ইবাদতের পবিত্র মাসে অর্থাৎ রমজানের মাসে মুসলমানরা ব্যাপকভাবে যেসব ইবাদত করে থাকে তার একটি হলো তারাবি নামাজ। তারাবি শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো: বিশ্রাম, স্বস্তি, প্রশান্তি, শান্তি। মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে তারাবি নামাজের বিশেষ ফজিলত রয়েছে। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে তারাবি পড়ার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। রাতের বিশেষ এই নামাজে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অনেকেই অংশগ্রহণ করেন। তারাবিকে ঘিরে দেশের মসজিদগুলোতে উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা তারাবি নামাজের দোয়া নিয়ে আলোচনা করবো।
তারাবি নামাজ সম্পর্কে হাদীসে উল্লেখ, References in hadiths about Tarawi Namaz
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘রমজান মাসে যে ব্যক্তি একটি নফল আদায় করলো সে যেন অন্য মাসে একটি ফরজ আদায় করলো। আর যে এ মাসে একটি ফরজ আদায় করলো সে যেন অন্য মাসের ৭০টি ফরজ আদায় করলো। (শুআবুল ঈমান : ৩/৩০৫-৩০৬)
এক হাদিসে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও পরকালের আশায় রমজানের রাতে কিয়ামুল লাইল (তারাবি) আদায় করবে, তার অতীতের পাপ মার্জনা করা হবে।’ (নাসায়ি, হাদিস : ২২০৫)
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় রমজান মাসে তারাবিহর নামাজ পড়বে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। (সহীহ আল-বোখারি, হাদিস: ১৯০১, সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৭৫৯, সুনানে দারেমি: ১৮১৭, মুসনাদে আহমাদ: ৯৪৪৫, মুসনাদে হুমাইদি: ১০৩৭)
তারাবি নামাজের নিয়ম, নিয়ত, দোয়া ও মোনাজাত, Tarawi prayer rules, intentions, supplications and prayers
তারাবি নামাজের নিয়ম, নিয়ত, দোয়া ও মোনাজাত সম্পর্কে নিম্নে তুলে ধরা হলো-
১) তারাবি নামাজ পড়ার নিয়ম
তারাবি নামাজ এশার ফরজ নামাজ পড়ার পরে পড়তে হয়। তারাবি নামাজ পড়া হয় দুই রাকাত করে। প্রত্যেক দুই রাকাতের পর সালাম ফেরানো হয়। এভাবে করে চার রাকাত পড়া হয়ে গেলে পরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া হয়। এসময় বিভিন্ন তাসবিহ-তাহলিল পড়া উত্তম বলে মনে করা হয়।
২) তারাবি নামাজের নিয়ত
ইসলাম ধর্মে প্রত্যেক আমলের জন্য নিয়ত করতে হয়। একইভাবে তারাবি নামাজের জন্যও নিয়ত করা হয়। নিয়ত আরবী ভাষায় উচ্চারণ না করে বরং মনে মনে বাংলাতেও করা যায়। আমাদের দেশের প্রচলিত তারাবির আরবি নিয়তটি হলো-
نَوَيْتُ اَنْ اُصَلِّىَ للهِ تَعَالَى رَكْعَتَى صَلَوةِ التَّرَاوِيْحِ سُنَّةُ رَسُوْلِ اللهِ تَعَالَى مُتَوَجِّهًا اِلَى جِهَةِ الْكَعْبَةِ الشَّرِيْفَةِ اللهُ اَكْبَرْ
