পবিত্র রমজান উপলক্ষে মহান আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের আশায় এক মাস সিয়াম সাধনা করেন ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা। সারা মাস ধরে সকল মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা রোজা রাখেন ও রোজা ভেঙে ইফতার করার জন্য দোয়া করেন, যার মাধ্যমে নেকি লাভ করা যায়। রোজার আরবি শব্দ সাওম। এর আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। ইবাদতের নিয়মে সুবহে সাদিক থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ে পানাহার ও কোনো পাপকার্য থেকে বিরত থাকাই সিয়াম সাধনা।
রোজার নিয়ত কী? What is Roza Niyat ?
রমজানের রোজার নিয়ত রাত থেকে করা যায়। বিশেষত ভোররাতে যখন সাহ্রি খাওয়া হয়, তখনই রোজার নিয়ত হয়ে যায়। তখন রোজা রাখার সংকল্প থাকলেই নিয়ত সম্পন্ন হয়ে যাবে। মুখে উচ্চারণের দরকার নেই।
রোজা রাখার নিয়ত, Roza rakhar niyaat
نويت ان اصوم غدا من شهر رمضان المبارك فرضا لك ياالله فتقبل منى انك انت السميع العليم
- উচ্চারণ- নাওয়াইতু আন আছুমা গাদাম মিন শাহরি রমাদ্বানাল মুবারকি ফারদ্বল্লাকা ইয়া আল্লাহু ফাতাক্বব্বাল মিন্নী ইন্নাকা আনতাস সামীউল আলীম।
- এর বাংলা অর্থ হল- হে আল্লাহ! পবিত্র রমজান মাসে তোমার পক্ষ হতে ফরজ করা রোজা রাখার নিয়ত করলাম, তুমি আমার পক্ষ থেকে তা কবুল কর। নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী।
রোজা রাখার পর ইফতারের সময় দোয়া করে খাবার গ্রহণ করা হয়।
রোজার নিয়ত না করলে কি হয়? What happens if Roza Niyaat is not done?
নিয়ত না করলে রোজা হবে না। তবে নিয়ত হলো অন্তরের দৃঢ় সংকল্প। তাই নিয়ত মুখে বলা জরুরি নয়। কেননা রমজান মাসে শেষ রাতে রোজা রাখার উদ্দেশ্যে ঘুম থেকে ওঠা ও সাহরি খাওয়াটাই রোজার নিয়তের অন্তর্ভুক্ত।
না খেয়ে রোজা রাখা যায় কি? Can Roza be conducted without fasting?
অনেকেই জানতে চান আসলে সেহরি না খেলে কী রোজা হবে? এ বিষয়ে হাদিসে বলা হচ্ছে, সেহরি না খেলেও রোজা হবে। রোজা সহিহ হওয়ার জন্য সেহরি খাওয়া আবশ্যক নয় এবং সেহরি খাওয়ার আলাদা কোনো দোয়া নেই। সাধারণত খাবার খাওয়ার আগে যে দোয়া পড়া হয়, সেহরিতেও সেই দোয়া পড়ার নিয়ম।
ইফতারের দোয়া, Iftar’s Dua
اللهم لك صمت و على رزقك افطرتاللهم لك صمت و على رزقك افطرت
- উচ্চারণ- আল্লাহুম্মা লাকা ছুমতু ওয়া তাওয়াক্কালতু আ’লা রিজক্বিকা ওয়া আফতারতু বি রাহমাতিকা ইয়া আর্ হামার রা-হিমীন।
- এর বাংলা অর্থ হল- হে আল্লাহ! আমি তোমারই সন্তুষ্টির জন্য রোজা রেখেছি এবং তোমারই দেয়া রিযিক্ব দ্বারা ইফতার করছি। তারপর “বিসমিল্লাহি ওয়া’আলা বারাকাতিল্লাহ” বলে ইফতার করা।
ইফতারের পরের দোয়া, Dua after Iftar
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল (সা.) যখন ইফতার করতেন, তখন বলতেন-
ذَهَبَ الظَّمَاءُ وَابْتَلَّتِ الْعُرُوْقُ وَ ثَبَتَ الْأَجْرُ اِنْ شَاءَ اللهُ
বাংলা উচ্চারণ : জাহাবাজ জামাউ; ওয়াবতাল্লাতিল উ’রুকু; ওয়া সাবাতাল আজরু ইনশাআল্লাহ।
অর্থ : ‘(ইফতারের মাধ্যমে) পিপাসা দূর হলো, শিরা-উপসিরা সিক্ত হলো এবং যদি আল্লাহ চান সাওয়াবও স্থির হলো।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২৩৫৭)
ইফতারের ফজিলত, Iftar Fazilat
সারা দিন রোজা রাখার পর রোজাদারের জন্য ইফতারের মুহূর্তটা পরম আনন্দের। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দ। একটি আনন্দ হচ্ছে যখন সে ইফতার করে। আরেকটি হচ্ছে যখন সে প্রভুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৭৬৬)
রোজার নিয়ত কখন করবেন? When do you intend to Roza fast?
