কোরআনে কিছু দোয়ার বর্ণনা আছে যেগুলো পড়ে আল্লাহর নিকট মাফ চাওয়া যায়, সেই সব দোয়ার মধ্যেই একটি দোয়া হল সাইয়েদুল ইস্তেগফার। ইস্তিগফার এর মানে হল আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা।
আল্লাহর দরবারে ভুলের জন্য নতিস্বীকার করা। ভুল-ত্রুটি ও অন্যায়-অপরাধগুলো ক্ষমা করতে আল্লাহর কাছে কাকুতি-মিনতি করা।
আস্তাগফিরুল্লাহর অর্থ ‘আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই।’ আল্লাহ মহান। দয়াশীল। অনুগ্রহশীল। করুণাময়। তার দয়ার কোনো সীমা নেই। তিনি দয়াবান, অতি দয়ালু এবং পরম ক্ষমাশীল।
তিনি ভুলত্রুটি, পাপতাপ যাবতীয় অপরাধ ক্ষমা করেন। বান্দা ইস্তিগফার করলে আল্লাহ ক্ষমা করেন। বান্দা ডাকলে আল্লাহ সাড়া দেন। দয়া ও করুণা বর্ষণ করেন। বান্দা যখন আল্লাহর দ্বারস্থ হয়, তখন তিনি ক্ষমা ও দয়ার কুদরতি হাত প্রসারিত করেন।
ইস্তিগফার কি কি?
“ইস্তিগফার” মানে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা যাতে তিনি প্রার্থনাকারীকে দুনিয়া ও আখিরাতে পার্থিব কামনা-বাসনা থেকে রক্ষা করেন। আস্তাগফিরুল্লাহ আক্ষরিক অর্থে “আমি ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চাই”।
ইস্তেগফার সম্পর্কে কুরআন কি বলে?
[কোরআন, 71:12] আমরা যা চাই তা আল্লাহ আমাদের শুধু দেবেন না, তিনি আমাদের আরও দেবেন । উদ্যান এবং নদী হল বিলাসিতা যা আমাদের মধ্যে খুব কম লোকই জীবনে বহন করতে পারে। এবং তবুও ইস্তিগফারের জন্য, আল্লাহ আমাদের সেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি আমাদের প্রতিশ্রুতি দেন যে আমাদের বাগান এবং নদী দেওয়া হবে।
সাইয়েদুল ইস্তেগফার হাদীস, Sayedul Istegfar Hadis
সাইয়েদুল ইস্তেগফার হলো একটি সহীহ হাদিস, হাদিসটি হচ্ছে বুখারী শরীফের ৬৩০৬ ও ৬৩২৩ নাম্বার হাদিস। একে সহীহ হাদিস বলার কারণ হলো, এই হাদিস নিয়ে কোন দ্বিধা দ্বন্দ্বের সুযোগ নাই, এই হাদিস মেশকাত শরীফেও এসেছে, হাদিস নাম্বার ২৩৩৫ ‘দো‘আ সমূহ’ অধ্যায়-৯, ‘ইস্তিগফার ও তওবা’ অনুচ্ছেদ-৪।
সাইয়েদুল ইস্তেগফার এর ফজিলত , Fazilat of Istighfar
কোরআনে কারিমে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আমি অবশ্যই ক্ষমাশীল তার প্রতি, যে তাওবা করে, ঈমান আনে, সৎকর্ম করে ও সৎপথে অবিচল থাকে।’ (সুরা: ত্বহা, আয়াত ৮২) অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মন্দ কাজ করে ফেলে বা নিজের প্রতি জুলুম করে বসে, তারপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়, সে অবশ্যই আল্লাহকে অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালুই পাবে।’ (সুরা: নিসা, আয়াত ১১০)
ইস্তিগফারের মাধ্যমে হতাশা ও দুশ্চিন্তা দূর হয়, Despair and anxiety are removed through Istighfar
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের কোনো গুনাহ ছিল না। তিনি ছিলেন নিষ্পাপ। এরপরও তিনি ইস্তেগফার পাঠ করতেন। আল্লাহর কাছে দিনে-রাতে প্রচুর পরিমাণ কেঁদে কেঁদে দোয়া করতেন। হতাশা, মানসিক কষ্ট, মন খারাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এই দোয়ার ফলে। যাদের বিয়ে হচ্ছে না, বা যাদের সন্তান হচ্ছে না তারা এই দোয়া বেশি বেশি পড়তে পারেন। যাদের অভাব অনটন লেগেই আছে তারা বেশি বেশি এই দোয়া পাঠ করবেন।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, যদি কেউ বেশি বেশি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়, আল্লাহ তাআলা তাকে সকল প্রকার দুর্দশা থেকে মুক্তি দান করেন, হতাশা ও দুশ্চিন্তা থেকে পরিত্রাণ দান করেন। তাকে এমন উৎস থেকে রিজিক দান করেন, যা সে কল্পনাও করতে পারে না। (আবু দাউদ)
