ইসলামের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনে বহু সুরার উল্লেখ রয়েছে, যা আল্লাহের সাথে মানুষের সংযোগ ঘটায়। এই সূরাগুলো পাঠ করার মাধ্যমেই ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা বিভিন্ন সময়ে আল্লাহের আশ্রয় পাওয়ার সঠিক দোয়া সম্পর্কে জানতে পারেন। সুরা ফালাক কোরআনের ১১৩তম সুরা; যার আয়াত সংখ্যা ৫ রুকু, অনুচ্ছেদ সংখ্যা ১। এই সুরায় আল্লাহ অশুভ শক্তি ও কালো জাদুর অনিষ্ট থেকে দূরে থাকতে তার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে শিখিয়েছেন। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা উক্ত সূরা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
ফালাক নামের ইসলামিক অর্থ কি?
আরবি ভাষায়, ফালাক ( فلك ) এর অর্থ “কক্ষপথ” বা “আকাশীয় গোলক”।
সূরা ফালাক এর অপর নাম কি?
নামকরণ সূরা ফালাক ও সূরা আন-নাস আলাদা আলাদা সূরা হলেও এদের পারস্পরিক সম্পর্ক এত গভীর ও উভয়ের বিষয়বস্তু পরস্পরের সাথে এত বেশি নিকট সম্পর্কিত যে এদেরকে একত্রে “মু’আওবিযাতাইন” (আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার দু’টি সূরা) নামে ডাকা হয়; আর এই সূরা দু’টি নাযিলও হয়েছে একই সাথে একই ঘটনার পরি-প্রেক্ষিতে।
সূরা আল ফালাক কুরআনের কোন অধ্যায়? Which chapter of the Quran is Surah al-Falaq?
সূরা ফালাক (سورَةُ الفَلَق), যেটির নামটি এর প্রথম আয়াত থেকে নেওয়া হয়েছে, যার অর্থ হল প্রভাত, এর অপর নাম হল মুওয়াওয়াদাহ (مُعَوَّذَة), যার অর্থ আশ্রয় চাওয়া। আল্লাহ মদিনায় নবী মুহাম্মদের উপর সূরা ফালাক নাজিল করেছিলেন।
সূরা ফালাক এর ৩টি শিক্ষা ও নির্দেশনা, 3 teachings and instructions of Surah Falaq
- ১. আল্লাহর আশ্রয় মানুষকে যে কোনো রকম অশুভ শক্তির অনিষ্ট ও কুপ্রভাব থেকে রক্ষা করতে পারে। জগতের সব অনিষ্ট থেকে বাঁচতে বিশ্বজগতের স্রষ্টা ও রব আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে।
- ২. যারা কালো জাদু করে তারা মানুষ ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর, তাদের অনিষ্ট থেকে রক্ষা পেতে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে।
- ৩. ইসলামে হিংসা করা হারাম। সর্বাবস্থায় হিংসা পরিহার করতে হবে। হিংসা এমন এক ভয়াবহ ব্যাধি যা মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ, শত্রুতা ও হানাহানি উস্কে দেয়। তবে কিছু কিছু মানুষকে তাদের সৎকাজ করার তাওফিক বা উত্তম গুণের কারণে ঈর্ষা করা যায়। ঈর্ষা হলো কারো অর্জন, গুণ বা কাজ দেখে তার মতো হওয়ার আকাঙ্খা রাখা, আর হিংসা হলো কারো অর্জন বা গুণ দেখে অসহ্যবোধ করা এবং উক্ত গুণ, অর্জন বা সাফল্যের ধ্বংস ও অনিষ্ট চাওয়া, সেই ব্যাক্তি সম্পর্কে অশুভ কামনা করা।
সুরাতুল ফালাক এর মূল শিক্ষা কি? What is the main teaching of Surah Falaq
সূরাটিতে মহানবী (সাঃ) বিশেষ করে এবং সকল মুসলমানদের জন্য কিছু ঐশ্বরিক শিক্ষার আদেশ রয়েছে, যাতে বাহ্যিক প্রকৃতি থেকে উদ্ভূত সকল প্রকার অসুস্থতা, অন্ধকার ও মন্দ চক্রান্ত এবং হিংসা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা হয়।
সূরা ফালাক কোথায় অবতীর্ণ হয়? Where was Surah Falak revealed?