রোজার নিয়ত করা মুসলমানদের কাছে ফরজ। নিয়ত অর্থ সংকল্প। মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন, মনে মনে এ সংকল্প করে যে, আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে আগামীকালের রোজা রাখছি। তবে ফরজ রোজার নিয়ত রাতেই করা উত্তম। রাতে নিয়ত করতে না পারলে দিনে সূর্য অস্ত যাওয়ার প্রায় এক ঘণ্টা আগে নিয়ত করলেও রোজা করা যাবে।
রোজার নিয়ত কীভাবে করবেন? How is Roza Fast conducted?
পুরো রমজানের জন্য একত্রে নিয়ত করা হয় না, বরং প্রত্যেক রোজার নিয়ত পৃথক পৃথকভাবে সেই দিনই করতে হবে। এর কারণ হল, প্রতিটি রোজা ভিন্ন ভিন্ন আমল (ইবাদত)। তাই প্রতিটি আমলের জন্যই পৃথক নিয়ত করা জরুরি।
রাতে রোজার নিয়ত করলেও সকাল পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী-মিলনের অবকাশ থাকে। এতে নিয়তের কোনো ক্ষতি হবে না। রোজার নিয়ত করার সময় শুরু হয় পূর্বের দিনের সূর্যাস্তের পর থেকে; অর্থাৎ, আপনি যদি মঙ্গলবারের রোজার নিয়ত করেন তবে এর সময় শুরু হবে সোমবার দিবাগত রাত তথা সূর্যাস্তের পর থেকে। সোমবার সূর্যাস্তের পূর্বে মঙ্গলবারের রোজার নিয়ত করা যাবে না; কেননা, হাদিস শরিফে রাতে নিয়ত করার কথা বলা হয়েছে।
রোজার প্রকারভেদ, different types of Roza
রোজা মূলত পাঁচ প্রকার হয়, সেগুলি হল :
১) ফরজ রোজা:
এই প্রকার রোজা চার প্রকার-
রমজান মাসের রোজা।
কোন কারণ বশত রমজানের রোজা ভঙ্গ হয়ে গেলে তার কাযা আদায়ে রোজা।
শরীয়তে স্বীকৃত কারণ ব্যতীত রমজানের রোজা ছেড়ে দিলে কাফ্ফারা হিসেবে ৬০টি রোজা রাখা।
রোজার মান্নত করলে তা আদায় করা।
২) সুন্নত রোজা:
মহরম মাসের নয় এবং দশ তারিখে রোজা রাখা।
৩) মুস্তাহাব রোজা:
প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪, এবং ১৫ তারিখে, প্রতি সপ্তাহের সোম ও বৃহস্পতিবারে, কোন কোন ইমামের মতে শাওয়াল মাসে পৃথক পৃথক প্রতি সপ্তাহে দুটো করে ছয়টি রোজা রাখা হল মোস্তাহাব। তবে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতে এক সাথে হোক কিংবা পৃথক হোক শাওয়ালের ছয়টি রোজা মুস্তাহাব।
৪) নফল রোজা:
মোস্তাহাব আর নফল প্রায় একই ধরনের ইবাদত। সহজ অর্থে নফল হলো যা ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত নয় এমন কোনো ইবাদত পুন্যের নিয়ত নিয়ে করা। রোজার ক্ষেত্রেও তাই।
৫) ওয়াজিব রোজা:
নফল রোজা রেখে কোনো কারণে তা ভঙ্গ করলে পরবর্তীতে রোজা আদায় করা হল ওয়াজিব।
রোজা ভঙ্গ হলে করনীয়, What is to be done if the fast is broken
রোজা ঢালের মতো কাজ করে, যা গোনাহের হাত থেকে ব্যক্তিকে বাঁচায়। অকারণে রোজা ভঙ্গ করলে অবশ্যই কাজা-কাফফারা উভয়ই আদায় করা ওয়াজিব। যতগুলো রোজা ভঙ্গ হবে, ততটি রোজা পুনরায় আদায় করতে হবে। কাজা রোজা রাখার ক্ষেত্রে একটির পরিবর্তে একটি অর্থাৎ একটি রোজার কাজা হিসেবে শুধু একটি রোজাই যথেষ্ট।
