যোহরের নামাজ মূলত দুপুরের ইবাদত। মুসলিমদের অবশ্য পালনীয় দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মধ্যে যোহ্রের নামাজ অন্যতম। দৈনিক নামাযগুলোর মধ্যে এটি দ্বিতীয়। এটি দুপুরের সময় আদায় করা হয়। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা যোহরের নামাজ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
যোহরের নামাজ কয় রাকাত, How many rakats of Zohr prayer?
জোহরের নামাজ সর্বমোট ১২ রাকাত। যোহরের নামায ছয় রাকাত সুন্নাত, চার রাকাআত ফরয ও এরপর দুই রাকাত নফল নিয়ে গঠিত। কেউ কেউ পরে দুই রাকআত নফল নামাজও আদায় করে।
ফরয অংশ ইমামের নেতৃত্বে জামাআতের সাথে আদায় করা হয়। তবে কোনো ব্যক্তি যদি মুসাফির অবস্থায় থাকে তবে চার রাকাত ফরযকে সংক্ষিপ্ত করে দুই রাকাত করতে পারে ও সুন্নাত আদায় নাও করতে পারে। যদি সুন্নাত না আদায় করা হয়, তবে কোনও গুনাহ নাই, কিন্তু অনেকগুলা সাওয়াব এতে হারানো হয়। শুক্রবার যোহরের পরিবর্তে জুম্মাহর নামাজ আদায় করা হয়। জুম্মা ও যোহরের সময় শুরু ও শেষ হওয়ার নিয়ম একই।
যোহরের চার রাকাত সুন্নত নামাজ না পড়লে কি গুনাহ হবে? Will it be a sin if Sunnat Namaz is recited four Rakats?
জোহরের নামাজের পূর্বের এবং পরের চার রাকাত সুন্নত নামাজ এর পূর্ণ খেয়াল রাখবে (নিয়মিত আদায় করবে), মহান আল্লাহ তায়ালা তার থেকে জাহান্নামের আগুন হারাম করে দেবেন।
যোহরের নূন্যতম কত রাকাত? What is minimum number of Rakats in Zohr?
যোহরঃ 4 রাকাত সুন্নত, তারপর 4 রাকাত ফরজ, তারপর 2 রাকাত সুন্নত, তারপর 2 রাকাত নফল। আসরঃ ৪ রাকাত সুন্নত, তারপর ৪ রাকাত ফরজ। মাগরিবঃ ৩ রাকাত ফরজ, তারপর ২ রাকাত সুন্নত, তারপর ২ রাকাত নফল।
যোহর নামাজের নিয়ম, Zuhr prayer rules
জোহরের নামাজের নিয়ম খুবই স্বাভাবিক এবং সাধারন। আপনি অন্যান্য নামাজ যেভাবে আদায় করেন, জোহরের নামাজও ঠিক একইভাবে আদায় করতে হয়। এক্ষেত্রে যা করতে হয় :
- প্রথমত, সুন্নত নামাজ হিসেবে চার রাকাত একসাথে আদায় করে নিতে হবে। তারপরে ফরজ নামাজ চার রাকাত আদায় করে নিতে হবে।
- তারপরে সুন্নত নামাজ আবার দুই রাকাত এবং সর্বশেষে নফল নামাজ দুই রাকাত আদায় করে নিতে হবে।
- অন্যান্য নামাজ আপনি যেভাবে আদায় করেন ঠিক ওইরকম ভাবে সুন্নত এবং ফরজ নামাজ আদায় করে নিতে পারেন।
- আপনি যদি চার রাকাত ফরজ সালাত পড়তে যান, তাহলে আপনাকে ভাল কাপড়-চোপড় পড়ে এবং শরীর পাক করতে হবে এবং তারপরে প্রথমত একটি পবিত্র স্থানে দাঁড়াতে হবে। যখনই আপনি সালাতের জন্য দাঁড়িয়ে যাবেন তখন তাকবীরে তাহরীমা আল্লাহু আকবার বলে দুই হাত কাঁধ বরাবর উঠিয়ে নাভি বরাবর কিংবা বুকের উপরে হাত বেঁধে নিতে হবে।
