ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস সংবলিত কয়েকটি আরবি পংক্তির নাম হল কালেমা বা কালিমা (আরবি: ٱلكَلِمَات), যার মাধ্যমেই ইসলামের প্রথম স্তম্ভ শাহাদাহ্ পূর্ণতা পায়। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ — এর অর্থ আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য মাবুদ বা উপাস্য নেই। এটি ইসলামের চূড়ান্ত কালেমা, মানবজীবনের পরম বাক্য। মহামূল্যবান এই বাণীর বিশেষ মর্যাদা রয়েছে এবং এর সাথে সম্পর্ক রয়েছে বিভিন্ন হুকুম আহকামের। ইসলামে মোট ছয়টি কালেমা রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম কালেমা হল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা এই কালেমা নিয়ে আলোচনা করবো।
মুসলমানদের ব্যক্তি জীবনে কালেমার গুরুত্ব, Importance of Kalema in personal life of Muslims
কালেমাকে স্বীকার করা এবং অস্বীকার করার মাধ্যমে মানব সম্প্রদায় ঈমানদার এবং কাফির এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। সৃষ্টি জগতে মানুষের কর্ম, কর্মের ফলাফল, পুরস্কার অথবা শাস্তি সব কিছুরই উৎস হচ্ছে কালেমা। এরই জন্য উৎপত্তি হয়েছে সৃষ্টিকুলের, আর এই সত্যের ভিত্তিতেই আখিরাতে জিজ্ঞাসাবাদ হয় এবং এর ভিত্তিতেই সাওয়াব ও শাস্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। এই কালেমার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মুসলিমদের জাতি সত্তার ভিত্তি-প্রস্তর এবং এর প্রতিষ্ঠার জন্য খাপ থেকে খোলা হয়েছে জিহাদের তরবারী। এটাই হচ্ছে বান্দার ওপর আল্লাহর অধিকার, ইসলামের মূল বক্তব্য এটাই ও শান্তির আবাসের (জান্নাতের) চাবিকাঠি। কালেমাই হচ্ছে কুফর ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী।
কালেমার উদ্দেশ্য, Purpose of Kalema
কালেমার সাক্ষ্য আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং নিজেই নিজের জন্য দিয়েছেন, পাশাপাশি ফিরিশতাগণ ও জ্ঞানী ব্যক্তিগণও সাক্ষ্য দিয়েছেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “আল্লাহ্ সাক্ষ্য দেন যে, নিশ্চয় তিনি ছাড়া কোন সত্য ইলাহ্ নেই। আর ফেরেশতাগণ এবং জ্ঞানীগণও; আল্লাহ্ ন্যায়নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই, (তিনি) পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।”
কালেমাই ইখলাস তথা সত্যনিষ্ঠার বাণী, সত্যের সাক্ষ্য ও দাওয়াত এবং শির্ক এর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার বাণী হল কালেমা এবং এ জন্যই সমস্ত জগতের সৃষ্টি। কালেমা প্রচারের জন্য আল্লাহ সমস্ত রাসূল এবং আসমানি কিতাবসমূহ প্রেরণ করেছেন, তিনি বলেন,
“আমরা তোমার পূর্বে যে রাসূলই প্রেরণ করেছি তাঁর নিকট এই প্রত্যাদেশ পাঠিয়েছি যে, আমি ছাড়া অন্য কোনো সত্য উপাস্য নেই অতএব তোমরা আমারই ইবাদত কর।”
আল্লাহ বলেন, তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছা স্বীয় নির্দেশে ওহী (প্রত্যাদেশ) সহ ফিরিশতা অবতীর্ণ করেন, এই মর্মে সতর্ক করবার জন্য যে, “আমি ছাড়া কোন (সত্য) উপাস্য নেই; সুতরাং তোমরা আমাকেই ভয়ভক্তি কর।”
ইবন উইয়াইনা বলেন, “বান্দার ওপর আল্লাহ তা‘আলার সবচেয়ে প্রধান এবং বড় নি‘আমত হলো তিনি তাদেরকে لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) তাঁর এই একত্ববাদের সাথে পরিচয় করে দিয়েছেন। দুনিয়ার পিপাসা কাতর তৃষ্ণার্ত একজন মানুষের নিকট ঠাণ্ডা পানির যে মূল্য, আখেরাতে জান্নাতবাসীদের জন্য এ কালেমা তদ্রূপ”
কালিমার স্তম্ভ ও শর্তসমূহ, Kalema’r stombho o sworto somuho
إِلهَ (ইলাহ) শব্দের অর্থ ‘মা‘বুদ’। এই ইলাহ হলেন ঐ সত্ত্বা যে সত্ত্বার প্রতি কল্যাণের আশায় এবং অকল্যাণ থেকে বাঁচার জন্য হৃদয়ের আসক্তি সৃষ্টি হয়, যার জন্য মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা মন থেকে তার উপাসনা করে।
পবিত্র কালেমা মুখে বললে কোনই উপকারে আসবে না যদি এর সাতটি শর্ত পূর্ণ করা না হয়। উক্ত শর্তগুলো হল :
- প্রথম শর্ত: কালেমার না বাচক এবং হ্যাঁ বাচক দু’টি অংশের অর্থ সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখতে হবে। অর্থ এবং উদ্দেশ্য না বুঝে শুধুমাত্র মুখে কালেমা উচ্চারণ করলে কোনো লাভ নেই। না বুঝে কালেমা পড়লে ঐ ব্যক্তি কালেমার মর্মের ওপর ঈমান আনতে পারবে না।