সূরা আল-ফালাক মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে; যদিও কোন কোন বর্ণনায় একে মক্কায় অবতীর্ণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এর পাঁচ আয়াতে শয়তানের অনিষ্ট থেকে সুরক্ষার জন্য সংক্ষেপে আল্লাহর নিকট প্রার্থণা করা হয়। এই সূরাটি এবং এর পরবর্তী সূরা আন-নাসকে একত্রে মু’আওবিযাতাইন অর্থাৎ আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার দু’টি সূরা নামে উল্লেখ করা হয়।
সূরা ফালাক অনুবাদ, Translation of Surah Falaq
- بسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ .
- দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে।
قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ :
১. আপনি বলুন, আমি আশ্রয় প্রার্থনা করি প্রভাতের স্রষ্টার নিকট।
مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ :
২. তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তার অনিষ্ট থেকে।
وَمِنْ شَرِّ غَاسِقٍ إِذَا وَقَبَ *
৩. রাতের আঁধারের অনিষ্ট থেকে, যখন তা গভীর হয়।
وَمِنْ شَرِّ النَّفْتِ فِي الْعُقَدِ .
৪. এবং অনিষ্ট থেকে ঐ সমস্ত নারীদের, যারা গ্রন্থিতে ফুৎকার দেয়।
وَمِنْ شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ .
৫. এবং হিংসুকের অনিষ্ট থেকে, যখন সে হিংসা করে।
সুরা আল ফালাক এর ব্যাখ্যা, Explanation of Surah Al Falaq
সুরা আল ফালাক ও সূরা আন নাস এই দুই সূরার মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, এ সূরা দুটিতে বিভিন্ন জিনিসের অনিষ্ট থেকে আল্লাহ তায়ালার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা হয়েছে।
এই সূরা দুটি নাজিল করার কারণগুলো হল :
একবার লাবীদ ইবনে আসিম নামক এক ইহুদি রাসুলুল্লাহ (স.) এর উপর জাদু করে । এ কাজে সে তার কন্যাদের সাহাগ্য নেয়। তারা গোপনে রাসূল (স.) এর একটি পবিত্র চুল সংগ্রহ করে এবং তাতে এগারোটি গিরা দিয়ে জাদু করে। ফলে রাসুল (স.) অসুস্থ হয়ে পড়েন। জাদুর কারণে রাসুলুল্লাহ (স.) এর কষ্ট হতে থাকে। এমতাবস্থায় আল্লাহ তায়ালা এ সূরা দুটি নজিল করেন। এ সূরা দুটিতে মোট ১১ টি আয়াত রয়েছে। প্রতিটি আয়াত পড়ে প্রতিটি গিরাতে ফুঁক দিলে জাদুর প্রভাব নষ্ট হয়ে যায়। রাসুল (স.) সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন।
এ সূরার প্রথম আয়াতে ঊষার রব আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা হয়েছে, যিনি পাক এবং সকল শক্তির উৎস। বিশ্বজগতের সবকিছুই তিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনিই রাতকে দিনে রূপান্তর করেন এবং দিনকে রাতে রূপান্তর করেন। তিনিই সকাল, সন্ধ্যা, ঊষা ইত্যাদির আগমন ঘটিয়ে থাকেন। মুসলিমদের বিশ্বাস অনুযায়ী, তাদের সকল প্রকার অনিষ্ট থেকে তিনিই রক্ষা করেন।