- এবং তারপরে জায়নামাজের দোয়া পড়ে নিতে হবে। যদি আপনি ফরজ নামাজ মসজিদে আদায় করেন এবং জামায়াতের সহায়তা আদায় করেন, তাহলে আপনাকে শুধুমাত্র ইমাম সাহেব যে তেলাওয়াত করেন সেটি শুনতে হবে। কিন্তু আপনি যদি একা একা সালাত আদায় করেন তাহলে প্রথমত সূরা ফাতিহা এবং তারপরে সূরা ফাতিহার সাথে আরেকটি সূরা মিলিয়ে তেলাওয়াত করতে হবে।
- যখনই আপনি সূরা ফাতিহা এবং তার সাথে আরেকটি সূরা মিলিয়ে তেলাওয়াত করে নিবেন, তার পরে আপনাকে রুকু করতে হবে। রুকুতে চলে যাওয়ার পরে রুকুর তাসবীহ পড়ে নিতে হবে। রুকুর তাসবি পড়ে নেয়ার পরে সোজা হয়ে দাঁড়াতে হবে। এবং তারপরে সেজদায় চলে যেতে হবে। সিজদায় চলে যাওয়ার পরে সেজদার তাসবিহ পড়তে হবে।
- তারপরে পুনরায় সোজা হয়ে বসে তার পরে পুনরায় সেজদা দিতে হবে। যখনই আপনি দুইটি সেজদা সফলভাবে দিয়ে দিবেন তখন পুনরায় দাঁড়াতে হবে। এবং তারপরে আবার সূরা ফাতিহা এবং তার সাথে আরেকটি সূরা মিলিয়ে যথারীতি ভাবে রুকু এবং সেজদা করতে হবে। রুকু এবং সেজদা করার পরে যখন আপনি দুইটি সেজদা করে ফেলবেন তখন না দাঁড়িয়ে, বসে পড়তে হবে এবং তারপরে তাশাহুদ পড়তে হবে।
“আত্তাহিয়াতু লিল্লাহি ওয়াস সালাওয়াতু ওয়াত তায়্যিবাতি আসসালামুয়ালাইকা আয়্যুহান নাবিয়্যু ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ্। আসসালামুয়ালাইনা আ’লা ইবাদিল্লাহিস সুয়ালিহিন, আশহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রসূলুহ্”
তাশাহুদ যখন পড়ে নিয়ে আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হবে, এবং তার পরে তৃতীয় রাকাতে শুধুমাত্র সূরা ফাতিহা পড়তে হবে। একইভাবে রুকু সিজদা করার পর চতুর্থ রাকাতেও শুধুমাত্র সূরা ফাতিহা পড়তে হবে।
সুরা ফাতেহা পড়ার পর যখন আপনি চতুর্থ বৈঠকে চলে যাবেন, তখন না দাঁড়িয়ে আবার বসে পড়তে হবে। এবং তার পরের শেষ বৈঠকে, তাশাহুদ, দুরুদে ইব্রাহিম পড়তে হবে,
“আল্লাহুম্মা সল্লিয়ালা মুহাম্মাদ ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদ কামা সল্লাইতা আলা ইব্রাহীম ওয়ালা আলি ইব্রাহীম ইন্নাকা হামিদুম্মাজিদ। আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদ ওয়ালা আলি মুহাম্মাদ কামা বারতকা আলা ইব্রাহীম ওয়ালা আলি ইব্রাহীম ইন্নিকা হামিদুম্মাজিদ।”
এরপর দোয়া মাসুরা পড়তে হবে দোয়া মাসুরা পড়ার পরে সালাম ফিরিয়ে সালাত শেষ করে নিতে হবে। আর এভাবেই আপনি চাইলে চার রাকাত ফরজ নামাজ আদায় করতে পারবেন।
ফরজ নামাজের আদলে সুন্নত নামাজ পড়ে নিতে পারেন। তবে সুন্নত নামাজ পড়ার জন্য আপনাকে অবশ্যই, তৃতীয় এবং চতুর্থ রাকাতে সুরা ফাতেহার সাথে অন্য আরেকটি সূরা মিলিয়ে পড়তে হবে। আপনি যদি পরো নামাজ পড়েন তাহলে তৃতীয় এবং চতুর্থ রাকাতে সুরা ফাতেহার সাথে অন্য কোন সূরা মিলিয়ে না পড়লে কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু সুন্নত নামাজের ক্ষেত্রে আপনাকে অন্য আরেকটি সূরা মিলিয়ে পড়তে হবে।
