মাগরিবের নামাজ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম। দৈনিক নামাজগুলোর মধ্যে এটি চতুর্থ। সূর্যাস্তের পর এই নামাজ আদায় করা হয়। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা মাগরিবের নামাজের সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
মাগরিব অর্থ কি? Meaning of Maghrib
সহজ সংজ্ঞায়, আরবি শব্দ মাগরিব মানে সূর্যাস্ত। শব্দের মূল হল ঘরাবা ক্রিয়াপদ, যা তিনটি আরবি অক্ষর, গাইন, রাহ এবং বাহ দিয়ে তৈরি। এর অর্থ দূরে থাকা বা অদৃশ্য হওয়া ।
মাগরিবের নামাজ, Maghrib Namaz
মাগরিবের নামাজ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মধ্যে চতুর্থ। এটি আসরের নামাজের পর ও এশার নামাজের আগে আদায় করতে হয়। এটি অন্যান্য ওয়াক্তের নামাজগুলোর চেয়ে বেশি ফজিলতপূর্ণ। আল কোরআন ও হাদিসে সকাল – সন্ধ্যার নামাজকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, আর মাগরিবের নামাজ সন্ধ্যার সময় আদায় করতে হয়। সুতরাং এর গুরুত্ব অনেক।
মাগরিবের নামাজ কেন পড়ি? Why do we recite Maghrib Namaz ?
মাগরিবের সময়টি একটি নতুন দিনের সূচনা চিহ্নিত করতেও ব্যবহৃত হয়। ইসলামিক ক্যালেন্ডারে, দিনগুলি মাগরিব থেকে শুরু হয় এবং মাসগুলি একটি নতুন চাঁদ দেখা দিয়ে শুরু হয়।
মাগরিবের নামাজ রাকআত সংখ্যা, Number of Rakats
- মাগরিব নামাজ মোট সাত রাকাত।
- তিন রাকাত ফরজ,
- দুই রাকাত সুন্নত ও
- দুই রাকাত নফল নিয়ে গঠিত।
- ফরজ অংশ ইমামের নেতৃত্বে জামাতের সাথে আদায় করা হয়। তবে ব্যক্তি মুসাফির অবস্থায় থাকলে শুধুমাত্র তিন রাকাত ফরজ আদায় করতে পারে।
মাগরিবের ফরযের পূর্বে দুই রাকআত নামায আদায় করার হাদিস, The hadith of praying two rak’ahs before the fard of Maghrib
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুগাফ্ফাল (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, যেখানে তিনি বলেন, মহানবী (সঃ) ইরশাদ করেছেন, তোমরা মাগরিবের ফরযের পূর্বে দুই রাকআত নফল নামায আদায় করবে। তোমরা মাগরিবের ফরযের পূর্বে দুই রাকআত নফল নামায আদায় করবে। কিন্তু তৃতীয়বার বললেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে। একথা আমি এ আশংকা করে বললাম, যাতে মানুষ তাকে সুন্নত (সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ) মনে করে ফেলে। (বুখারী ও মুসলিম)।
মাগরিবের নামাজ তিন রাকাত হওয়ার কারন কি? Why does Maghrib Namaz have three Rakats?
দিনের সালাতগুলো মাগরিবের দ্বারা বেজোড় হয়। তাই তিন রাকাত।
মাগরিবের ফরজ নামাজের নিয়ত, The Niyat or intention of Maghrib obligatory prayer
نويت أن أصلى لله تعالى ثلث ركعات صلوة المغرب
فر الله تعالى متوجها الى جهة الكعبة الشريفة الله . أكبر
এর বাংলা উচ্চারণঃ নাওয়াইতু আন উছাল্লিয়া লিল্লাহি তা’আলা ছালাছা রাকআ’তি সালাতিল মাগরিবি ফারদুল্লাহি তা’আলা মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ শারীফাতি আল্লাহু আকবার ।
বাংলা অর্থ : আমি কেবলামুখী হইয়া আল্লাহর জন্য মাগরিবের তিন রাকয়াত ফরজ নামাজ (এই ইমামের পিছনে) আদায় করিবার নিয়ত করিলাম, আল্লাহু আকবার । [জামাআতে ইমাম সাহেবের পিছনে নামায আদায় করা হলে নিয়ত করার সময় ফারদুল্লাহি তাআলার পর বলতে হবে ইকৃতাদাইতু বিহাযাল ইমাম। তারপর বাকী অংশ বলবে।]
সুন্নত নামাজের নিয়ত, Niyat of Sunnat Namaz
“নাওয়াইতু আন্ উসাল্লিয়া লিল্লাহি তা’আলা রাকয়াতাই সালাতিল মাগরিবি সুন্নাতু রাসূলিল্লা-হি তা’আলা মুতাওয়াজ জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারীফাতি আল্লাহু আকবার।”
বাংলা অর্থ: “মাগরিবের দুই রাকাত সুন্নত নামাজ আদায় করার উদ্দেশ্যে ক্বিবলামুখী হয়ে নিয়ত করলাম, আল্লাহু আকবার।”
নফল নামাজের নিয়ত, Niyat of Nafal Namaz
“নাওয়াইতু আন্ উসাল্লিয়া লিল্লাহি তা’আলা রাকয়াতি সালাতিল নফলে মুতাওয়াজ জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারীফাতি আল্লাহু আকবার।”
বাংলা অর্থ: “মাগরিবের দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করার উদ্দেশ্যে ক্বিবলামুখী হয়ে নিয়ত করলাম, আল্লাহু আকবার।”
মাগরিবের নামাজে কি কি সূরা পড়তে হয়? Which surah to read during Maghrib Namaaz?