অন্যদিকে কাফফারা আদায় করার তিনটি বিধান রয়েছে। একটি রোজা ভঙ্গ করার জন্য একাধারে ৬০টি রোজা রাখতে হয়। কাফফারা ধারাবাহিকভাবে ৬০টি রোজার মাঝে কোনো কারণে যদি একটি রোজা ভঙ্গ হয় তাহলে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। আবার কারও ক্ষেত্রে যদি ৬০টি রোজা পালন সম্ভব না হয় তবে তাকে ৬০ জন মিসকিনকে দুই বেলা খাওয়াতে হবে।
কারও অসুস্থতাজনিত কারণে যদি রোজা রাখার ক্ষমতা না থাকে তাহলে ৬০ জন ফকির, মিসকিন, গরিব বা অসহায়কে প্রতিদিন দুই বেলা করে পেটভরে খাওয়াতে হবে। এছাড়াও গোলাম বা দাসীকে আজাদ করে দিতে হবে।
রোজা রাখার উদ্দেশ্য, Purpose of fasting( Roza)
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে রোজা রাখার মূল উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা, পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা এবং নিজেদের কামনা-বাসনা নিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পরহেজগারি বা তাকওয়া বৃদ্ধি করা। রোজা নিয়ে কুরআনে বলা হয়েছে,
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো”।
— সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৩
এছাড়া আরও বলা হয়েছে যে,
“রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্লাহ তোমাদের সহজ চান এবং কঠিন চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা শোকর কর।”
— সূরা বাকারা: ১৮৫
রোজার ফযিলত, Roza Fazilat
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “ঈমানের সাথে ছাওয়াবের আশায় যে ব্যক্তি রোযা পালন করে তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “আল্লাহর মর্জি হলে আদম সন্তানের প্রতিটি সৎকাজের প্রতিদান দশ গুণ থেকে সাত শত গুণ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। আল্লাহ্ বলেনঃ তবে রোযা ব্যতীত, তা আমার জন্যই (রাখা হয়) এবং আমিই তার প্রতিদান দিবো। সে তার প্রবৃত্তি ও পানাহার আমার জন্যই ত্যাগ করে।”
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “সিয়াম এবং কুরআন বান্দার জন্য শাফা‘আত করবে। সিয়াম বলবে, হে রব! আমি তাকে দিনে খাবার গ্রহণ করতে ও প্রবৃত্তির তাড়না মিটাতে বাধা দিয়েছি। অতএব তার ব্যাপারে এখন আমার শাফা‘আত কবূল করো। কুরআন বলবে, হে রব! আমি তাকে রাতে ঘুম থেকে বিরত রেখেছি। অতএব তার ব্যাপারে এখন আমার সুপারিশ গ্রহণ করো। অতঃপর উভয়ের সুপারিশই কবূল করা হবে।”
শেষ কথা, Conclusion
উপরের আলোচনা থেকে আপনারা জানতে পারলেন যে, ভোরের সূক্ষ আলো থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার,পাপাচার, কামাচার এবং সেই সাথে যাবতীয় ভোগ-বিলাস থেকেও বিরত থাকার নাম রোজা। অনেকেই হয়তো এবিষয়ে অজ্ঞাত ছিলেন, আশা করি প্রতিবেদনটি তাদের রোজা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করেছে।