ঈদুল আযহা বা বকরি-ইদ হল বিশ্বব্যাপী মুসলিম সম্প্রদায়ের দ্বারা পালিত একটি বার্ষিক উৎসব। উৎসবটি ‘ত্যাগের উৎসব’ নামেও পরিচিত। উৎসবটি নবী ইব্রাহিমের তার পুত্রের আত্মত্যাগের স্মরণ করে এবং পবিত্র হজ যাত্রা দ্বারা চিহ্নিত হয়। কোরবানির জন্য সুস্থ ও উপযুক্ত পশু নির্বাচন করা জরুরি। কাজটা সহজ নয়। তবে সাধারণ কিছু বিষয় জানা থাকলে কোরবানির গরু খুব সহজেই বাছাই করা যায়। কি সেই বিষয়গুলো? আজকের এই প্রতিবেদনে তা-ই আলোচনা করবো।
ঈদে কুরবানীর গরুর গুণাগুণ, Qualities of the Qurbani’s cow on Eid :
শুধু গরু নয় বরং কোরবানির যেকোনো পশু সব ধরনের শারীরিক ত্রুটিমুক্ত হতে হবে। গুণগত দিক থেকে সর্বোত্তম হলো-
- পশুটি দেখতে হবে সুন্দর;
- নিখুঁত বা দোষত্রুটি মুক্ত;
- অধিক গোশত সম্পন্ন এবং
- হৃষ্টপুষ্ট হতে হবে।
এক কথায় বলা যায়, পশুটি যেন প্রথম দেখায় পছন্দ হয়ে যায়।
কোরবানির পশু দোষ-ত্রুটিমুক্ত হওয়ার বিষয়ে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশনাও দিয়েছেন। হাদিসে হজরত বারা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের মাঝে দাঁড়ালেন আর আমার হাত তাঁর হাতের চেয়েও ছোট, তারপর বললেন, ৪ ধরনের পশু, যা দিয়ে কোরবানি করে তা জায়েজ হবে না। তাহলো-
- ১. অন্ধ : যে গরু চোখে দেখতে পায় তা স্পষ্ট।
- ২. রোগাগ্রস্ত : রোগ-বালাইয়ে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট।
- ৩. পঙ্গু : যে পশু হাটাচলা করতে পারে না। এবং
- ৪. আহত : যার কোনো অঙ্গ ভেঙে গেছে তা স্পষ্ট।”
হাদিসের অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, আহত গরু বা অন্য পশু দ্বারা কোরবানি করলে ব্যক্তির কোরবানি পরিপূর্ণ হবে না। তাই পশু কেনার সময় উল্লেখিত বিষয়গুলো খেয়াল করতে হবে।
আরেকটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে, কোরবানির সময় গরু বা মহিষের বয়স ২ বছর হতে হবে। তবে
একান্তই যদি উল্লেখিত বয়সের কোনো গরু পাওয়া না যায়; তখন সে ক্ষেত্রে আরো কম বয়সী পশু দ্বারা কোরবানি করতে পারেন। হাদিসে হজরত জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা অবশ্যই মুসিন্না (নির্দিষ্ট বয়সের পশু) কোরবানি করবে। তবে তা তোমাদের জন্য দুষ্কর (পাওয়া কষ্টকর) হলে ছয় মাসের মেষশাবক কোরবানি করতে পারবে। (মুসলিম)”
কুরবানীর গরু কী দেখে কিনবেন? How to buy a Qurbani’s cow?
গরুর বয়স দুই বছর হলে এটা কোরবানির জন্য উপযুক্ত হবে। তবে অনেক সময় গরু দেখে বয়স যাচাই করা যায় না। তাই গরুর বয়স জানার সবচাইতে ভালো উপায় হল তার দাঁত পর্যবেক্ষণ করা। সাধারণত গরুর দাঁতের সংখ্যা এবং দাঁতের ক্ষয়ের পরিমাণ দেখে তার বয়স নির্ণয় করা যায়। আমাদের যেমন দুধ দাঁত রয়েছে তেমন অস্থায়ী দাঁত গরুরও রয়েছে। একটা পূর্ণবয়স্ক গরুর মুখের ভেতরে ৩২ টা দাঁত থাকে। তাদের নিচের পাটিতে সামনের দাঁত বা কর্তন দন্ত থাকে ৮ টা।
গরুর জন্ম থেকে শুরু করে এক মাস বয়সের মধ্যে অস্থায়ী দাঁত উঠতে শুরু হয়। নিচের পাটির সামনের আটটা অস্থায়ী দাঁত এক মাসের মধ্যে উঠে যায়। এরপর এক বছর বয়সে সামনের দুটো অস্থায়ী দাঁত পড়ে যায়। সেই স্থানে স্থায়ী দুটো দাঁত গজায়, যেগুলো আকারে একটু বড়।
ওষুধ ও রাসায়নিকের প্রভাবে মোটা হওয়া গরুগুলো অতিরিক্ত ওজন হওয়ার কারণে স্বাভাবিক নাড়াচাড়া করতে পারেনা। এরা ক্লান্ত থাকবে এবং বেশিরভাগ সময় ঝিমোবে। অন্যদিকে সুস্থ গরুর ক্ষেত্রে চটপটে গতিবিধি থাকে। তাই ঝিমাতে থাকা গরু সুস্থ নাকি অসুস্থ সেটা যাচাই করা জরুরী।
এছাড়াও কিছু গরু বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তাই গরুর শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চাইতে বেশি কিনা! চামড়ায় কাটা ক্ষত আছে কি না! এসব দেখে নিতে হবে। পাশাপাশি দেখতে হবে যে, গরুর কান কাটা, শিং ভাঙা, লেজ কাটা, খুরের মধ্যে ক্ষত বা জিহ্বায় ঘা আছে কি না। কিছু গরু কৃমিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে, তখন তারা বিবর্ণ ও হাড় জিরজিরে হয়। সেই ব্যাপারেও লক্ষ্য রাখতে হবে।