আসর ও এশার নামাজে সুরা তারিক (৮৬ নম্বর সুরা) থেকে সুরা বায়্যিনাহ (৯৮ নম্বর সুরা) পর্যন্ত সুরাগুলো থেকে তিলাওয়াত করা। মাগরিবের নামাজে সুরা জিলজাল (৯৯ নম্বর সুরা) থেকে সুরা নাস (সর্বশেষ সুরা) পর্যন্ত সুরাগুলো থেকে তিলাওয়াত করা। এটি স্বাভাবিক সময়ের জন্য সুন্নত।
মাগরিবের নামাজ কতটুকু? Maghrib Namaax kototuku?
মাগরিবঃ ৩ রাকাত ফরজ, তারপর ২ রাকাত সুন্নত, তারপর ২ রাকাত নফল । ইশাঃ 4 রাকাত সুন্নত, তারপর 4 রাকাত ফরজ, তারপর 2 রাকাত সুন্নত, তারপর 2 রাকাত নফল, তারপর 3 রাকাত বিতর ওয়াজিব, তারপর 2 রাকাত নফল।
মাগরিবের নামাজের নিয়ম, The rule of Maghrib Namaz
মাগরিবের তিন রাকআত ফরয নামাযের নিয়ত করে অন্যন্য ফরয নামাযের মত প্রথম ও দ্বিতীয় রাকআত পূর্ণ করবে। উভয় রাকআতের ক্ষেত্রেই সূরা ফাতিহার পর অন্য সূরা মিলাতে হবে। দ্বিতীয় রাকআতের দুই সিজদার পর বসে আত্তাহিয়্যাতু পাঠ করে আল্লাহু আকবার বলে তৃতীয় রাকআতের জন্য দাঁড়িয়ে যেতে হবে। দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র সূরা ফাতিহা পাঠ করা হয়, অন্য কোন সূরা পাঠ করা যাবে না। তারপর তৃতীয় রাকআত শেষে বসে আত্তাহিয়্যাতু, দরূদ শরীফ ও দোয়া মাসূরা পাঠ করে ডানে ও বামে সালাম ফিরায়ে নামায শেষ করবে।
মাগরিবের সাথে এশার নামাজ পড়া যাবে কি? Is it possible to read Isha prayer with Maghrib?
যারা বাড়িতে সালাত আদায় করবে তারা ইশার প্রকৃত সময়গুলো পালন করবে যতক্ষণ না এতে কোনো অপ্রয়োজনীয় কষ্ট না হয়। যে ব্যক্তিরা এটিকে অত্যন্ত কঠিন বলে মনে করেন তারা একই মত ব্যবহার করতে পারেন এবং মাগরিবের সাথে ইশার একত্রিত করতে পারেন যখন এটি প্রয়োজন হয় ।
মাগরিবের নামাজের সময়, Maghrib Namaz timings
আল কোরআন ও হাদিসে সকাল – সন্ধ্যার নামাজকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, আর মাগরিবের নামাজ সন্ধ্যার সময় আদায় করতে হয়। সুতরাং এর গুরুত্ব অনেক। সূর্য অস্ত গেলে মাগরিবের নামাজের ওয়াক্ত শুরু হয় ও আকাশে লালিমা থাকা পর্যন্ত এর সময় থাকে। যেহেতু এই সময়কাল খুব তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যায়, তাই এই নামাজ তাড়াতাড়ি আদায় করে নিতে হয়। সেজন্য সূর্য ডোবার সাথে সাথেই মাগরিবের নামাজে দাঁড়িয়ে যাওয়া উচিত।
- সালামা (রা.) হতে বর্ণিত: তিনি বলেন, ‘সূর্য পর্দার আড়ালে ঢাকা পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা নবী (সা.)-এর ইমামতিতে মাগরিবের নামাজ আদায় করতাম।’ (সহীহ বুখারি: ৫৬১)
- নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যায় নামাজ আদায় করতে মসজিদে যায় এবং যতবার যায় আল্লাহ তায়ালা ততবারই তার জন্য জান্নাতের মধ্যে মেহমানদারির উপকরণ প্রস্তুত করেন।’ (সহীহ বুখারি : ৬২২)
দৈনিক পাঁচ ওয়াক্তের নামাজের মধ্যে এ নামাজের তাৎপর্য হাদীস দ্বারাই প্রমাণিত হয়।
মাগরিবের নামাজ কিভাবে পড়তে হবে? How to read Maghrib prayer?
