কিয়ামত সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন-
‘‘কিয়ামতের ব্যাপারটি তো এমন, যেমন চোখের পলক অথবা তার চাইতেও নিকটবর্তী। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছুর উপর শক্তিমান।’’
আলামতগুলোর ধারাবাহিকতা কী হবে সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট সহিহ কোন দলীল পাওয়া যায় নি। তবে ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন দলিলকে একত্র করে এগুলোর ধারাবাহিকতা নির্ধারণ করা হয়। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা কেয়ামতের উল্লেখযোগ্য কিছু আলামত সম্পর্কে আলোচনা করবো।
কেয়ামতের উল্লেখযোগ্য কিছু আলামত, Some significant Alamat of Qayamat :
১. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়ত লাভ।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর আগমন হল কিয়ামতের সর্বপ্রথম আলামত। তিনি সর্বশেষ নবী এবং তাঁর পর কিয়ামত পর্যন্ত আর কোন নবীর আগমণ হবেনা। নবী সাল্লাল্লাহু বলেনঃ “ইয়াহইয়া-ইবনু হাবীব মারিসী (রহঃ) আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আমি এবং কিয়ামত এ দুটির মত প্রেরিত হয়েছি। এ কথাটি বর্ণনা করতে গিয়ে শুবা তার শাহাদাত ও মধ্যমা আঙ্গুলিকে এক সাথে মিলালেন।” (সহীহ মুসলিম, হাদিস নম্বরঃ ৭১৩৭)
২. চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হওয়া।
হাফেয ইবনে রজব বলেনঃ ‘‘আল্লাহ তাআলা চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হওয়াকে কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার অন্যতম আলামত হিসাবে নির্ধারণ করেছেন।”
৩. ভন্ড ও মিথ্যুক নবীদের আগমন হবে।
মিথ্যুক নবীদের আগমন অর্থাৎ নবুয়তের মিথ্যা দাবিদারদের আত্মপ্রকাশ।
মুসাইলামাতুল কাযযাব ও আসওয়াদ আনসি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يُبْعَثَ دَجَّالُونَ كَذَّابُونَ قَرِيبٌ مِنْ ثَلَاثِينَ كُلُّهُمْ يَزْعُمُ أَنَّهُ رَسُولُ اللَّهِ
‘‘ত্রিশজন মিথ্যুক আগমণের পূর্বে কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবেনা। তারা সকলেই দাবী করবে যে, সে আল্লাহর রাসূল’’। – বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল মানাকিব।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى تَلْحَقَ قَبَائِلُ مِنْ أُمَّتِي بِالْمُشْرِكِينَ وَحَتَّى يَعْبُدُوا الْأَوْثَانَ وَإِنَّهُ سَيَكُونُ فِي أُمَّتِي ثَلَاثُونَ كَذَّابُونَ كُلُّهُمْ يَزْعُمُ أَنَّهُ نَبِيٌّ وَأَنَا خَاتَمُ النَّبِيِّينَ لَا نَبِيَّ بَعْدِي
‘‘আমার উম্মতের একদল লোক মুশরিকদের সাথে মিলিত হওয়ার পূর্বে এবং মূর্তি পূজায় লিপ্ত হওয়ার পূর্বে কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবেনা। আর আমার উম্মতের মধ্যে ত্রিশজন মিথ্যুকের আগমণ ঘটবে। তারা সকলেই নবুওয়াতের দাবী করবে। অথচ আমি সর্বশেষ নবী। আমার পর কিয়ামতের পূর্বে আর কোন নবী আসবেনা’’।
৪. প্রচুর ধন-সম্পদ বৃদ্ধি এবং যাকাত খাওয়ার লোক না-থাকা।
কিয়ামতের অন্যতম একটি আলামত হল মানুষের ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পাওয়া। তখন ফকীর-মিসকীন খুঁজে পাওয়া যাবেনা। সাদকা ও যাকাতের জন্য কোন লোক পাওয়া যাবেনা।
নবী সাল্লাল্লাহু বলেনঃ
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يَكْثُرَ فِيكُمُ الْمَالُ فَيَفِيضَ حَتَّى يُهِمَّ رَبَّ الْمَالِ مَنْ يَقْبَلُ صَدَقَتَهُ وَحَتَّى يَعْرِضَهُ فَيَقُولَ الَّذِي يَعْرِضُهُ عَلَيْهِ لَا أَرَبَ لِي
