ইসলামী বিধান অনুযায়ী, রাতের এশার নামাজের পর তারাবির নামাজ শুরু হয়। রমজানের সিয়ামের বিশেষ অনুষঙ্গ হল তারাবির সালাত। মুমিন বান্দারা যথাযথ গুরুত্ব ও ভাবগাম্ভীর্যতার সাথে তারাবির সালাত আদায় করে থাকেন এবং রমজানের সময় দিনে রোজা রেখে রাতে দীর্ঘক্ষণ তারাবির নামাজের কষ্ট আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করেন।
তারাবি শব্দের অর্থ, The meaning of the word Tarabi
তারাবি আরবি শব্দ, যা তারবিহাতুন শব্দের বহুবচন; যার অর্থ হলো আরাম, প্রশান্তি অর্জন, বিরতি দেওয়া, বিশ্রাম নেওয়া ইত্যাদি। যেহেতু ২০ রাকাত তারাবির নামাজ প্রতি চার রাকাত অন্তর চার রাকাত নামাজের সমপরিমাণ সময় বিরতি দিয়ে আরামের সঙ্গে আদায় করা হয়, সেজন্য এ নামাজকে তারাবির নামাজ বলা হয়।
তারাবির নামাজের গুরুত্ব, Importance of Taraweeh prayer
তারাবির নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত অপরিসীম, কারণ, মাহে রমজান যেসব বৈশিষ্ট্যের জন্য মহিমান্বিত, তার মধ্যে অন্যতম হলো তারাবির নামাজ। পবিত্র রমজানের গুরুত্বপূর্ণ সুন্নতগুলোর মধ্যে অন্যতম হল তারাবির সালাত। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন,
‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সাওয়াবের উদ্দেশ্যে রমজানে তারাবির নামাজ আদায় করেন, তার অতীতের গুনাহগুলো আল্লাহপাক ক্ষমা করে দেবেন। (বুখারি শরিফ)।
মূলত মাহে রমজানে এশার ফরজ ও সুন্নত নামাজের পর বিতরের আগে তারাবির নামাজ আদায় করতে হয়। সাধারণ নফল ও সুন্নতের চেয়ে এটি অধিকতর মর্যাদাবান বলে মনে করা হয়, গুরুত্বের দিক থেকে বিচার করতে গেলে তারাবির নামাজ সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ, যা ওয়াজিবের কাছাকাছি।
তারাবি নামাজের ধরণ, Tarawi prayer type
ইসলামে দুই ধরণের তারাবি প্রচলিত। একটি হলো সুরা তারাবি এবং অন্যটি খতম তারাবি। সুরা তারাবি হল পবিত্র কোরআনের যে কোন সুরা দিয়ে ২০ রাকাত নামাজ আদায় করা। অন্যদিকে খতম তারাবি হলো রমজান মাসে সম্পূর্ণ কোরআন সহকারে তারাবি আদায় করা। উভয় পদ্ধতিকেই ইসলাম অনুমোদন করে। তবে বিশ্বাস করা হয় যে খতম তারাবিতে সওয়াব বেশি। সুরা তারাবির মাধ্যমে নামাজ আদায় করলেও নামাজ আদায় হবে।
তারাবির নামাজ পড়ার নিয়ম, Rules of Tarawi prayer
রমজান মাসে চাঁদ দেখার পর রাতে এশার নামাজের পর তারাবির নামাজ পড়া শুরু করতে হয়। প্রতিটি রমজানের রোজা থাকার পূর্ব রাতে তারাবির নামাজ পড়তে হয়। ঈদের চাঁদ দেখা গেলে সেই রাতে তারাবির নামাজ পড়া বন্ধ রেখে রাত শেষে সকালে ঈদের নামাজ পড়তে হয়। এশার নামাজের চার রাকাত ফরজ ও দুই রাকাত সুন্নতের পর এবং বিতর নামাজের আগে দুই রাকাত করে ১০ সালামে যে ২০ রাকাত নামাজ আদায় করা হয়। সেই নামজই ‘তারাবির নামাজ’ বলে পরিচিত। তারাবির নামাজ একটি সুন্নত ইবাদত। রমজান মাসে অধিক সওয়াব পেতে এ নামাজ অবশ্যই পড়া উত্তম।
তারাবি নামাজের নিয়ত, Intention of Tarawi prayer
তারাবি নামাজের ক্ষেত্রে আরবি এবং বাংলা উভয়ভাবে নিয়ত করা যাবে। আরবি নিয়ত হচ্ছে,
“নাওয়াাইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তাআলা, রকাআতাই সালাতিত তারাবিহ, সুন্নাতু রাসুলিল্লাহি তাআলা, মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারিফাতি, আল্লাহু আকবার।”
বাংলায় নিয়ত করতে হলে বলতে হবে, “আমি কেবলামুখি হয়ে দুই রাকাআত তারাবির সুন্নতে মুয়াাক্কাদাহ নামাজের নিয়ত করছি। আল্লাহু আকবার। (জামাআত হলে যোগ করতে হবে এ ইমামের পেছনে পড়ছি)।”
তারাবির নামাজ কিভাবে পড়বেন, How to pray Taraweeh
তারাবির নামাজ পড়তে গিয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করতে হয়। এরপর আবার দুই রাকাত নামাজ পড়তে হয়। এভাবে ৪ রাকাত আদায় করার পর একটু বিশ্রাম নিতে হবে। বিশ্রাম নেওয়ার সময় তাসবিহ তাহলিল পড়তে হবে, দোয়া-দরূদ ও জিকির আজকার করতে হবে। তারপর আবার দুই দুই রাকাত করে আলাদা আলাদা নিয়তে তারাবি আদায় করতে হবে।