অন্য এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি তার পাপাচারের জন্য ইস্তিগফারের মাধ্যমে নিয়মিত আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা চাইবে, আল্লাহ তাআলা তার দারিদ্র্য ঘুচিয়ে দেবেন। তাকে সব বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করে সচ্ছলতা ও নিরাপত্তা দান করবেন। সে আল্লাহর রহমতে এমন উৎস থেকে রিজিকপ্রাপ্ত হবে, যা সে চিন্তাও করেনি।
হাদিসে হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামকে বলতে শুনেছি, ‘আল্লাহর কসম! আমি প্রত্যহ আল্লাহর কাছে ৭০ বারেরও বেশি ইস্তেগফার ও তাওবা করে থাকি।’ (বুখারি, হাদিস ৬৩০৭)
সাইয়েদুল ইস্তিগফারের উচ্চারণ, সাইয়েদুল ইস্তেগফার আরবি, Pronunciation of Syedul Istighfar
সাইয়েদুল ইস্তেগফার, ক্ষমা প্রার্থনার শ্রেষ্ঠ দোয়া। মানবজাতি চলার পথে নানা রকম ভুল পাপাচারে লিপ্ত হয়। মানুষ প্রতিদিন জেনে না জেনে অসংখ্য গুনাহ বা পাপ কাজ করে ফেলে, কেউ কেউ আবার জেনে শুনেও গুনাহ করছে, আবার কেউ না জানার ফলে এসব গুনাহ করে হতাশায় ভুগছে। কিন্তু মহান আল্লাহ তাআলা এই সব পাপ ও ভুলগুলোকে ক্ষমা করার জন্য বিভিন্ন দোয়া ক্ষমা প্রার্থনার নিয়ম শিখিয়ে দিয়েছেন। সাইয়েদুল ইস্তেগফার হল আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সবচেয়ে উত্তম একটি দোয়া।
اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ وَأَبُوءُ لَكَ بِذَنْبِي فَاغْفِرْ لِي فَإِنَّهُ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْت
সাইয়েদুল ইস্তেগফার বাংলা উচ্চারণ, Bengali Pronunciation of Syedul Istighfar
আল্লাহুম্মা আনতা রব্বি। লা ইলাহা ইল্লা আনতা। খালাকতানি ওয়া আনা আবদুকা। ওয়া আনা আলা আহদিকা। ওয়া ওয়া’দিকা মাসতাতা’তু। আউজু বিকা মিন শাররি মা-সানাআ’তু। আবুয়ু লাকা বিনি’মাতিকা আলাইয়্যা। ওয়া আবুয়ু লাকা বি জাম্বি। ফাগফিরলি। ফা ইন্নাহু লা ইয়াগফিরুজ জুনবা ইল্লা আনতা।
সাইয়েদুল ইস্তেগফার দোয়ার বাংলা অর্থ, Bengali Meaning of Sayedul Istegfar Dua
হে আল্লাহ! আপনি আমার প্রভু, আপনি ছাড়া কোনো ইলাহ বা মাবুদ নেই; আপনিই আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং আমি আপনারই গোলাম, আর আমি আছি আপনার প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকারের ওপর আমার সাধ্যমতো; আমি আপনার কাছে পানাহ ও আশ্রয় চাই আমার অনাসৃষ্টির অকল্যাণ এবং অপকার ও ক্ষতি হতে। আমি স্বীকার করছি আমার প্রতি আপনার সব নিয়ামত, আরও স্বীকার করছি আপনার সমীপে আমার সকল অপরাধ; সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দিন, আর অবশ্যই আপনি ছাড়া ক্ষমা করার আর কেউ নেই (বুখারি ৬৩২৩ ও মুসলিম)।
সাইয়েদুল ইস্তেগফার কখন পড়তে হয়, When to read Syedul Istegfar?
আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার করার নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। যখনই কেউ নিজের করা কোনো পাপের জন্য অনুতপ্ত হবে তখনই আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। তবে সাইয়েদুল ইস্তেগফার সকালে ও রাতে এই দুই সময় পড়া সবচেয়ে উত্তম বলে মনে করেন মুমিনরা। সাধারণত এই দোয়া পড়া হয় সকালের ফজরের নামাজের শেষে এবং বিকালে আসরের নামাজের শেষে।
রাসুল সা. বলেন, ‘সাইয়েদুল ইস্তেগফার সকালে পাঠ করে কেউ যদি দিনে মারা যায় তবে সে জান্নাতি, কেউ যদি রাতে পাঠ করে ওই রাতে মারা যায় তাহলে সে জান্নাতি। এর থেকে বোঝা যায়, সাইয়েদুল ইস্তেগফার সকালে ও রাতে দুবার পাঠ করা উচিত।’
সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ইস্তেগফার কোনটি?
সাইয়িদুল ইসতিগফার বা শ্রেষ্ঠ ক্ষমা প্রার্থনা- লা ইলাহা ইল্লা আনতা।
ইস্তেগফার কতবার পড়তে হয়?
গুনাহ করার পর ইস্তিগফার করা আবশ্যক। এছাড়াও, এটি কেবল দিনে একবার করার পরামর্শ দেওয়া হয় না তবে দিনে অন্তত একবার (একটি বৈঠকে 100 বার) । ইস্তিগফার একটি অবিচ্ছিন্ন প্রার্থনা এবং শুধুমাত্র পাপ করার পরে করা হয় না। অধ্যায় 71 এর নিম্নলিখিত আয়াত থেকে এটি স্পষ্ট।
ইস্তেগফারের নামাজ কি?
নামাজে ইস্তেগফার দুই রাকাত। প্রতি রাকাতে সূরা হামদের পর একবার সূরা কদর পড়বে এবং তারপর ১৫ বার আস্তাগফিরুল্লাহ পড়বে। তারপর রুকুতে যাবেন এবং রুকু পড়ার পর ১০ বার আস্তাগফিরুল্লাহ বলবেন। রুকু থেকে উঠে আবার ১০ বার বলুন।
ইস্তিগফার করলে কি টাকা আসে?