‘‘ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবেনা যতক্ষণ না মানুষের ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পাবে। মানুষ যাকাতের মাল নিয়ে সংকটে পড়বে। যাকাতের মাল মানুষের কাছে পেশ করা হলে সে বলবেঃ এতে আমার কোন প্রয়োজন নেই’’। –
ইয়াকূব ইবনে সুফিয়ান বলেনঃ
‘‘উমার ইবনে আব্দুল আযীযের শাসন আমলে লোকেরা প্রচুর সম্পদ নিয়ে আমাদের কাছে আগমণ করতো। তারা আমাদেরকে বলতঃ তোমরা যেখানে প্রয়োজন মনে কর সেখানে এগুলো বিতরণ করে দাও। গ্রহণ করার মত লোক না পাওয়া যাওয়ার কারণে তাদের কাছ থেকে কেউ মাল গ্রহণ করতে রাজী হতোনা। পরিশেষে মাল ফেরত নিতে বাধ্য হত। মোট কথা তাঁর শাসন আমলে যাকাত নেয়ার মত লোক ছিলনা’’। – ফাতহুল বারী, (১৩/৮৩)
৫. কিয়ামতের পূর্বে বহু ফিতনার আবির্ভাব হবে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি বলেনঃ
إِنَّ بَيْنَ يَدَيِ السَّاعَةِ فِتَنًا كَأَنَّهَا قِطَعُ اللَّيْلِ الْمُظْلِمِ يُصْبِحُ الرَّجُلُ فِيهَا مُؤْمِنًا وَيُمْسِي كَافِرًا وَيَبِيعُ فِيهَا أَقْوَامٌ خَلَاقَهُمْ بِعَرَضٍ مِنَ الدُّنْيَا
‘‘নিশ্চয়ই কিয়ামতের পূর্বে অন্ধকার রাত্রির মত ঘন কালো অনেক ফিতনার আবির্ভাব হবে। সকালে একজন লোক মুমিন অবস্থায় ঘুম থেকে জাগ্রত হবে। বিকালে সে কাফেরে পরিণত হবে। বহু সংখ্যক লোক ফিতনায় পড়ে দুনিয়ার সামান্য স্বার্থের বিনিময়ে তাদের চরিত্র ও আদর্শ বিক্রি করে দিবে।”
৬. মিথ্যা বলার প্রচলন বৃদ্ধি পাবে।
কিয়ামতের পূর্বে ব্যাপকভাবে মিথ্যা কথা বলার প্রচলন ঘটবে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
‘‘আখেরী যামানায় আমার উম্মাতের কিছু লোক তোমাদের কাছে এমন কথা বর্ণনা করবে, যা তোমরাও শুননি এবং তোমাদের বাপ-দাদারাও শুনেনি। তোমরা তাদের থেকে সাবধান থাকবে। তারা যেন তোমাদেরকে বিভ্রান্ত করতে না পারে’’।
৭. সুন্নাতী আমল নিয়ে গাফিলতী করবে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘‘কিয়ামতের আলামত হচ্ছে লোকেরা মসজিদের ভিতরে প্রবেশ করবে কিন্তু তাতে দু’রাকাত নামায পড়বেনা।”
৮. মসজিদ নিয়ে মানুষ গর্ব করবে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يَتَبَاهَى النَّاسُ فِي الْمَسَاجِدِ
‘‘যত দিন লোকেরা মসজিদ নিয়ে গর্ব না করবে ততদিন কিয়ামত হবেনা।’’
ইমাম বুখারী (রঃ) আনাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করে বলেনঃ
‘‘লোকেরা মসজিদ নিয়ে গর্ব করবে, কিন্তু ইবাদতের মাধ্যমে তা আবাদ করবেনা।’’
৯. দ্বীনী ইলম উঠে গিয়ে মূর্খতা বিস্তার লাভ করবে।
কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে দ্বীনী ইলমের শিক্ষা ও চর্চা কমে যাবে। এর পাশাপাশি মানুষের মাঝে দ্বীনী বিষয়ে মূর্খতা ব্যাপকভাবে বিরাজ করবে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
إِنَّ مِنْ أَشْرَاطِ السَّاعَةِ أَنْ يُرْفَعَ الْعِلْمُ وَيَثْبُتَ الْجَهْلُ
‘‘কিয়ামতের অন্যতম আলামত হচ্ছে ইলম উঠিয়ে নেয়া হবে এবং মানুষের মাঝে অজ্ঞতা বিস্তার লাভ করবে।’’
তিনি আরো বলেনঃ
إِنَّ اللَّهَ لَا يَقْبِضُ الْعِلْمَ انْتِزَاعًا يَنْتَزِعُهُ مِنَ الْعِبَادِ وَلَكِنْ يَقْبِضُ الْعِلْمَ بِقَبْضِ الْعُلَمَاءِ حَتَّى إِذَا لَمْ يُبْقِ عَالِمًا اتَّخَذَ النَّاسُ رُءُوسًا جُهَّالًا فَسُئِلُوا فَأَفْتَوْا بِغَيْرِ عِلْمٍ فَضَلُّوا وَأَضَلُّوا
‘‘আল্লাহ তাআলা মানুষের অন্তর থেকে ইল্মকে টেনে বের করে নিবেন না; বরং আলেমদের মৃত্যুর মাধ্যমে ইল্ম উঠিয়ে নিবেন। এমনকি যখন কোন আলেম অবশিষ্ট থাকবেনা তখন লোকেরা মূর্খদেরকে নেতা হিসাবে গ্রহণ করবে। তাদেরকে কোন মাসআলা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে বিনা ইলমেই ফতোয়া দিবে। ফলে তারা নিজেরা গোমরাহ হবে এবং মানুষদেরকেও গোমরাহ করবে’’।