জামাতে তারাবি, Jamaat- e-Tarabi
ইসলামের দৃষ্টিতে ফরজ নামাজ ব্যতিত অন্য সকল নামাজ একাকী আদায় করা উত্তম। কিন্তু তারাবি নামাজ এর ব্যতিক্রম। তারাবির নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করাকে শরীয়ত সম্মত বলে মনে করা হয়। তারাবি একাকী আদায় করার চেয়ে জামাতবদ্ধভাবে আদায় করা উত্তম। এর কারণ হল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে তারাবির নামাজ জামাতে আদায় করেছেন এবং জামাতে আদায়ের ব্যাপারে তাকিদ দিয়েছেন।
তারাবিতে কোরআন খতম, The Qur’an ends in Tarabi
তারাবির নামাজে কোরআন শরিফ খতম পূর্ণ করার জন্য তারাবিতেই সম্পূর্ণ কোরআন শরিফ তেলাওয়াত করা জরুরি, অতএব ছুটে যাওয়া অংশ তারাবির নামাজেই পড়তে হবে, অন্যথায় খতম পূর্ণ হবে না এবং পূর্ণ খতম শোনার সওয়াব পাওয়া যাবে না। -আল মুগনি, ইবনে ক্বুদামা: ২/১২৫
খতম তারাবি চলাকালীন তন্দ্রার কারণে বা বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার কারণে সাউন্ডবক্স বন্ধ থাকায় কেউ তেলাওয়াতের কোনো অংশ শুনতে না পেলেও পরিপূর্ণ খতমের সাওয়াব পেয়ে যাবে। -আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল: ৩/৬৮, নিজামুল ফাতাওয়া: ৫/৯৪
একজন হাফেজ এক মসজিদে তারাবিতে কোরআনে কারিম খতম করার পর অন্য মসজিদে ২য় খতম করতে পারবে। দ্বিতীয় মসজিদের মুসল্লিদের জন্য এটি প্রথম খতম হলেও তাদের ইক্তিদা ও খতমে কোরআনের সওয়াবে কোনো ব্যাঘাত হবে না। -মাজমুআতুল ফাতাওয়া: ১/২২৪
খতমে কোরআনের উত্তম পদ্ধতি হলো, ১৯তম রাকাতে সূরা নাস পর্যন্ত এবং ২০তম রাকাতে পুনরায় সূরা বাকারার শুরু থেকে ‘মুফলিহুন’ পর্যন্ত তেলাওয়াত করা। -তিরমিজি, হাদিস: ২৯৪৮, ফাতাওয়ায়ে রহিমিয়া: ৪/৩৮৩
নারীদের তারাবি নামাজ পড়ার নিয়ম, Rules for women to perform Tarawi prayers
নারীরা ঘরে একা নামাজ পড়লে অধিক সওয়াব পাওয়া যায়। তাই তাদের মসজিদে না গিয়ে ঘরেই তারাবি আদায় করে নেওয়া উত্তম।
তারা যদি পুরুষ ইমামের পেছনে নামাজ পড়ে, তাহলে ওই নামাজ শুদ্ধ হবে। তবে এ ক্ষেত্রে নারীদের পর্দার বিধান যাতে লঙ্ঘিত না হয়, সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। (তাবঈনুল হাকায়েক : ১/১৩৫, ফাতাওয়া দারুল উলুম : ৩/৪৩)
কোনো পুরুষ শরিয়ত অনুমোদিত কোনো কারণে মসজিদে যেতে পারেননি, পরে তিনি ঘরের মাহরাম নারীদের নিয়ে জামাতে তারাবি পড়তে পারেন। এ ক্ষেত্রে সবাই জামাতের সাওয়াব পাবেন। কিন্তু গায়রে মাহরাম নারীদের নিয়ে জামাতে নামাজ পড়া সমীচীন নয়। তা সত্ত্বেও মাহরাম নারীদের পাশাপাশি গায়রে মাহরাম নারীরা তাতে শরিক হতে চাইলে অবশ্যই পর্দার আড়ালে থাকবে। পর্দার বিধান লঙ্ঘন করে জামাত করা বৈধ নয়।
বিশুদ্ধ হাদিসে রয়েছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন মহিলাদেরকে মসিজেদ না এসে ঘরে নামাজ আদায় করার নির্দেশ দিলেন তখন একজন মহিলা সাহাবি রাসূল (সা.)-এর খেদমতে এসে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার মন চায় আপনার পিছনে নামাজ পড়তে, আমাকে অনুমতি দিন। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তদুত্তরে যা বললেন তার মর্ম হলো, আমি তোমার আগ্রহের মূল্যায়ন করি, তা সত্ত্বেও মসজিদে নববিতে এসে পঞ্চাশ হাজার রাকাত সওয়াব পাওয়া এবং আমার পিছনে নামাজ পড়া থেকে তোমার ঘরে একা নামাজ পড়াই উত্তম।
শেষ কথা, Conclusion
প্রতিটি মুসলিমের নিকট রমজান মাস পবিত্র, বরকত আর কল্যানের দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিয়ত ঠিক রেখে তারাবির নামাজ আদায় করলেই হল। তবে তারাবির নামাজের নিয়ত দোয়া এগুলো মনে রাখা খুব জরুরী এবং সেই অনুযায়ী নামাজ পড়লে শুদ্ধ ভাবে নামাজ আদায় করা হবে। তারাবির নামাজ আদায় করার পর মহান আল্লাহ পাকের নিকট আপনার দাবি দাওয়া পেশ করতে পারেন অথবা সাহায্য চাইতে পারেন।