শবে মেরাজ বা লাইলাতুল মেরাজ ইসলামের ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা। ইসলাম ধর্মমতে লাইলাতুল মেরাজ বা মেরাজের রাত হচ্ছে সেই রাত যে রাতে ইসলামের নবি মুহাম্মদ (সা:) ঐশ্বরিক উপায়ে ঊর্ধ্বাকাশে আরোহণ করেছিলেন এবং স্রষ্টার সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। মুসলমানরা এবাদত-বন্দেগির মধ্য দিয়ে এই রাতটি উদযাপন করে থাকেন। এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল নবুওয়তের ১১তম বছরের ২৭ রজবে। তখন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বয়স ৫১ বছর।
শবে মেরাজ কি ? What is Shab – e – Miraj?
ইসলামের ইতিহাস-অনুযায়ী মুহাম্মাদের (সা:) নবুওয়াতের দশম বৎসরে (৬২১ খ্রিষ্টাব্দ) এক রাতে ইসলামের নবি মুহাম্মাদ ﷺ প্রথমে কাবা শরিফ থেকে জেরুজালেমে অবস্থিত বায়তুল মুকাদ্দাস বা মসজিদুল আকসায় গমন করেন। এটাকে কুরআনের ভাষায় ইসরা বলা হয়। সেখানে তিনি নবিদের জামায়াতে ইমামতি করেন। অতঃপর তিনি বোরাক নামক বিশেষ বাহনে আসীন হয়ে ঊর্ধ্বলোকে গমন করেন। এটাকে মেরাজ বলা হয়। ঊর্ধ্বাকাশে সিদরাতুল মুনতাহায় তিনি আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ করেন। কুরআন শরিফের সুরা বনি ইসরাঈল এর প্রথম আয়াতে মেরাজ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে:
“পবিত্র মহান সে সত্তা, যিনি তার বান্দাকে রাতে নিয়ে গিয়েছেন আল মাসজিদুল হারাম থেকে আল মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার আশপাশে আমি বরকত দিয়েছি, যেন আমি তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি। তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।”
মেরাজ সংঘটিত হবার সময়কাল, What is the timing of Shab – e – Miraj?
মেরাজ কবে এবং কখন সংঘটিত হয়েছিল তা নিয়ে ইসলাম চিন্তাবিদদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। কারো মতে এই ঘটনা হয় হিজরতের ১ বছর আগে, আবার কারো মতে হিজরতের ৫ বছর আগে এই ঘটনা সংঘটিত হয়। এছাড়া কোন মাসে এটি সংঘটিত হয়েছে তা নিয়েও মতানৈক্য রয়েছে। কারো মতে, রবিউল আউয়াল মাসে, আবার কারো মতে এটি রজব মাসে ঘটিত হয়, আবার কেউ মনে করেন রমজান মাসে সংঘটিত হয়।
মেরাজের বিবরণ, Description of Shab – e – Miraj
মেরাজের বিবরণ পবিত্র কোরআনের সুরা নাজমে ও সুরা ইসরায় বর্ণিত। প্রসিদ্ধ হাদিসের গ্রন্থ বুখারি, মুসলিম ও আব দাউদসহ অন্যান্য গ্রন্থে মেরাজের বিষয়টি বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘শপথ নক্ষত্রের যখন তা বিলীন হয়। তোমাদের সাথি (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বিপথগামী হননি এবং বিভ্রান্ত হননি। আর তিনি নিজে থেকে কোনো কথা বলেন না। (বরং তিনি যা বলেন) তা প্রদত্ত ওহি (ভিন্ন অন্য কিছু) নয়। তাকে শিখিয়েছেন মহাশক্তিধর (জিবরাইল আ.)।