এর উচ্চারণ হল : নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তায়ালা, রাকাআতাই সালাতিত তারাবি সুন্নাতু রাসূলিল্লাহি তায়ালা, মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারিফাতি, আল্লাহু আকবার।
এর বাংলা অর্থ হল : আমি কেবলামুখী হয়ে দুই রাকাত তারাবি সুন্নত নামাজের নিয়ত করছি; আল্লাহু আকবার।
ইসলাম ধর্মে তারাবি নামাজের নিয়ত আরবিতে করা আবশ্যক বা বাধ্যতামূলক নয়। অনেকেই এর নিয়ত বাংলায় করেন, বাংলাতে যেভাবে নিয়ত করা যাবে ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তারাবি -এর দুই রাকাত নামাজ কেবলামুখী হয়ে (জামাত হলে- এ ইমামের পেছনে) পড়ছি- (اَللهُ اَكْبَر) আল্লাহু আকবার।’
৩) তারাবি নামাজের দোয়া
তারাবি নামাজের দোয়ার ক্ষেত্রে প্রতি চার রাকাত পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া হয়। এ সময় একটি দোয়া পড়া হয়। বলাই বাহুল্য প্রায় সব মসজিদের মুসল্লিরা এই দোয়াটি পড়ে থাকেন। দোয়াটি হলো-
سُبْحانَ ذِي الْمُلْكِ وَالْمَلَكُوتِ سُبْحانَ ذِي الْعِزَّةِ وَالْعَظْمَةِ وَالْهَيْبَةِ وَالْقُدْرَةِ وَالْكِبْرِيَاءِ وَالْجَبَرُوْتِ سُبْحَانَ الْمَلِكِ الْحَيِّ الَّذِيْ لَا يَنَامُ وَلَا يَمُوْتُ اَبَدًا اَبَدَ سُبُّوْحٌ قُدُّوْسٌ رَبُّنا وَرَبُّ المْلائِكَةِ وَالرُّوْحِ
এর উচ্চারণ হল : ‘সুবহানা জিল মুলকি ওয়াল মালাকুতি, সুবহানা জিল ইয্যাতি ওয়াল আঝমাতি ওয়াল হায়বাতি ওয়াল কুদরাতি ওয়াল কিব্রিয়ায়ি ওয়াল ঝাবারুতি। সুবহানাল মালিকিল হাইয়্যিল্লাজি লা ইয়ানামু ওয়া লা ইয়ামুত আবাদান আবাদ; সুব্বুহুন কুদ্দুসুন রাব্বুনা ওয়া রাব্বুল মালায়িকাতি ওয়ার রূহ।’
তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, বিশুদ্ধ তারাবি নামাজ এর সঙ্গে এই দোয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। এমন কোনো নিয়ম নেই যে এই দোয়া না পড়লে তারাবি নামাজ সম্পন্ন হবে না। মূলত এ দোয়ার সঙ্গে তারাবি নামাজ হওয়া কিংবা না হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। এক কথায় এই সময় কোরআন-হাদিসে বর্ণিত যেকোনো দোয়াই পড়া যাবে। আলেমদের মতে, তারাবি নামাজে চার রাকাত পর বিশ্রামের সময়টিতে কোরআন-হাদিসে বর্ণিত দোয়া, তওবা- ইসতেগফারগুলো পড়াই উত্তম।
৪) তারাবি নামাজের মোনাজাত
তারাবি নামাজ শেষে প্রতিদিন মসজিদগুলোতে একটি দোয়া পড়ে মোনাজাতের প্রচলন রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই দেশব্যাপী মসজিদগুলোতে পড়া এই দোয়াটি হলো-
اَللَهُمَّ اِنَّا نَسْئَالُكَ الْجَنَّةَ وَ نَعُوْذُبِكَ مِنَ النَّارِ يَا خَالِقَ الْجَنَّةَ وَالنَّارِ- بِرَحْمَتِكَ يَاعَزِيْزُ يَا غَفَّارُ يَا كَرِيْمُ يَا سَتَّارُ يَا رَحِيْمُ يَاجَبَّارُ يَاخَالِقُ يَابَارُّ اَللَّهُمَّ اَجِرْنَا مِنَ النَّارِ يَا مُجِيْرُ يَا مُجِيْرُ يَا مُجِيْرُ- بِرَحْمَتِكَ يَا اَرْحَمَ الرَّحِمِيْنَ
