলামের নির্দেশিত পদ্ধতিতে ঘুমায়, তার ঘুমও ইবাদতে পরিণত হয়। রাতে ঘুমানোর আগে কিছু করণীয়-বর্জনীয় কাজ রয়েছে। সেগুলি ইসলাম ধর্মীয় ব্যক্তিদের মেনে চলতে হয়।
রাতে দেরি করে না ঘুমানো
রাসুল (সা.) এশার নামাজের পর গল্পগুজব ও গভীর রাত পর্যন্ত সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর তাগিদ দিতেন। (মুসনাদে আবি ইয়ালা, হাদিস : ৪৮৭৯) তাই ইসলামের নির্দেশ অনুযায়ী রাতের বেলা কোনো অহেতুক কাজ, ইন্টারনেট ব্রাউজিং, কোনো বিনোদন উপভোগ করে নিজের সময় নষ্ট না করে বরং তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া উচিত।
একাকী ঘরে না ঘুমানো
হাদিসে কোনো ঘরে একা ঘুমানোর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.) কোনো ঘরে একাকী রাত যাপন এবং একাকী সফর করতে নিষেধ করেছেন। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৫৬৫০)
খোলা আকাশের নিচে না ঘুমানো
খোলা আকাশের নিচে বা ছাদেও ঘুমানো যাবে না। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি বেষ্টনীবিহীন ছাদে রাতে ঘুমাল, (কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে) তার সম্পর্কে (আল্লাহর) কোনো জিম্মাদারি নেই।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৫০৪১)। তাই রাতে নিরাপদে ঘুমানোর জন্য রাসুল (সা.) কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। এই নির্দেশগুলোর ওপর আমল করলে একদিকে যেমন বিপদ-আপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে, অন্যদিকে প্রিয় নবীর সুন্নত আদায়ের সওয়াব পাওয়া যাবে।
জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা রাতে পানাহারের পাত্রগুলো ঢেকে রেখো। ঘরের দরজাগুলো বন্ধ রেখো। আর সাঁঝের বেলা তোমাদের বাচ্চাদের ঘরে আটকে রেখো, কারণ এ সময় জিনেরা ছড়িয়ে পড়ে এবং কোনো কিছুকে দ্রুত পাকড়াও করে। নিদ্রাকালে বাতিগুলো নিভিয়ে দেবে। কেননা অনেক সময় ছোট ক্ষতিকারক ইঁদুর প্রজ্বলিত সলতেযুক্ত বাতি টেনে নিয়ে যায় এবং গৃহবাসীকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৩১৬)
খাবারের পাত্র ঢেকে রাখা
রাতের বেলা ঘুমানোর আগে ঘরে থাকা সকল খাবারের পাত্র না ঢাকলে তাতে ইঁদুর, তেলাপোকা বা অন্য কোনো পোকা এসে হানা দিতে পারে, ফলে এর থেকে মারাত্মক রোগ ছড়াতে পারে। ইতিহাসে ব্ল্যাক ডেথ বলে একটি ঘটনার উল্লেখ আছে, যেক্ষেত্রে খাবারের মধ্যে ইঁদুরের ছড়ানো ভাইরাসে প্রায় ১০ কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল। রাতের বেলা যখন আমরা ঘুমিয়ে পড়ি তখন চারদিকে ইঁদুরের বিচরণ বেড়ে যায়। তাই খাবারদাবার ভালোভাবে না ঢাকলে তারা আমাদের খাবারে এসে মুখ দিতে পারে, ফলে সেই খাবার তথা খাবারের পাত্রে ভাইরাস ছড়াতে পারে।
ঘরের দরজা বন্ধ রাখা
ইসলামের নির্দেশ নিতে রাতে ঘুমানোর আগে ঘরের দরজা ভালোভাবে বন্ধ করে রাখা আবশ্যক। কারণ রাতে দরজা খোলা রেখে ঘুমালে চোর-ডাকাতের কবলে পড়তে হতে পারে। এছাড়াও যেকোনো বিপদ যেমন কোনো হিংস্র পশু ইত্যাদি আমাদের অজান্তে ঘরে প্রবেশ করতে পারে।
নিদ্রাকালে বাতি নিভিয়ে দেওয়া
রাতে ঘুমানোর আগে ঘরের মধ্যে জ্বলে থাকা চেরাগ, মোমবাতি, কয়েল ইত্যাদি সবকিছু নিভিয়ে দিতে হবে। এমন কাজ করার নেপথ্যে কারণগুলো হল এই আলো থেকে অনেক সময় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। তাছাড়া ঘুমের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে ঘরকে অন্ধকার করে নেওয়া জরুরি। এর কারণ হল অন্ধকার শরীর থেকে ঘুমের সময় মেলাটোনিন হরমোনের ক্ষরণ বৃদ্ধি করে, যা শান্তির ঘুমের সহায়ক। মেলাটোনিন মাথায় পেনিয়াল গ্ল্যান্ড থেকে নিঃসৃত হওয়া এক বিশেষ ধরনের হরমোন, যা বুদ্ধি বাড়াতে সহায়তা করে। তাই ঘুমের সময়টা ঘর অন্ধকার রাখা খুবই দরকার।
পবিত্রতা অর্জন