সে (জিবরাইল আ.) পাখাবিশিষ্ট, সে স্থিত হয়েছে দূর ঊর্ধ্বে। অতঃপর নিকটবর্তী হলো, পরে নির্দেশ করল। তারপর হলো দুই ধনুকের প্রান্তবর্তী বা আরও নিকট। পুনরায় তিনি ওহি করলেন তার বান্দার প্রতি যা তিনি ওহি করেছেন। ভুল করেনি অন্তর যা দেখেছে। তোমরা কি সন্দেহ করছ তাকে, যা তিনি দেখেছেন সে বিষয়ে।
আর অবশ্যই দেখেছেন তিনি তাকে দ্বিতীয় অবতরণ স্থলে; সিদরাতুল মুনতাহার কাছে; তার নিকটেই জান্নাতুল মাওয়া। যখন ঢেকে গেল সিদরা যা ঢেকেছে; না দৃষ্টিভ্রম হয়েছে আর না তিনি বিভ্রান্ত হয়েছেন; অবশ্যই তিনি দেখেছেন তাঁর রবের বড় বড় নিদর্শনসমূহ।’ (সুরা নাজম ১-১৮)
শবে মেরাজ উপলক্ষ্যে নামাজ, Namaz on account of Shab – e – Miraj
শবে মেরাজ উপলক্ষ্যে ইসলামে কিছু নামাজ ও রোজা প্রসিদ্ধ রয়েছে। বিশেষত মেরাজের রাতে মসজিদে কিছু হাদিস এ রাতের বিশেষ ফজিলত সম্পর্কে শুনানো হয়। তবে শবে মিরাজ উপলক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কোনো নামাজ আল্লাহর রসুলের হাদিসের মাধ্যমে অথবা সাহাবিদের আমলের মাধ্যমে অথবা তাবেয়িদের আমলের মাধ্যমে সাব্যস্ত হয়নি। মেরাজের পরে নবীজি যত বছর বেঁচেছিলেন, তাকেও বিশেষ কোনো আমল করতে দেখা যায়নি।
প্রসঙ্গত, শবে মেরাজ এর ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো আমল, রোজা বা ইবাদত নির্ধারিতভাবে শরীয়তে সাব্যস্ত নেই। তবে মুমিনগণ নিজের পছন্দ অনুযায়ী শবে মেরাজ উপলক্ষ্যে যে কোনো ইবাদত বন্দেগি ও নেক আমল করতে পারেন। এ উপলক্ষ্যে নফল রোজা রাখার কোনো বর্ণনা কোরআন-হাদিসের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই এই দিনে শবে মেরাজ উপলক্ষ্যে রোজা রাখা কোনো ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে না।
ইসরা কথাটির দ্বারা মেরাজের বর্ণনা, Description of Miraj by Isra
শবে মেরাজ রাতের বিশেষ নামাজ সহিহ হাদিসের মাধ্যমে প্রমাণিত নয়। আল্লামা ইববে রজব হাম্ভলি রহ. বলেন, রজব মাসের বিশেষ কোন নামাজ সহিহভাবে প্রমাণিত নয়। (লাতায়িফুল মাআরিফ ১৬৪)। এ রাত আমাদের এটাই শেখায় যে ফরজ বিধান পাঁচ ওয়াক্ত ঠিক মত পড়তে হবে। অনেকে শবে মেরাজের ইবাদত নিয়ে মাতামাতি করেন, কিন্তু ফরজ নামাজই ঠিক মত পড়েন না।
পবিত্র হাদীসের ভাষায় উচ্চারণ শব্দ দ্বারা শবে মেরাজ ঘটনার বর্ণনা করা হয়েছে অপরদিকে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের পরিভাষায় ইসরা শব্দ দ্বারা মেরাজের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। ইসরা শব্দটি ফারসি শব্দ থেকে উৎসারিত। ইসরা এর আভিধানিক অর্থ হলো রাতে নিয়ে যাওয়া অপরদিকে সফরটি রাতের একটি নির্দিষ্ট অংশে ঘটে ছিল, একে ইসরা বলা হয়ে থাকে।
শবে মেরাজ নামাজ কত রাকাত? How many rakats of Shab-e- Miraj Namaz are there?
