রাসুল (সা.)-এর অন্যতম একটি সুন্নাত হলো কবর জিয়ারত করা। কবর কথাটি সকল মানুষকেই মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কবর কথাটি শুনলেই যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে পরকালীন জীবনের কথা; জান্নাত কিংবা জাহান্নামের কথা। মৃত্যুর চিন্তা তখন যেন আত্মাকে বিদগ্ধ করে দেয়।
কবর জিয়ারত করলে হৃদয় বিনম্র হয়। আখিরাতের প্রতি উৎসাহ পাওয়া যায়। গুনাহ ও অন্যায় থেকে তওবা করার মানসিকতা তৈরি হয়। সৎ-আমলের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
কবর জিয়ারতের অনুমতি, Permission for Kabar Ziyarat :
ইসলামের শুরুর দিকে কবর জিয়ারতের অনুমতি ছিল না। পরবর্তী সময়ে হজরত মুহাম্মদ (সা.) কবর জিয়ারতের অনুমতি দেন। সুনানে ইবনে মাজাহতে উল্লিখিত এক হাদিসে তিনি বলেছিলেন,
‘তোমাদের কবর জিয়ারতে নিষেধ করেছিলাম। এখন থেকে কবর জিয়ারত করো। কেননা, তা দুনিয়া বিমুখতা এনে দেয় এবং আখিরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।’
কবর জিয়ারতের অনুমতি দেওয়ার অন্যতম কারণ হলো- এতে পরকালীন জীবনের কথা স্মরণ হয়। কবর জিয়ারতের বান্দা গুণাহ ছেড়ে দিয়ে নেক আমলের দিকে অগ্রগামী হয়। তাই ইসলামের প্রথম দিকে কবর জিয়ারতের অনুমতি না থাকলেও পরে রাসুল (সা.) কবর জিয়ারতের অনুমতি দেন।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর আম্মার কবর জিয়ারত করতে গিয়ে ক্রন্দন করেন। তাঁর সঙ্গীসাথীরাও অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। তারপর রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,
‘আমি আমার রবের কাছে আমার মায়ের কবর জিয়ারত করার অনুমতি চাইলে তিনি এর অনুমতি দিয়েছেন। কাজেই তোমরা কবর জিয়ারত করবে। কেননা, তা মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে দেয়।’ (আবু দাউদ)
কবর জিয়ারতের দোয়া, Dua for Kabar Ziyarat :
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনার কবরবাসীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় যে দোয়াটি তিনি পাঠ করেন তা হলো—
السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ يَا أَهْلَ الْقُبُورِ يَغْفِرُ اللَّهُ لَنَا وَلَكُمْ أَنْتُمْ سَلَفُنَا وَنَحْنُ بِالأَثَرِ
বাংলা উচ্চারণ : ‘আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর; ইয়াগফিরুল্লাহু লানা ওয়ালাকুম, আনতুম সালাফুনা ওয়া নাহনু বিল আছার।’
অর্থ : হে কবরবাসী! তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আল্লাহ আমাদের এবং তোমাদের ক্ষমা করুন, আমাদের আগে তোমরা কবরে গেছ এবং আমরা পরে আসছি। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১০৫৩)
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি কবর জিয়ারতে গিয়ে বলেছিলেন,
السَّلامُ عَلَيْكُمْ دَارَ قَوْمٍ مُؤمِنينَ وإِنَّا إِنْ شَاءَ اللَّهُ بِكُمْ لاحِقُونَ
বাংলা উচ্চারণ : আসসালামু আলাইকুম দার ক্বাওমিম মুউমিনি না ওয়া ইন্না ইনশাআল্লাহু বিকুম লাহিকুনা।
অর্থ : মুমিন ঘরবাসীর ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। ইনশাআল্লাহ, আমরা আপনাদের সঙ্গে মিলিত হবো। (সহিহ মুসলিম : ২৪৯)
পবিত্র অবস্থায় কবরস্থানে গিয়ে প্রথমে সালামের উল্লেখসহ উল্লিখিত দোয়াগুলোর যেকোনো একটি পড়বেন। এরপর দরুদ শরিফ, সুরা ফাতিহা, সুরা ইখলাস, আয়াতুল কুরসি পাঠ করবেন।
কবর জিয়ারতের নিয়ম, Rules for Kabar Ziyarat :
কবরস্থানে গিয়ে সর্বপ্রথম জিয়ারতের দোয়া পড়তে হয়, প্রথম সালাম দিতে হয়। আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর, অর্থাৎ হে কবরবাসী তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। এরপর কবরবাসীর ইসালে সওয়াবের নিয়তে দুরূদ শরিফ ও বিভিন্ন সুরা ইত্যাদি আদায় করা হয়। তারপর মৃত ব্যক্তির রুহের মাগফিরাত বা ক্ষমা প্রার্থনা করে মোনাজাত করতে হবে।
কবর জিয়ারতের নিয়ম :
- সূরা ফাতেহা ৩ বার।
- সূরা নাস ৩ বার।
- সূরা ফালাক ৩ বার।
- সূরা ইখলাস ৭ বার।
- আয়াতুল কুরছী ৩ বার।
- দুরূদ শরীফ ১১ বার।
- আস্তাগফিরুল্লাহ ১১ বার।
- মোনাজাত
কবর জিয়ারতের ফজিলত, Kabar Ziyarat Fazilat :
মৃতের বা কবরবাসীর মাগফিরাতের জন্য দোয়া করা নিয়ে হাদিসে কিছু সুরার বিশেষ ফজিলতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি দরুদ শরিফের ফজিলতের কথাও বলা হয়েছে। তাই কবর জিয়ারতের ক্ষেত্রে দরুদ শরিফ, সুরা ফাতিহা, সুরা ইখলাস, আয়াতুল কুরসি ও অন্য যেসব সুরা সহজ মনে হয়— সেগুলো পড়ে সওয়াব উপহার দেবেন।