ইসলাম ধর্মে রাতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র হয়ে শোয়া সুন্নত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যদি কোনো মুসলমান রাতে আল্লাহকে স্মরণ করে অজু শেষে শয়ন করে এবং রাতে জাগ্রত হয়ে দুনিয়া ও আখিরাতের কোনো কল্যাণ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, আল্লাহ তাআলা তা দান করেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৫০৪২)
বিছানা ঝেড়ে নেওয়া
নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যদি তোমাদের কেউ শয্যায় যায়, তখন সে যেন তার লুঙ্গির দ্বারা বিছানাটা ঝেড়ে নেয়। কারণ সে জানে না যে বিছানার ওপর তার অনুপস্থিতিতে পীড়াদায়ক কোনো কিছু আছে কি না। তারপর এই দোয়া পড়বে—হে আমার রব! আপনারই নামে আমার শরীরটা বিছানায় রাখলাম এবং আপনারই নামে আবার উঠব।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৩২০)
চোখে সুরমা লাগানো
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নবী (সা.)-এর একটি সুরমাদানি ছিল। প্রতি রাতে তিনি ঘুমানোর আগে ডান চোখে তিনবার এবং বাঁ চোখে তিনবার সুরমা লাগাতেন। (শামায়েলে তিরমিজি, হাদিস : ৪১)
সুরমা চোখের জন্য খুব ভালো, এটি চোখের স্বাস্থ্য ভালো রাখে এবং ছোঁয়াচে সব ধরনের রোগ-জীবাণু ধ্বংস করে। চোখে প্রবেশকৃত ধুলা ও ক্ষতিকর পদার্থগুলো নিঃসরণে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধক জীবাণুকেও ধ্বংস করে। পাশাপাশি চোখে জ্বালাপোড়া নিরাময় করে।
ডান কাতে শোয়া
ডান কাতে শোয়ার মানে এই নয় যে সারা রাত আর বাঁ দিকে কাত হওয়া যাবে না। তবে ইসলামে সব ভালো কাজে যেহেতু ডান হাতকে প্রাধান্য দিতে বলেছে, তাই ঘুমের বেলায়ও ডান দিকে কাত হয়ে শোয়ার মধ্য দিয়ে রাতের ঘুম শুরু করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর কারণ হল ডান কাত হয়ে ঘুমালে আমাদের হৃৎপিণ্ড, পাকস্থলী, ফুসফুস ইত্যাদির অবস্থান স্বাভাবিক থাকে, যা বাঁ কাত হয়ে ঘুমানোর চেয়ে বেশি উপকারী।
দোয়া পড়া
রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি শোয়ার পর আল্লাহর নাম নেয় না, তার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে লাঞ্ছনা নেমে আসবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮৫৬)
হাদিস শরিফে ঘুমানোর আগে কয়েকটি দোয়া বর্ণিত রয়েছে। সব দোয়া পড়তে না পারলেও ছোট এই দোয়াটি পড়া যায় : ‘আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়া আহ্ইয়া’, অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! তোমার নামে আমি শয়ন করছি এবং তোমারই দয়ায় আমি পুনর্জাগ্রত হব।’
আয়াতুল কুরসি পড়া
রাসুল (সা.) বলেন, ‘তুমি যখন শয্যা গ্রহণ করবে, তখন আয়াতুল কুরসি পড়বে। তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে সর্বদা তোমার জন্য একজন রক্ষক থাকবে এবং সকাল পর্যন্ত শয়তান তোমার কাছে আসতে পারবে না।’ (বুখারি, হাদিস : ২৩১১)
সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পড়া :
ইসলামের বিশ্বাস অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি ঘুমানোর আগে এ দুই আয়াত পড়লে তা তাদের গোটা রাতের নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট হবে। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যদি কোনো ব্যক্তি সুরা বাকারার শেষ দুটি আয়াত পাঠ করে, তবে এটিই তার জন্য যথেষ্ট।’ (বুখারি, হাদিস : ৫০৪০)
শেষ কথা, Conclusion
ইসলামের নির্দেশ অনুযায়ী ঘুমানো উচিত, আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য এই নির্দেশ পালন করে থাকেন মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা। যারা এই ঘুমানোর আগে দোয়া সম্পর্কে জানতেন না আশা করি এই প্রতিবেদন আলোচিত বিষয়গুলো আপনাদের এই ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে সহায়তা করবে।