ইস্তিগফার (ক্ষমা চাওয়া)কে সবচেয়ে কার্যকরী আধকারের মধ্যে উল্লেখ করেছেন যা রিযিক বৃদ্ধি করে এবং কষ্ট থেকে রক্ষা করে।
সাইয়েদুল ইস্তেগফার পড়ার নিয়ম
সাইয়েদুল ইস্তেগফার সকাল-সন্ধ্যার দোয়াগুলোর একটি। এটি সকালে একবার এবং সন্ধ্যায় একবার পড়লেই হয়ে যাবে। কিন্তু যদি অনেক বার পড়েন, তাহলে সেটা খুব ভালো। সাইয়েদুল ইস্তেগফারের অনেক ফজিলত রয়েছে। সাইয়েদুল ইস্তেগফার পড়লে আল্লাহ পূর্ববর্তী গুনাহ মাফ করে দেবেন। রাসুল (সা.) এ কথা বলেছেন। তাই, সাইয়েদুল ইস্তেগফার নিয়মিত করা ভালো। অধিক পরিমাণে পড়া ভালো। একটি উত্তম কাজ।
এক হাদিস অনুযায়ী, আমাদের রাসুল (সা.) এক বৈঠকে ৭০ বার করে পড়তেন। এ থেকে বোঝা যায় বেশি বেশি সাইয়েদুল ইস্তেগফার পড়া উত্তম।
সাইয়েদুল ইস্তেগফারের ইতিহাস, History of Syedul Istegfar
সাইয়েদুল ইস্তেগফার এর দোয়া সম্পর্কে বেশ কিছু ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। হাসান বসরী রাহ. এর কাছে একবার এক ব্যক্তি এসে জানালো “ তার ফসলে খরা লেগেছে। তাকে যেনো কোন আমল দিন” হাসান বসরী তাকে বললেন নিয়মিত এস্তেগফার করো।
কিছুক্ষণ পর অন্য এক ব্যক্তি এসে অভিযোগ করলো যে, “আমি অনেক গরীব।
আমাকে কিছু রিজক এর আমল দিন” হাসান রহ. তাকেও বলে দিলন নিয়মিত এস্তেগফার করার জন্য। এমনই অপর একজন ব্যক্তি এসে সন্তান হওয়ার আমল সম্পর্কে জানতে চাইলে তখনও তিনি বললেন যে, “নিয়মিত এস্তেগফার করো।”
এই শুনে সেখানে উপস্থিত ছাত্ররা তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, “হুজুর সবাইকে একই পরামর্শই দিলেন যে?” এই প্রশ্নের উত্তরে বিখ্যাত তাবেয়ী হাসান বসরী রহ.তখন বললেন “আমি নিজের পক্ষ থেকে কিছুই বলি নি।
এটা বরং আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা তার পবিত্র কুরআনে শিখিয়েছে। তারপর তিনি সুরা নুহ এর আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন।” (তাফসীরে কুরতুবী ১৮/৩০৩)
কোরআনের একটি সূরায় নুহ আ. বলেছেন “তোমরা তোমাদের রবের কাছে নিয়মিত এস্তেগফার করো। ( ক্ষমা চাও) নিশ্চয় তিনি অনেক ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের উপরে অজস্র বারিধারা ও রহমত বর্ষণ করবেন।
তিনি তোমাদের ধন-সম্পদ এবং সন্তান-সন্ততি বৃদ্ধির মাধ্যমে তোমাদের সাহায্য করবেন। তোমাদের জন্যে উদ্যান তৈরি করবেন, তোমাদের জন্যে নদীনালা প্রবাহিত করবেন।” (সুরা নূহ- ১০-১২)
এই ঘটনাগুলো থেকে এই শিক্ষা পাওয়া যায় যে, যারা কোনো সমস্যার মধ্যে আছেন, হতাশার মধ্যে আছেন, দুশ্চিন্তায় আছেন, অথবা যেই সমস্যার সম্মুখীন থাকুন, নিয়মিত এস্তেগফারকে ‘লাযেম’ করে নিন।
লাযেম অর্থ, দিনে রাতে যথাসম্ভব এস্তেগফার করা বা নিজের অবিচ্ছেদ্য অংশ বানিয়ে নেওয়া। প্রয়োজনে উঠতে বসতে এস্তেগফার করতে থাকুন। আল্লাহ তায়ালা সকল সমস্যা ও মানসিক কষ্ট দূর করে দেবেন।
শেষ কথা, To conclude
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে জানা যায় যে, মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে কোরআনে বর্ণিত সাইয়েদুল ইস্তেগফার এর দোয়া পাঠ করে থাকেন। যারা এই দোয়া সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলেন এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে হয়তো ক্ষমা প্রার্থনার দোয়া সম্পর্কে অবগত হতে পেরেছেন।