নফল সালাত পড়ার জন্য ফরজ নামাজ যেভাবে পড়েছেন ঠিক একই রকমভাবে দুই রাকাত নফল সালাত শেষ করে নিতে পারেন।
যোহর নামাজের দোয়া, Dua of Zuhr prayer
যোহর সহ সব ওয়াক্তের ফরজ নামাজের পর আয়াতুল কুরসি পাঠ করা উত্তম।
যোহরসহ প্রত্যেক ফরজ নামাজের সালাম ফিরানোর পর উপরে তাকিয়ে “আল্লাহু আকবার” বলে ৩ বার “আস্তাগফিরুল্লাহ” পাঠ করে নিম্নোক্ত দোয়া টি পাঠ করলে উত্তম। “আল্লাহুম্মা আনতাস সালামু ওয়া মিনকাস সালাতুত তাবারাকতা ইয়া জালজালালি ওয়াল ইকরাম”
এরপর নিচের দোয়াটি ও পাঠ করা ভালো।
“লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা-শারিকা লাহু। লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়াহুয়া আ’লা কুল্লি শাইয়িন কাদীর। আল্লাহুম্মা লা- মানিয়া লিমা আতাইতা।ওয়ালা মুতিয়া লিমা মানাতা ওয়ালা ইয়ানফাউজাল জাদ্দী মিনকাল জাদ্দু।”
- প্রত্যেক ওয়াক্ত নামাজের পর ৩৩ বার “সুবহানাল্লাহ” ,৩৩ বার “আলহামদুলিল্লাহ” ও ৩৪ বার “আল্লাহু আকবার” পড়া অনেক ভালো।
- যোহরের নামাজের পর সূরা ইখলাস, সূরা নাস ও সূরা ফালাক একবার করে পড়া ভালো। (সুনানে আবু দাউদ:১২২৫)
যোহরের নামাজের পর নির্দিষ্ট কোনো সূরা পড়ার কথা হাদিসে উল্লেখ করা হয় নি। তবে সূরা ফাতহ পড়া যেতে পারে, এর কারণ হল, নবী করীম (সা) এর কাছে এই সূরা অনেক প্রিয় এবং এটি আল কোরআনের একটি অধিক ফজিলতময় সূরা। উপরোক্ত আমলগুলো যোহরের নামাজের পর করা যায় । এতে অধিক নেকী লাভ করা যায় ও গুনাহ মাফ হয়ে যায়।
যোহরের নামাজের সময়, Zohr Namaz timings
দুপুরের সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়লেই যোহরের ওয়াক্ত অর্থাৎ সময় শুরু হয়। আসল ছায়া বাদে কোনো বস্তুর ছায়া দ্বিগুন হওয়া পর্যন্ত এই নামাজ আদায়ের সময় থাকে। কোনো বস্তুর ঠিক দুপুরের সময় যে ক্ষুদ্র ছায়া থাকে তাকেই বলে আসল ছায়া বা ছায়া আসলি। মধ্যাহ্নে সূর্য তার সর্বোচ্চ স্থানে থাকে, এই অবস্থান থেকে কিছুটা হেলে পড়ার পর পরই যোহর নামাজ আদায় করে নেয়া ভাল।
তবে সূর্যকিরণ যখন বেশ উত্তপ্ত থাকে, বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে একটু দেরিতে অর্থাৎ সূর্যের তেজ কিছুটা কমে এলে নামাজ আদায় করে নেয়ার অবকাশ রয়েছে। এক্ষেত্র বিশেষে আছরের সময় হওয়া পর্যন্ত নামাজ আদায় করে নেয়া যায়। কেউ যদি কোনও কারণবশত ফরজের পূর্বে চার রাকাত সুন্নত আদায় করতে না পারে, তাহলে ফরজের পরে আদায় করে নিতে পারে।
যোহরের নামাজ কটা অবধি পড়া যায়?