এজন্য সূরার প্রথমেই আল্লাহ তায়ালার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা হয়েছে। ইসলাম ধর্মের মানুষেরা মনে করেন যে, গভীর রাতে নানরূপ বিপদাপদ ঘটতে পারে। যেমন; জিন, শয়তান, চোর-ডাকাত, শত্রুর আক্রমণ ইত্যাদি। এসবের অনিষ্ট থেকেও রক্ষাকর্তা মহান আল্লাহ । আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর সবকিছুরই স্রষ্টা। এসব সৃষ্টির মধ্যে অনেক হিংস্র, বিষাক্ত ও অনিষ্টকর সৃষ্টিও রয়েছে। এগুলো মানুষের পরীক্ষা করার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।
এগুলো অনিষ্ট থেকে রক্ষাকর্তা হলেন মহান আল্লাহ।
সূরা ফালাক এর ফজিলত, Fazilat od Surah Falaq
আবু দাউদ, তিরমিযী ও নাসায়ীর এক দীর্ঘ রেওয়ায়েতে রসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,
যে ব্যক্তি সকাল-বিকাল সূরা এখলাস, ফালাক ও নাস পাঠ করে তা তাকে বালা-মিসীবত থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে যথেষ্ট হয়। – (ইবনে-কাসীর)
সহীহ মুসলিমে ওকবা ইবনে আমের (রাঃ)- এর বর্ণিত হাদীসে রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,
তোমরা লক্ষ্য করেছ কি, অদ্য রাত্রিতে আল্লাহ তা’আলা আমার প্রতি এমন আয়াত নাযিল করেছেন, যার সমতুল্য আয়াত দেখা যায় না। অর্থা ক্বুল আউযু বিরাব্বিল ফালাক এবং ক্বুল আউযু বিরাব্বিল নাস আয়াতসমূহ। অন্য এক রেওয়ায়েতে আছে, তওরাত, ইঞ্জীল, যাবুর এবং কোরআনেও অনুরূপ অন্য কোন সূরা নেই।
এক সফরে রসূলুল্লাহ (সাঃ) ওকবা ইবনে আমেন (রাঃ)-কে সূরা ফালাক এবং সূরা নাস পাঠ করান, অত:পর মাগরিবের নামাযে এ সূরাদ্বয়ই তেলাওয়াত করে বলেন, এই সূরাদ্বয় নিদ্রা যাওয়ার সময় এবং নিদ্রা শেষে বিছানা থেকে উঠার সময়ও পাঠ করো।
অন্য হাদীসে তিনি প্রত্যেক নামাযের পর সূরাদ্বয় পাঠ করার আদেশ করেছেন। – (আবু দাউদ, নাসায়ী)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে হাবীব (রাঃ) বর্ণনা করেন, এক রাত্রিতে বৃষ্টি ও ভীষণ অন্ধকার ছিল। আমরা রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে খুঁজতে বের হলাম। যখন তাকে পেলাম, তখন প্রথমেই তিনি বললেনঃ বল। আমি আরয করলাম, কি বলব? তিনি বললেনঃ সূরা এখলাস ও কূল আউযু সূরাদ্বয়। সকাল-সন্ধ্যায় এগুলো তিন বার পাঠ করলে তুমি প্রত্যেক কষ্ট থেকে নিরাপদ থাকবে। – (মাযহারী)
শেষ কথা, Conclusion
জাদুকর নর নারী ও হিংসুকের হিংসা থেকে আশ্রয়দাতাও আল্লাহ তায়ালা। আয়াতগুলোতে উল্লিখিত সমুদয় বিষয় থেকে আল্লাহ তায়ালার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা হয়েছে। এই সূরা দুটি পড়লে অনিষ্ট ও যাদু থেকে হেফাযতে থাকা যায়।
হাদীস শরীফে প্রত্যেক ফরয নামাযের পর তা পড়ার গুরুত্ব এসেছে। আল্লাহপাক রাব্বুল আলামিন সূরা আল-নাস এ অসংখ্য নেয়ামত এবং ফজিলত দিয়েছেন। সবাই এই ছোট সূরাটিকে যেন গুরুত্বের সাথে আমল করেন এবং অন্য ভাই বোনদেরকেও তা আমল করার সুযোগ করে দিন।