মুসলিমরা রমজান মাসকে সবচেয়ে পবিত্র বলে মনে করেন। গোটা বিশ্বেই রমজান মাসে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপবাস পালন করেন। সারা মাস ধরে সারাদিন রোজা পালন করার পর সূর্যাস্তের পর ইফতার ও সূর্যোদয়ের আগে শেহরি পালন করে থাকেন মুসলিমরা। ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন মত অনুসারে মনে করা হয় যে রমজান মাসে সঠিকভাবে পালন করা হলে আল্লাহর কৃপা লাভ করা সম্ভব হয়।
রমজান মাসের সময়কাল, The period of the month of Ramadan
রমজান কথাটি এসেছে ‘রামিদা’ থেকে, এর অর্থ প্রচণ্ড গরম। রমজান মাস প্রায় ২৯ থেকে ৩০ দিন পর্যন্ত চলে। এই সারা মাস জুড়ে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত মুসলমানরা উপবাস বা রোজা রাখেন। ইসলাম অনুসারে, হজরত মহম্মদ যখন কোরআন সৃ্ষ্টি করেন তখন থেকেই রমজান মাস পালিত হয়ে আসছে। প্রথম চাঁদ দেখতে পাওয়ার পর শেষ হবে রমজান মাস এবং পালিত হবে ঈদ।
রমজান মাস চলে ৭২০ ঘণ্টা ধরে, যা হল চার সপ্তাহ দুই দিন। বৃদ্ধ, গর্ভবতী মহিলা এবং গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তি ছাড়া প্রাপ্তবয়স্ক সব মুসলিমেরই রমজান মাসে রোজা বা উপবাস রাখার নিয়ম আছে।
কোরআনে রমজান মাসের উল্লেখ, Mention of the month of Ramadan in the Qur’an
মুসলিমদের ধর্মগ্রন্থ কোরানে রমজান মাসের মাহাত্ম্যের কথা উল্লেখ আছে।
কোরআনের অধ্যায় ২, ১৮৫ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে,
“ রমজান মাস হচ্ছে সেই মাস যে মাসে কুরআন নাজিল হয়েছিল; মানবজাতির জন্য কোরান একটি হেদায়েত এবং হেদায়েতের সুস্পষ্ট প্রমাণ এবং মানদণ্ড। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ বেঁচে থাকে তবে এই মাসে রোজা রাখ এবং আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য স্বাচ্ছন্দ্য চান; তিনি তোমাদের জন্য কষ্ট না চান; আর এটাই যে, তোমার সময়কাল পূর্ণ হবে এবং তোমার হেদায়েতের জন্য আল্লাহকে মহিমান্বিত করতে হবে এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পার।
রমজান মাসের ধর্মীয় অনুশীলনসমূহ, Religious practices of the month of Ramadan
ইসলামের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপবাস করা। রোজার আগের ভোরের খাবারকে বলা হয় সেহরি, অন্যদিকে সূর্যাস্তের পর যে খাবারটি খেয়ে রোজা ভঙ্গ করা হয় তাকে ইফতার বলা হয়।
সিয়াম
সিয়াম (সাওম) ভোরে শুরু হয় এবং সূর্যাস্তের শেষে শেষ হয়। এই সময়ে খাওয়া এবং পান করা থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি, মুসলমানরা যৌন সম্পর্ক এবং পাপী কথাবার্তা এবং আচরণ থেকে বিরত থাকে। রোজার উদ্দেশ্য হল ক্ষতিকারক অশুচি থেকে মুক্ত করে আত্মাকে শুদ্ধ করা।
সেহরি
প্রতিদিন ভোর হওয়ার আগেই মুসলমানরা সেহরি পালন করেন।
ইফতার
সারাদিন রোজা রাখার পর মাগরিবের আজান পরলে আজান শুনে যেই খাবার গ্রহণ করা হয়, তাকে ইফতার বলে। ইফতারের মাধ্যমেই রোজার সমাপ্তি হয়।
তারাবীহর নামাজ
তারাবীহ (আরবি: تَرَاوِيْحِ) শব্দটির একবচন ‘তারবীহাতুন’ (আরবি: تَروِيْحَة) এবং এর আভিধানিক অর্থ হল বসা, বিশ্রাম করা, আরাম করা। ইসলাম ধর্মে তারাবীহ বা কিয়ামুল লাইল হল রাতের সালাত যেটি মুসলিমগণ রমজান মাসব্যপী প্রতি রাতে এশার ফরজ নামাজের পর পড়ে থাকেন।
রমজানের ফজিলত ও গুরুত্ব, Virtues and importance of Ramadan
ইসলামের মৌলিক পাঁচটি স্তম্ভ সম্পর্কে অনেকেই হয়তো শুনেছেন। সেগুলোর মধ্যে রমজান মাসের রোজা রাখা অন্যতম ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত। কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে দ্বিতীয় হিজরিতে আল্লাহ তাআলা উম্মতের উপর রোজা ফরজ করেছেন।
আল্লাহ বলেন, রমজানের রোজা অস্বীকার করলে— সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে। এছাড়াও শরিয়ত সমর্থিত ওজর (অপারগতা) ছাড়া ইচ্ছাকৃত রোজা ভঙ্গকারী— মৌলিক ফরজ লংঘনকারী ও ইসলামের ভিত্তি বিনষ্টকারীরূপে গণ্য।
নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো ওজর বা অসুস্থতা ছাড়া রমজানের একটি রোজা পরিত্যাগ করবে— সে যদি ওই রোজার পরিবর্তে আজীবন রোজা রাখে তবু ওই এক রোজার ক্ষতিপূরণ হবে না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৭২৩)
রোজার গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস (রমজান) পাবে, সে যেন অবশ্যই রোজা রাখে। আর তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অসুস্থ হয় বা সফরে থাকে, তবে অন্য সময় সে সমান সংখ্যা পূরণ করবে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৫)
রমজান মাস : সারা বছরের শ্রেষ্ঠ মাস, Ramadan: The best month of the year
রমজান মাস সম্পর্কে নবীজি (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর কসম! মুসলমানদের জন্য রমজানের চেয়ে উত্তম কোনো মাস আসেনি এবং মুনাফিকদের জন্য রমজান মাসের চেয়ে অধিক ক্ষতির মাসও আর আসেনি। কেননা মুমিনরা এ মাসে (সারা বছরের জন্য) ইবাদতের শক্তি ও পাথেয় সংগ্রহ করে। আর মুনাফিকরা তাতে মানুষের উদাসীনতা ও দোষত্রুটি অন্বেষণ করে। এ মাস মুমিনের জন্য গনিমত আর মুনাফিকের জন্য ক্ষতির কারণ।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৮৩৬৮)
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বনকারী হতে পারো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩)
নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যখন রমজান মাসের প্রথম রাতের আগমন ঘটে, তখন দুষ্ট জিন ও শয়তানদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, তার একটি দরজাও খোলা হয় না এবং জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, তার একটি দরজাও বন্ধ করা হয় না। আর একজন ঘোষক ঘোষণা করতে থাকে— হে কল্যাণের প্রত্যাশী! অগ্রসর হও। হে অকল্যাণের প্রার্থী! থেমে যাও। আল্লাহ তাআলা এ মাসের প্রতি রাতে অসংখ্য জাহান্নামিকে মুক্তি দান করেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৬৮২)
রমজান বরকতময় মাস, প্রসঙ্গত আবু হুরায়রা (রা) বলেন, রমজান মাসের আগমন ঘটার পর নবীজি (সা.) ইরশাদ করলেন, ‘তোমাদের কাছে বরকতময় মাস রমজান এসেছে। আল্লাহ তাআলা তোমাদের ওপর এ মাসের রোজা ফরজ করেছেন…।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৭১৪৮)
রমজানের রোজা বাধ্যতামূলক এবং রোজার বিনিময়ে অনেক বড় পুরস্কারেরও ঘোষণাও দেওয়া আছে। মহানবী (সা.) বলেন, “আল্লাহ্ তাআলা বলেন- ‘রোজা আমারই জন্য। আমি নিজে এর প্রতিদান দেব। আমার বান্দা আমার জন্য পানাহার ছেড়ে দেয়, কামনা-বাসনা ছেড়ে দেয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘রোজাদারের জন্য দু’টি খুশি। একটি খুশি ইফতারের সময়। আরেকটি খুশি আমার সঙ্গে তার সাক্ষাতের সময়। রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশকের সুগন্ধের চেয়েও উত্তম।” (বুখারি, হাদিস : ৭৪৯২)
রমজান মাসে মানুষের প্রত্যেকটি আমল বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়। এই মাসে ক্ষেত্র বিশেষে একটি নেকি ১০ গুণ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘ রোজার ব্যাপারটি ভিন্ন। কারণ, রোজা আমার জন্য। সুতরাং তার প্রতিদান আমি নিজেই প্রদান করব।’ (বুখারি, হাদিস : ১৮৯৪)
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘রমজান মাস লাভকারী ব্যক্তি, যিনি উত্তমরূপে সিয়াম ও কিয়াম পালন করে, তার প্রথম পুরস্কার— রমজান শেষে গুনাহ থেকে ওই দিনের মতো পবিত্র হয়— যেদিন মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ৮৯৬৬)
রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, সে তার (রোজাদারের) অনুরূপ প্রতিদান লাভ করবে। তবে রোজাদারের প্রতিদান থেকে বিন্দুমাত্রও হ্রাস করা হবে না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৮০৭)
রমজান মাসে রোজাদারদের জান্নাতে প্রবেশের ফটক রয়েছে, Ramadan is the gateway to Paradise for those who fast