কুরবানী গরু কেনার ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু সতর্কতা, Points to be considered before buying cow for Qurbani :
কোরবানির গরুর কিনতে যেসব বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে, সেগুলি হল :
- গাভি বা বকনা গরু না কেনাই ভালো। নিতান্তই কিনতে হলে পশুটি গর্ভবতী কি না সেটা যাচাই করে নেবেন। গর্ভবতী পশু কোরবানি হয় না।
- গরুর মুখের সামনে খাবার ধরলে সে যদি জিহ্বা দিয়ে সেই খাবার টেনে নেয় এবং তার নাকের ওপরটা ভেজা ভেজা থাকে তাহলে বুঝতে হবে গরু সুস্থ আছে।
- গরুর কুঁজ মোটা টানটান হলে গরু সতেজ, সুস্থ হয়।
- সুস্থ গরুর চামড়ার ওপর দিয়ে কয়েকটা পাঁজরের হাড় বোঝা যাবে।
অতিরিক্ত স্টেরয়েড দেয়া গরুর মুখ থেকে প্রতিনিয়ত লালা ঝরবে। কিছু খেতে চাইবে না। অসুস্থ গরুর নাক থাকে শুকনো।
কুরবানীর গরু কিভাবে জবাই করতে হয়? How to slaughter the Qurbani’s cow?
ছুরি চালানোর সময় পশুর গলার মূল তিনটি অঙ্গ কেটে দিতে হয়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে খাদ্যনালি, দ্বিতীয়টি শ্বাসনালি, তৃতীয়টি হচ্ছে শ্বাসনালির দুই পাশে দুটি রগ রয়েছে সে দুটি। যদি ঠিকমতো এই অঙ্গগুলো কেটে দেয়া যায়, তাহলে গরু দশ থেকে পনেরো মিনিটের মধ্যেই নিস্তেজ হয়ে পড়বে। এভাবে জবাই করা সুন্নত।
ঈদে গরু বা অন্য পশু জবাই করার দোয়া, Prayer for slaughtering cows or other animals on Eid :
- ১. কুরবানির পশু জবাই করার জন্য দোয়া পড়তে হয়। দোয়াটি হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে। দোয়াটি হলো-
اَللَّهُمَّ إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ عَلَى مِلَّةِ اِبْرَاهِيْمَ حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ – إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ – لَا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَٰلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ – بِسْمِ اللهِ اَللهُ اِكِبَر – اَللَّهُمَّ مِنْكَ وَ لَكَ
উচ্চারণ-
ইন্নি ওয়াঝঝাহতু ওয়াঝহিয়া লিল্লাজি ফাতারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা আলা মিল্লাতি ইবরাহিমা হানিফাও ওয়া মা আনা মিনাল মুশরিকিন। ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন। লা শারিকা লাহু ওয়া বি-জালিকা উমিরতু ওয়া আনা মিনাল মুসলিমিন। বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা মিনকা ও লাকা।
- ২. সম্পূর্ন দোয়াটি না পড়তে পারলে, ছোট্ট অংশটুকু পড়বেন-
بِسْمِ اللهِ اَللهُ اِكِبَر – اَللَّهُمَّ مِنْكَ وَ لَكَ
উচ্চারণ :
বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা মিনকা ওয়া লাকা।
- ৩. নিজের পশু নিজে যদি কুরবানি করেন তবে পশু জবাই করার পর এ দোয়া পড়া-
اَللهُمَّ تَقَبَّلْ لَهُ مِنِّى كَمَا تَقَبَّلْتَ مِنْ حَبِيْبِكَ مَحَمّدٍ وَّ خَلِيْلِكِ اِبْرَاهِيْم
উচ্চারণ :
আল্লাহুম্মা তাকাব্বালহু মিন্নি কামা তাকাব্বালতা মিন হাবিবিকা মুহাম্মাদিও ওয়া খালিলিকা ইবরাহিম।
- ৪. অন্য কারো কুরবানি করলে এ দোয়া পড়া-
اَللهُمَّ تَقَبَّلْ لَهُ مِنِكَ-مِنْكُمْ كَمَا تَقَبَّلْتَ مِنْ حَبِيْبِكَ مَحَمّدٍ وَّ خَلِيْلِكِ اِبْرَاهِيْم
উচ্চারণ :
আল্লাহুম্মা তাকাব্বালহু মিনকা-মিনকুম’ কামা তাকাব্বালতা মিন হাবিবিকা মুহাম্মাদিও ওয়া খালিলিকা ইবরাহিম।
শেষ কথা, Conclusion :
ঈদ উপলক্ষ্যে আল্লাহর উদ্দেশ্যে কোরবানির প্রথা মুসলমানদের মধ্যে বছর বছর ধরে চলে আসছে। তবে গরু কোরবানি দেওয়ার ক্ষেত্রে কি কি বিষয় সম্পর্কে সচেতন থাকতে হয় তা হয়তো অনেকেই জানতেন না, আশা করি আজকের এই প্রতিবেদন আপনাদেরকে এবিষয়ে সহায়তা করবে।