- দ্বিতীয় শর্ত: ইয়াকীন বা দৃঢ় প্রত্যয় রাখা, অর্থাৎ কালেমার মাধ্যমে যে কথার স্বীকৃতি দান করা হচ্ছে তাতে সামান্যতম সন্দেহ পোষণ করলে চলবে না।
- তৃতীয় শর্ত: ইখলাস বা নিষ্ঠা, যা لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এর দাবী অনুযায়ী ঐ ব্যক্তিকে শির্ক থেকে মুক্ত রাখবে।
- চতুর্থ শর্ত: কালেমা পাঠকারীকে হতে হবে সত্যের পরাকাষ্ঠা, যে সত্য তাকে মুনাফিকী আচরণ থেকে বিরত রাখবে। لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এ কালেমা মুখে মুখে উচ্চারণ মুনাফিকরাও করে থাকে, কিন্তু এর নিগূঢ় তত্ত্ব ও প্রকৃত অর্থে তারা বিশ্বাসী নয়।
- পঞ্চম শর্ত: ভালোবাসা থাকতে হবে, অর্থাৎ মুনাফেকী আচরণ বাদ দিয়ে কালেমাকে সানন্দচিত্তে গ্রহণ করতে হবে ও ভালোবাসতে হবে।
- ষষ্ঠ শর্ত : কালেমার প্রতি আনুগত্য, অর্থাৎ কালেমার দাবী অনুযায়ী তার হকগুলো আদায় করা, আর তা হচ্ছে আল্লাহর জন্য নিষ্ঠা ও তাঁর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ফরয ওয়াজিব কাজগুলো সম্পাদন করা।
- সপ্তম শর্ত : কালেমাকে আন্তরিকভাবে কবুল করা এবং দ্বীনের কোনো কাজকে প্রত্যাখান করা থেকে নিজকে বিরত রাখা, অর্থাৎ আল্লাহর যাবতীয় আদেশ পালন করতে হবে এবং ইসলাম ধর্মে তাঁর নিষিদ্ধ সব কাজ পরিহার করতে হবে।
উক্ত সাতটি শর্ত কুরআন ও হাদীসের আলোকেই প্রখ্যাত আলেমগণ চয়ন করেছেন। তাই কালেমাকে শুধুমাত্র মুখে উচ্চারণ করলেই যথেষ্ট এমন ধারণা ঠিক নয়।
প্রথম কালেমা, First Kalema
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ হল ছয় কালেমার প্রথম কালেমা। এই প্রথম কালেমা হচ্ছে কালেমায়ে তাইয়্যেবা, যার অর্থ হল পবিত্র বাক্য।
আরবি ভাষায় :
لَا إِلَٰهَ إِلَّا ٱللَّٰهُ مُحَمَّدٌ رَّسُولُ ٱللَّٰهِ
এর বাংলা উচ্চারণ :
লা~ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লা-হ্।।
এর বাংলা অনুবাদ :
আল্লাহ্ ছাড়া কোন সত্য উপাস্য নাই, মুহাম্মাদ তার প্রেরিত রসূল।
ইংরেজী অনুবাদ :
There is no God but Allah, Muhammad (Sall-Aallahu Alayhi wa Sallam) is the messenger of Allah.
লা ইলাহা এর অর্থ কি? What is the meaning of La Ilaha?
‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র অর্থ হলো, আল্লাহ ছাড়া কোনো (সত্য) মাবুদ (উপাস্য) নেই। আল্লাহ ছাড়া কোনো বস্তু বা সত্তার ইলাহ হওয়ার যোগ্যতা নেই।
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর গুরুত্ব কি? Importance of La Ilaha Illalah
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এর গুরুত্ব “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ” শব্দের প্রতি বিশ্বাস একজনকে ইসলামে প্রবেশ করতে এবং আল্লাহকে (সুবহানা-হু ওয়া তা’আলা) একমাত্র ঈশ্বর ও প্রভু হিসাবে স্বীকার করতে সহায়তা করে। “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” হল ঐশ্বরিক প্রকৃতির প্রতি বিশ্বাস (যাকে “উলূহিয়াহ” বলা হয়), যার অর্থ এই বিশ্বাস করা যে আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) একমাত্র, মানুষের যার জন্য উপাসনা করা উচিত। তাই তাঁকে ছাড়া অন্য কারো উপাসনা করা উচিত নয়।
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ১০০ বার বললে কি হয়? What happens if La Ilaha is pronounced 100 times?
হাদিস থেকে জানা যায় যে, যারা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ 100 বার পাঠ করে তাদের জন্য বলা হয়েছে: আপনি দশটি ক্রীতদাসকে মুক্ত করার সওয়াব পাবেন। দ্বিতীয়ত, তার কৃতিত্বে একশত নেক আমল লিপিবদ্ধ করা হবে; তৃতীয়ত, তার স্ক্রল থেকে তার একশত পাপ মুছে ফেলা হবে; চতুর্থত, সে শয়তান থেকে রক্ষা পাবে। এছাড়াও এই কালেমা পথের আরো অনেক সওয়াব রয়েছে।
শেষ কথা, Conclusion
আল্লাহ হচ্ছেন পরম স্রষ্টা, শুধুমাত্র তার ইচ্ছার মাধ্যমেই ঘটনা ঘটে। মুসলমান হওয়ার অন্যতম শর্ত হল রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রতি বিশ্বাস রাখা। এই ধারণাটি “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ” বলার দ্বারা মূর্ত হয়েছে। ইসলামে কালমিার গুরুত্ব ও মর্যাদা অনেক। কালিমার মূল অবকাঠামো হচ্ছে বিশ্বাস। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “যে ব্যক্তি এমতাবস্থায় মারা যায় যে সে জানে আল্লাহ ছাড়া কোন সঠিক উপাস্য নেই সে জান্নাতে যাবে।”