রাতের শেষে আকাশের পূর্ব দিগন্তে লম্বা আকৃতির যে আলোর রেখা দেখা যায় তাকেই বলে সুবহে সাদিক। যোহর: দুপুরের সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়লেই যোহরের ওয়াক্ত শুরু হয়। ছায়া আসলি বাদে কোনো বস্তুর ছায়া দ্বিগুন হওয়া পর্যন্ত এর সময় থাকে।
যোহরের নামাজের ফজিলত, Virtues of Zuhr Namaz
যোহরের নামাজও খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। এর ফজিলত সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেয়া হলো:
যোহর নামাজ সম্পর্কিত যে হাদীসটি হলো :
আবু সুফিয়ান (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আমার বোন উম্মে হাবিবা (রা.) (প্রিয় নবীজীর সা. বিবি) কে এ কথা বলতে শুনেছি যে, ‘আমি স্বয়ং রাসুল (সা.) থেকে শুনেছি, তিনি ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি জোহরের নামাজের পূর্বের এবং পরের সুন্নত নামাজের পূর্ণ খেয়াল রাখবে (নিয়মিত আদায় করবে), মহান আল্লাহ তায়ালা তার থেকে জাহান্নামের আগুন হারাম করে দেবেন। (তিরমিজি, হাদিস : ১/৫৫৪)
যোহরের সুন্নত নামাজ সম্পর্কে হাদীসে এসেছে,”যে ব্যক্তি নিয়মিত যোহরের পূর্ব ও পরবর্তী চার রাকাত সুন্নত নামাজ আদায় করবে আল্লাহ তায়ালা তার ওপর জাহান্নামের আগুন হারাম করে দিবেন।” (তিরমিজী:১/৫৫৩)
আয়েশা (রা) বলেন, “নবী করীম (সা) কখনোই জোহরের পূর্বের ও ফজরের পূর্বের সুন্নত নামাজ ছাড়তেন না।” (সহীহ বুখারী:১১৮২)। এ হাদীস দ্বারা বোঝা যায়, যোহরের সুন্নাত নামাজ আদায় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নবী করীম (সা) বলেছেন, দৈনিক যোহরের নামাজ আদায়কারীকে আল্লাহ তায়ালা বরকত দান করেন।
জুমার দিন যোহরের নামাজের পরিবর্তে জুমার নামাজ আদায় করতে হয়। তাই এ ওয়াক্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
যোহরের নামাজ জামাতের সাথে আদায় করা অনেক ভালো। এতে বেশি নেকী লাভ করা যায়।
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মধ্যে যোহরের নামাজও অধিক গুরুত্ব বহন করে। এর ফজিলত সম্পর্কে বলে শেষ করা যাবে না।
শেষ কথা, Conclusion
মুসলিমদের বিশ্বাস অনুযায়ী যোহরের নামাজ আদায়কারীকে আল্লাহ তায়ালা অনেক পছন্দ করেন। যোহরের নামাজ নিয়মিত আদায় করলে জীবনে সুখ-শান্তি ও বরকত বর্ষিত হয়। নিয়মিত যোহরের নামাজ আদায়কারীকে আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন ধরনের বালা-মুসিবত থেকে মুক্তি দেন। মোটকথা, যোহরের নামাজ একজন মুসলিমকে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে সাহায্য করে যা নিশ্চয়ই অনেক তাৎপর্যপূর্ণ।