১০. বেপর্দা নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘‘কিয়ামতের আলামত হচ্ছে মহিলাদের জন্য এমন পোষাক আবিস্কার হবে যা পরিধান করার পরও মহিলাদেরকে উলঙ্গ মনে হবে।’’
অর্থাৎ নারীদের পোষাকগুলো এতটাই সংকীর্ণ ও আঁট-সাট হয়ে যাবে যে, তা পরিধান করলেও তাদের শরীরের গঠন ও সৌন্দর্যের স্থানগুলো বাইরে থেকে সুস্পষ্ট বুঝা যাবে।
১১. ব্যভিচার বৃদ্ধি পাবে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
إِنَّ مِنْ أَشْرَاطِ السَّاعَةِ أَنْ يُرْفَعَ الْعِلْمُ وَيَثْبُتَ الْجَهْلُ وَيُشْرَبَ الْخَمْرُ وَيَظْهَرَ الزِّنَا
‘‘নিশ্চয়ই কিয়ামতের অন্যতম আলামত হচ্ছে ইল্ম উঠিয়ে নেয়া হবে এবং মানুষের মাঝে অজ্ঞতা বিস্তার লাভ করবে, মদ্যপান ছড়িয়ে পড়বে এবং মুসলমানেরা ব্যভিচারে লিপ্ত হবে।’’
১২. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা হবে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
وَلَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يَظْهَرَ الْفُحْشُ وَقَطِيعَةُ الرَّحِمِ
‘‘অশ্লীল কর্ম বিস্তার এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট না করা পর্যন্ত কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবেনা।’’
অর্থাৎ, সমাজে এমন কোনো পরিবার পাওয়া যাবেনা যেখানে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা হচ্ছেনা।
১৩. মিথ্যা সাক্ষ্য বেড়ে যাবে; সত্য সাক্ষ্য লোপ পাবে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
إِنَّ بَيْنَ يَدَيِ السَّاعَةِ شَهَادَةَ الزُّورِ وَكِتْمَانَ شَهَادَةِ الْحَقِِّ
‘‘কিয়ামতের পূর্বে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার প্রচলন ঘটবে এবং সত্য সাক্ষ্য গোপন করা হবে।’’
১৪. প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে, কিন্তু ফসল হবেনা।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يُمْطَرَ النَّاسُ مَطَرًا لَا تُكِنُّ مِنْهُ بُيُوتُ الْمَدَرِ وَلَا تُكِنُّ مِنْهُ إِلَّا بُيُوتُ الشَّعَرِ
‘‘ততদিন কিয়ামত হবেনা যতদিন না আকাশ থেকে প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে। এতে মাটির তৈরী ঘরগুলো ভেঙ্গে পড়বে এবং পশমের ঘরগুলো রক্ষা পাবে’’।
তিনি আরো বলেনঃ
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يُمْطَرَ النَّاسُ مَطَرًا عَامًّا وَلَا تَنْبُتَ الْأَرْضُ شَيْئًا
‘‘ততদিন কিয়ামত হবেনা যেপর্যন্ত না ব্যাপক বৃষ্টিপাত হবে। কিন্তু যমিনে কোন ফসলই উৎপন্ন হবেনা।’’
১৫. মুসলমানেরা শির্কে লিপ্ত হবে।
লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, কিয়ামতের এই আলামত অনুযায়ী মুসলমানরা শির্কে লিপ্ত হয়েছে। কবর পাকা করে, বাঁধাই করে, কবরের উপর গম্বুজ ও মসজিদ নির্মাণ করে তাতে বিভিন্ন প্রকার শির্কের চর্চা হচ্ছে। কবরের পাশে ওরছ সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান হচ্ছে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى تَلْحَقَ قَبَائِلُ مِنْ أُمَّتِي بِالْمُشْرِكِينَ وَحَتَّى يَعْبُدُوا الْأَوْثَانَ
‘‘আমার উম্মাতের বহু সংখ্যক লোক মুশরেকদের সাথে মিলিত না হওয়া এবং মূর্তিপূজায় লিপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত হবেনা।’’
শেষ কথা, conclusion :
কেয়ামতের ছোট ও বড় অনেকগুলো আলামত রয়েছে। সময়ে সাথে সাথে সেই সব আলামত সত্য প্রমাণিত হচ্ছে। এর থেকে অনেকেই মনে অনুমান করছেন যে কেয়ামত সন্নিকটে। কেয়ামতের নিকটবর্তিতার প্রমাণস্বরূপ যে আলামতগুলো প্রকাশ পাবে সেগুলোকে ছোট আলামত ও বড় আলামত উভয় পরিভাষাতে আখ্যায়িত করা হয়। আশা করি উপরিউক্ত আলামতগুলোর অর্থ আপনারা সহজভাবে বুঝতে পড়েছেন।