কবর জিয়ারতের দোয়া করার ক্ষেত্রে কবরকে সামনে রেখে দুই হাত তুলে দোয়া করা উচিত নয়। বরং কবরকে পেছনে রেখে কিংবা কবরের দিকে পিঠ দিয়ে থেকে এরপর কিবলামুখী হয়ে দোয়া করতে হয়।
আবার কেউ চাইলে মুখে দোয়া উচ্চারণ না করে বরং হাত না তুলে মনে মনেও দোয়া করতে পারেন, তাতে জিয়ারত হয়ে যাবে।
জুমার দিন কবর জিয়ারত, Kabar Ziyarat on Jumma :
ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে জুমা একটি বিশেষ দিন, আর এই জুমার দিন অর্থাৎ শুক্রবার কবর জিয়ারত করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। জুমার দিন কবর জিয়ারত করলে জিয়ারতকারীর জন্যও তা ক্ষমালাভের কারণ হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
‘যে ব্যক্তি প্রতি জুমায় তার মা-বাবা বা তাদের একজনের কবর জিয়ারত করবে, তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে এবং মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহারকারীদের মধ্যে গণ্য করা হবে।’ (আল মুজামুল আউসাত: ৬১১৪)
কবরস্থানে গিয়ে যেসব কাজ করা বারণ, Prohibited activities in the cemetery :
একটা বিষয় অবশ্যই মনে রাখতে হবে, কবরস্থানে গিয়ে শিরকে পর্যায়ে চলে যায় এমন কোনো কাজ করা যাবে না। যেমন :
- কবরবাসীর কাছে কোনো কিছু কামনা করা,
- কবরের মাটি ছুঁয়ে সালাম বা সিজদা করা,
- কবরে মান্নত বা দান-খয়রাত তথা গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি, ডিম দেয়া ইত্যাদি।
- কবরের পাশে কান্না করা, হা-হুতাশ করাকে ইসলামে নিন্দনীয় বিষয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
নিজের আপনজনের কবরের পাশে কেউ যদি যায় তবে তাদের ক্ষেত্রে মনের অজান্তেই হয়তো চোখের জল চলে আসতে পারে, যা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে সেখানে গিয়ে কোনোভাবেই হা-হুতাশ করা উচিত নয়।
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) মহিলা কবর জিয়ারতকারী, তার ওপর মসজিদ নির্মাণকারী ও তাতে বাতি প্রজ্বালনকারীকে অভিশাপ দিয়েছেন। (আবু দাউদ: ৩২৩৬)
আয়েশা রাদিআল্লাহ আনহা থেকে বর্ণিত হাদিসে রয়েছে:
يَرْحَمُ اللَّهُ الْمُسْتَقْدِمِينَ مِنَّا وَالْمُسْتَأْخِرِينَ
নারীদেরকে কবর জিয়ারত থেকে তিনি নিষেধ করেছেন। হাদিসে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করব জিয়ারতকারী নারীদের অভিসম্পাত করেছেন। অতএব, তাদের জন্য কবর জিয়ারত করা জায়েজ নয়।
তবে তাদের জন্য বৈধ রয়েছে, জিয়ারত করা ব্যতীত ঘরে বসে মৃত ব্যক্তিদের মাগফেরাতের দোয়া করা, রহমতের দোয়া করা, জান্নাতে প্রবেশ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য দোয়া করা। অনুরূপ মসজিদে অথবা ঈদগাহে জানাযার সালাত পড়তে তাদের কোন বাধা নেই।
কবর জিয়ারত কি ভাবে করতে হয়, How to perform the Kabar Ziyarat?
কবর জিয়ারত যে কোনো দিনে যে কোনো সময়ে করা যেতে পারে। কোনো বিশেষ দিনে বা বিশেষ সময়ে কবর জিয়ারতের জন্য বিশেষ ফজিলতের বিষয়ে কোনো সহিহ হাদিস নেই।
রাতে কবরস্থানে গেলে কি হয়, What happens when you go to the cemetery at night?
আপনি যদি অন্ধকারের পরে কবরস্থানে ঘুরে বেড়ান তবে আপনাকে অনুমতি নিতে হবে, নতুবা আপনার সমস্যায় পড়ার ঝুঁকি রয়েছে । অন্ধকারে পরিদর্শন করা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মনে হতে পারে, তবুও আপনাকে কবরস্থানের নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং রাতে সেখানে যাওয়ার অনুমতি নিতে হবে।
শেষ কথা, Conclusion :
ইসলাম ধর্মে মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তিকে কবর দেওয়া হয়, সেটা হয়তো মুসলমান ছাড়া অন্য ধর্মের মানুষও জানেন। কবরে শায়িত আত্মীয়দের কাছে অনেকেই গিয়ে থাকেন, তাদের কথা স্মরণ করতে, তাদের আত্মার শান্তি কামনা করতে, দোয়া করতে। মুসলমানদের কবর দেওয়ার পর মৃত ব্যক্তির মুক্তির জন্য আল্লাহ্র কাছে দোয়া করা হয়। কবরস্থানকে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখা কর্তব্য। কবরের ওপর দিয়ে চলাচল করা কিংবা কবরের অবমাননা করা অনুচিত। কবর জিয়ারতের ফলে অন্তরে মৃত্যু ও পরকালের ভয় জাগ্রত হয়। সৎকাজ ও নেক আমলের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়।