জান্নাতে একটি ফটক আছে, যার নাম রাইয়্যান। কেয়ামতের দিন রোজাদারগণ ফটক দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে। জান্নাতে প্রবেশ করতে গিয়ে ঘোষণা দেওয়া হবে- ‘রোজাদারগণ কোথায়?’ তখন তারা উঠবে। তারা ছাড়া অন্য কেউ যাবে না। রোজাদারগণ জান্নাতে প্রবেশ করলেই রাইয়্যান ফটক বন্ধ করে দেওয়া হবে। সুতরাং আর কেউ এ ফটক দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (বুখারি, হাদিস : ১৮৯৬; মুসলিম, হাদিস: ১১৫২)। রাইয়ান গেট দিয়ে যে ব্যক্তি প্রবেশ করবে সে কখনো পিপাসার্ত হবে না।
রমজান মাসে দোয়া কবুল ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি, Acceptance of prayers and freedom from hell in the month of Ramadan
রাসুল (সা.) বলেন, ‘অবশ্যই আল্লাহ তাআলা রমজান মাসের প্রত্যেক দিন ও রাতে অসংখ্য ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন। এবং প্রত্যেক মুমিন বান্দার একটি করে দোয়া কবুল করেন।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৭৪৫০)
মুসলমানদের বিশ্বাস অনুযায়ী, রমজানে মাসে অসংখ্য মানুষের দোয়া কবুল করা হয়। রোজাকারীদের আবেদন মঞ্জুর করা হয়। এছাড়াও জাহান্নামির নাম জাহান্নামের তালিকা থেকে মুছে ফেলা হয়, তাই এ মাসে বেশি বেশি নেক আমল করতে হবে। তাওবা-ইস্তিগফার করতে হবে। যাবতীয় দরখাস্ত দয়াময় আল্লাহর দরবারে পেশ করতে হবে। হাদিসে আছে, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া ফেরত দেওয়া হয় না : রোজাদারের দোয়া, ইফতার পর্যন্ত। ন্যায়পরায়ণ শাসকের দোয়া। মজলুমের দোয়া।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৩৪২৮)
রমজান মাসকে ইসলাম ধর্মে গুনাহ থেকে ক্ষমা লাভের মাস। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, এক জুমা থেকে আরেক জুমা এবং এক রমজান থেকে আরেক রমজান মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহগুলো মুছে দেয় যদি সে কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৩৩)
রোজার মাসকে কি বলে? What is the month of fasting?
বিশ্বব্যাপী ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা রোজার মাসকে কোরবানি বা ত্যাগের মাস হিসাবে বিবেচনা করেন। ইসলামী ক্যালান্ডারের নবম মাস রমজান। ১২ মাস থাকলেও এই ক্যালেন্ডারে ৩৫৪ দিন রয়েছে। তাই প্রতি বছর রমজান মাস গ্রেগরীয়ন ক্যালেন্ডারের তুলনায় ১১ দিন এগিয়ে আসে।
রমজান কেন পালন করা হয়? Why is Ramadan celebrated?
মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে ৬১০ খ্রিস্টাব্দে, দেবদূত জিব্রাইল নবী মুহাম্মদের কাছে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং তাঁর কাছে ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ কুরআন অবতীর্ণ করেছিলেন। সেই প্রকাশ, লায়লাত আল কদর – বা “শক্তির রাত” – রমজান মাসে ঘটেছে বলে মনে করা হয়। কুরআন নাযিলের স্মরণে মুসলমানরা সেই মাসে উপবাস করে।
২৪ ঘন্টা রোজা রাখলে কত ক্যালরি খরচ হয়? How many calories are consumed by fasting for 24 hours?
সাধারণভাবে বলতে গেলে, 24 ঘন্টার উপবাসে আপনার শরীর প্রতিদিন প্রায় 0.5 থেকে 1 পাউন্ড চর্বি পোড়াবে, যা প্রায় 2,000 থেকে 4,000 ক্যালোরি পোড়ানোর সমতুল্য। যাইহোক, আপনি সঠিক পরিমাণ ক্যালোরি পোড়াবেন তা আপনার ব্যক্তিগত পরিস্থিতির উপর নির্ভর করবে।
২০২৪ সালের রমজান কত তারিখে? What is the date of Ramadan 2024?
২০২৪ সালে রমজান মাস চলবে ২৯ দিন পর্যন্ত। অর্থাৎ ১১ মার্চ শুরু হলে ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের রমজান পালন করতে হবে ৮ এপ্রিল ২০২৪ পর্যন্ত।
শেষ কথা, Conclusion
রমজান মাস ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র মাস বলে গণ্য হয়। আল্লাহ তাআলা আমাদের রমজানে বেশি থেকে বেশি নেক আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।