পবিত্র শবে মেরাজের নামাজের রাকাত সংখ্যা নির্ধারণে মুসলিমদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে যেহেতু পবিত্র শবে বরাতের এবাদত একটি নফল এবাদত তাই আমরা চাইলে নফল নামাজ আদায় করতে পারি। প্রতি দুই রাকাত করে করে এই নামাজ আদায় করা যেতে পারে। তবে অনেকেই চার রাকাত করেও এই নামাজ আদায় করে থাকেন।
শবে মেরাজের নামাজের নিয়ত, Niyat of Shab-e-Miraj
শবে মেরাজের নামাজের জন্য আরবি অথবা বাংলা ভাষাতেই নিয়ত করতে পারবেন।
আরবিতে:
نَوَيْتُ أَنْ أُصَلِّيَ لِلَّهِ تَعَالَى رَكْعَاتَيْ صَلَاةِ لَيْلَةِ الْمِعْرَاجِ مُتَوَجِّهًا إِلَى الْكَعْبَةِ الشَّرِيفَةِ تَقَرُّبًا إِلَيْهِ تَعَالَى
বাংলায়:
আমি আল্লাহ তা’আলার জন্য দুই রাকাত শবে মেরাজের নামাজ আদায় করার নিয়ত করলাম, কেবলা মুখী হয়ে, আল্লাহ তা’আলার নিকটবর্তী হওয়ার জন্য।
মেরাজের কথা কি কোরআনে আছে? Is there anything in the Qur’an about Miraj?
কুরআনের মধ্যে, অধ্যায় (সূরা) 17 আল-ইসরা, ইসরা’র নামে নামকরণ করা হয়েছে এবং প্রথম আয়াতে একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ রয়েছে। পরবর্তী আয়াতেও কিছু তথ্য রয়েছে এবং কিছু পণ্ডিত বলেছেন যে সূরা আন-নাজমের একটি আয়াতে ইসরা এবং মি’রাজ সম্পর্কেও তথ্য রয়েছে ।
শবে মেরাজের রাতে কি করতে হয়? What to do on the night of Shab-e- Miraj?
এ রাতে জাগ্রত থেকে আল্লাহর ইবাদত তথা কুরআন তেলাওয়াত করা, অধিকহারে দরুদ পাঠ করা এবং নফল নামাজ পড়া যেতে পারে, কারণ এ রাতেই মহান আল্লাহ মহানবী (স)-এর মাধ্যমে উম্মতের জন্য নামাজ ফরজ করেন। হাদীস শরীফে ইরশাদ রয়েছে, নবী করীম (স) বলেন, কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম নামাজের হিসেব হবে।
শবে মেরাজ সম্পর্কে ইসলাম কি বলে? What does Islam say about Shab-e- Miraj?
ইসলামে মেরাজের বিশেষ গুরুত্ব আছে, কেননা এই মেরাজের মাধ্যমেই ইসলাম ধর্মের পঞ্চস্তম্ভের দ্বিতীয় স্তম্ভ অর্থাৎ নামাজ মুসলমানদের জন্য অত্যাবশ্যক অর্থাৎ ফরজ নির্ধারণ করা হয় এবং দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের বিধান নির্দিষ্ট করা হয়।
শবে মেরাজ সম্পর্কে ভিন্ন মত, Different opinion about Shab e Miraj
ইসলামে মেরাজের ঘটনা যথেষ্ট অর্থবহ, তবুও মেরাজ উপলক্ষে বিশেষ রাত উৎযাপনের নিয়মকে বেশ কয়েকজন ইসলামী চিন্তাবিদ গ্রহণ করেন না; অধিকাংশ ইসলামিক স্কলার মিরাজ রজনী উপলক্ষে শরীয়ত সম্মত যেকোন ইবাদাত করার ব্যাপারে মত দিয়েছেন এবং উত্তম বলেছেন। কোনো কোনো ইসলামী চিন্তাবিদের মতে, এটা দৈহিক নয়, বরং ছিল আত্মিক আরোহণ; মুহাম্মদের স্ত্রী আয়েশা (রা:)এবং আবু সুফিয়ান (রা:)এই মতে বিশ্বাসী ছিলেন বলে মনে করা হয়।
শেষ কথা, To conclude
ধারাবাহিক ইবাদত আল্লাহর কাছে বেশি পছন্দের। নিয়মিত নামাজ আদায়, আল্লাহর জিকির, তাসবিহ আদায়, গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা, সুদ, ঘুষ, মিথ্যা বলা থেকে বিরত থেকে আমলি জীবন যাপনই আল্লাহ তাআলা বান্দাদের থেকে কামনা করেন।