মাগরিবের তিন রাকাত ফরজ নামাজ আদায় করার উদ্দেশে কেবলামুখী হয়ে নিয়ত করলাম, আল্লাহু আকবার। নামাজের নিয়ত করার পর তাকবিরে তাহরিমা বলে নামাজ আদায় শুরু করতে হবে। উক্ত নিয়ত পড়ে জামাতের সহিত নামাজ আদায় করতে পারবেন।
মাগরিবের নামাজের পরের দোয়া, Namaz er porer doya
মাগরিবের নামাজের পর যেসব আমল করা ভালো তা ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হলো:
- মাগরিবের ফরজ নামাজের পর উপরের দিকে তাকিয়ে “আল্লাহু আকবার”বলে তিনবার “আস্তাগফিরুল্লাহ” পড়ে নিচের দোয়াটি পাঠ করা ভালো।
- “আল্লাহুম্মা আনতাস সালামু ওয়া মিনকাস সালাতুত তাবারাকতা ইয়া জালজালালি ওয়াল ইকরাম” সকল ফরজ নামাজের পরই এই আমল করতে হয়। নবী করীম (সা) নিজে এ আমলটি করতেন।
এছাড়াও ফরজ নামাজের পর নিম্নোক্ত দুআ টি পাঠ করা উত্তম।
- “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা-শারিকা লাহু। লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু।ওয়াহুয়া আ’লা কুল্লি শাইয়ীন কাদীর। আল্লাহুম্মা লা-মানিয়া লিমা আতাইতা।ওয়ালা মুতিয়া লিমা মানাতা ওয়ালা ইয়ানফাউজাল জাদ্দী মিনকাল জাদ্দু।”
- প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর আয়াতুল কুরসি পাঠ করা অতি উত্তম। নবী করীম (সা) নিজে এই আমলটি করতেন ও সবাইকে করার আদেশ দিয়েছেন।
মাগরিবের নামাজের ফজিলত, Virtues of Maghrib prayer
মাগরিবের নামাজের ফজিলত সম্পর্কে আল কোরআন ও হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। এই নামাজ মুমিনের কল্যাণ নিশ্চিত করে। এ নিয়ে আল্লাহর রাসূল (সা) বলেন, “আমার উম্মত ততদিন কল্যাণের মধ্যে থাকবে যতদিন তারা মাগরিবের নামাজ আদায়ে তারকা উজ্জ্বল হওয়া পর্যন্ত বিলম্ব না করবে।” (আবু দাউদ : ৪১৮)
আল কোরআনে সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ করার কথা বলা হয়েছে, অর্থাৎ মাগরিবের নামাজের কথা বলা হয়েছে। এ সময়কে বেশি গুরুত্বারোপ করার কারণ হল এ সময়ে প্রকৃতির সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হয় অর্থাৎ দিন ও রাতের পালাবদল ঘটে। হাদিসে বর্ণিত, “যে ব্যক্তি গুরুত্বের সঙ্গে মাগরিবের দুই রাকাত সুন্নত নামাজ আদায় করবে তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করা হবে।” (তিরমিজি :৬৩৬২)
মাগরিবের নামাজ সঠিক নিয়মে আদায়কারী ব্যক্তি আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়। মাগরিবের নামাজ জামাতের সাথে আদায় করা উত্তম।
মুসলমানরা বিশ্বাস করেন যে ফজর ও মাগরিবের নামাজের সময় ফেরেশতাগণ তাদের স্থান পরিবর্তন করেন, আর এ সময়ে তারা বান্দাকে নামাজরত অবস্থায় দেখলে আল্লাহর দরবারে গিয়ে সেই বান্দার ব্যপারে আলোচনা করেন। এ নামাজ আদায়ে বান্দার সকল প্রকার বিপদ-আপদ দূর হয়।
কখন মাগরিবের নামাজ পড়া যাবে না? At what time Maghrib Namaz cannot be read?
অধিকাংশ পণ্ডিত মতামত হানাফী মাযহাবের অনুসরণ করে যে, ইশা শুরু হয় যখন সম্পূর্ণ অন্ধকার আসে এবং আকাশের হলুদ গোধূলি অদৃশ্য হয়ে যায়। মালিকি স্কুলের একটি সংখ্যালঘু মতামত অনুসারে, মাগরিবের নামাজের জন্য নির্ধারিত সময় শেষ হয় যখন আকাশ থেকে লাল সুতো অদৃশ্য হয়ে যায় । এরপর আর এই নামাজ পড়া যাবে না।
পরিশেষে, Conclusion
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মধ্যে মাগরিবের নামাজ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এ নামাজ পড়ার মাধ্যমে একজন মুমিন দুনিয়া ও আখেরাতের সুখ নিশ্চিত করতে পারে। নামাজকে বেহেশতের চাবি বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বেনামাজী ব্যক্তি কখনোই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। সর্বোপরি মাগরিবের নামাজসহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সঠিক নিয়মে আদায় করলে অনেক নেয়ামত লাভ করা যায়।