এর উচ্চারণ হল : আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকাল জান্নাতা ওয়া নাউজুবিকা মিনাননার। ইয়া খালিক্বাল জান্নাতি ওয়ান নার। বিরাহমাতিকা ইয়া আঝিঝু ইয়া গাফফার, ইয়া কারিমু ইয়া সাত্তার, ইয়া রাহিমু ইয়া ঝাব্বার, ইয়া খালিকু ইয়া বার্রু। আল্লাহুম্মা আঝিরনা মিনান নার। ইয়া মুঝিরু, ইয়া মুঝিরু, ইয়া মুঝির। বিরাহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমিন।’
অনেকেই ৪ রাকাত পর পর মোনাজাত করে থাকেন। আবার অনেকে পুরো নামাজ শেষ করে মোনাজাত একসঙ্গে মোনাজাত দেন। তবে নামাজ শেষ করে বিতর পড়ে মোনাজাত দেওয়াই উত্তম। মোনাজাতের জন্যও দেশব্যাপী মানুষের কাছে একটি দোয়া প্রাচীনকাল থেকেই ব্যাপকভাবে পড়া হয়। তারাবি নামাজের দোয়ার মতো এ মোনাজাতটিও নামাজ হওয়া বা না হওয়ার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।
দোয়াটি পড়ার ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে তারাবি নামাজ হওয়া বা না হওয়ার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই, যেমন তারাবি নামাজের প্রতি চার রাকাত পর পর পড়া দোয়াটির সঙ্গে তারাবি বিশুদ্ধ হওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। আমাদের সমাজে অনেকে মনে করেন তারাবি নামাজ সঠিক নিয়মে আদায়ের জন্য নামাজ শেষে এই দোয়াটি পড়া আবশ্যক। এমন ধারণা বা বিশ্বাস মোটেও ঠিক নয়। মুনাজাত সমবেত হোক আর একাকি যে কোনো দোয়া দিয়ে তা করা যেতে পারে।
তবে রমজান জুড়ে বিশ্বনবির এ ইসতেগফার দুইটি বেশি বেশি পড়া জরুরি। আর তাহলো-
১. اَﻟﻠَّﻬُﻢَّ ﺇﻧَّﻚَ ﻋَﻔُﻮٌّ ﺗُﺤِﺐُّ اﻟْﻌَﻔْﻮَ ﻓَﺎﻋْﻒُ ﻋَﻨِّﻲ
এর উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুওউন, তুহিব্বুল আফওয়া, ফা’ফু আ’ন্নি।
২. اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ وَأَبُوءُ بِذَنْبِي فَاغْفِرْ لِي فَإِنَّهُ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ
এর উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা আনতা রাব্বি লা ইলাহা ইল্লা আনতা খালাক্বতানি; ওয়া আনা আ’বদুকা ওয়া আনা আ’লা আ’হদিকা ওয়া ওয়া’দিকা মাসতাত্বা’তু, আউজুবিকা মিন শাররি মা সানা’তু আবুউলাকা বিনি’মাতিকা আলাইয়া; ওয়া আবুউ বিজামবি ফাগফিরলি ফা ইন্নাহু লা ইয়াগফিরুজ জুনুবা ইল্লা আনতা।’
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে যথাযথভাবে তারাবি নামাজ আদায় করার তাওফিক দান করুন। রাতের নামাজ (তারাবি ) আদায়ের মাধ্যমে বিগত জীবনের সব গুনাহ থেকে মুক্ত হওয়ার তাওফিক দান করুন।
শেষ কথা, To Conclude
রমজান মাস মুসলিম উম্মাহর জন্য এক মহাঅনুগ্রহের মাস। অন্যান্য মাসের তুলনায় এ মাসের মর্যাদা অনেক বেশি। আর রমজান মাসের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত হলো বিশ রাকাআত তারাবিহর নামাজ। রমজানের চাঁদ দেখা গেলে রোজার আগে রাতে এশার নামাজের পর তারাবিহর নামাজ আদায় করা রমজানের সুন্নত।